Catch Miss in IPL 2024

১৬ ম্যাচে পড়েছে ৪১টি ক্যাচ! আইপিএলে ব্যাট-বলের লড়াইয়ে ফিল্ডিং কি দুয়োরানি?

এ বারের আইপিএলে প্রতি ম্যাচেই ক্যাচ পড়ছে। প্রথম ১৬টি ম্যাচে পড়েছে ৪১টি ক্যাচ। কেন এত ক্যাচ পড়ছে? ফিল্ডারদের দায়? না কি অন্য কারণ রয়েছে?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:৩২
Share:

আরসিবির বিরুদ্ধে ক্যাচ ফেলার মুহূর্তে কেকেআরের সুনীল নারাইন। ছবি: আইপিএল।

তখন বিধ্বংসী মেজাজে ব্যাট করছেন সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হেনরিখ ক্লাসেন। কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিরুদ্ধে ২০৯ রান তাড়া করতে নেমে দলকে প্রায় জিতিয়ে দিয়েছেন তিনি। ক্লাসেনের ব্যাট থেকে একের পর এক শট গিয়ে পড়ছে বাউন্ডারিতে। শেষ ৫ বলে দরকার ৭ রান। অতি বড় কেকেআর সমর্থকও ভেবে নিয়েছেন, ম্যাচ কলকাতা হেরে গিয়েছে। ঠিক সময় সময় হর্ষিত রানার একটি বল ক্লাসেনের ব্যাটের কানায় লেগে শর্ট থার্ড ম্যান অঞ্চলে গেল। সেখানে দাঁড়িয়ে সুযশ শর্মা। পিছন দিকে কয়েক পা ছুটে সুযশ ঝাঁপ মারলেন। তালুবন্দি করলেন বল। মাটিতে পড়েও বল ছাড়লেন না। ক্লাসেন ফিরতেই ঘুরে গেল খেলা। ৪ রানে ম্যাচ জিতল কলকাতা।

Advertisement

ক্রিকেটে প্রচলিত কথা, ‘ক্যাচেস উইন ম্যাচেস।’ অর্থাৎ, ক্যাচ ম্যাচ জেতায়। এ বারের আইপিএলে যেমন দুরন্ত কিছু ক্যাচ দেখা গিয়েছে, তেমনই সহজ ক্যাচ পড়েছে। সেই সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়। প্রথম ১৬টি ম্যাচে ৪১টি ক্যাচ পড়েছে। অর্থাৎ, গড়ে প্রতিটি ম্যাচে ক্যাচ পড়েছে ২.৫৬। প্রতি ম্যাচে ২টির বেশি ক্যাচ পড়া ফিল্ডিংয়ের জন্য মোটেও ভাল বিজ্ঞাপন নয়। এমন নয় যে তার মধ্যে সব ক্যাচ কঠিন ছিল। সহজ ক্যাচ ছেড়েছেন অনেকে। প্রতিটি দলেই এমন কিছু ফিল্ডার রয়েছেন যাঁদের বিশেষ সুনাম নেই। কলকাতা নাইট রাইডার্সে সেই তালিকায় পড়েন বরুণ চক্রবর্তী ও সুনীল নারাইন। তাঁদের হাত থেকে যেমন ক্যাচ পড়েছে তেমনই দলের অধিনায়ক শ্রেয়স আয়ারও ক্যাচ ফস্কেছেন। ফিল্ডার হিসাবে শ্রেয়স বেশ ভাল। কিন্তু তিনিও নিজের সুনাম রাখতে পারছেন না।

ফিল্ডার হিসাবে ডেভিড ওয়ার্নার, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, ফাফ ডুপ্লেসিরা বেশ ভাল মানের। তাঁদের হাত থেকেও ক্যাচ পড়েছে এ বারের আইপিএলে। লখনউ সুপার জায়ান্টসের বিরুদ্ধে সহজ ক্যাচ ফস্কেছেন ম্যাক্সওয়েল ও ডুপ্লেসি। সেই ম্যাচ হারতে হয়েছে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুকে। ম্যাচ শেষে বেঙ্গালুরুর অধিনায়ক ডুপ্লেসি স্বীকার করে নিয়েছেন, ক্যাচ ফস্কানোর জন্যই হারতে হয়েছে তাঁদের। ছবিটা সব দলেই কমবেশি এক। এমন কোনও দল এ বার নেই যারা সব ক’টি ক্যাচ ধরেছে। ৩০ গজ বৃত্তের ভিতরের ফিল্ডার থেকে শুরু করে বাউন্ডারির ধার, সব জায়গায় ক্যাচ পড়ছে। এমন সময় পড়ছে যাতে খেলার ছবিটাই বদলে যাচ্ছে।

Advertisement

ক্যাচ ছাড়ার মুহূর্তে বেঙ্গালুরুর গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। ছবি: পিটিআই।

কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? তা হলে কি দলগুলি ব্যাটিং বা বোলিংয়ের উপর যে ভাবে নজর দিচ্ছে, সে ভাবে ফিল্ডিংয়ে নজর দিচ্ছে না? ফিল্ডিং কি দুয়োরানি হয়ে যাচ্ছে?

প্রতিটি দলে ফিল্ডিংয়ের জন্য আলাদা কোচ রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছে জন্টি রোডসের নামও। ক্রিকেটের ইতিহাসে তাঁর মতো ফিল্ডার আর এসেছে কি না তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। লখনউ সুপার জায়ান্টসের ফিন্ডিং কোচ তিনি। বাকি ন’টি দলেও রয়েছেন দেশি ও বিদেশি কোচ। তাঁরা হলেন— জেমস পামেন্ট (মুম্বই ইন্ডিয়ান্স), রাজীব কুমার (চেন্নাই সুপার কিংস), রায়ান কুক (সানরাইজার্স হায়দরাবাদ), রায়ান টেন দুশখাতে (কলকাতা নাইট রাইডার্স), দিশান্ত যাজ্ঞিক (রাজস্থান রয়্যালস), মালোলান রঙ্গরাজন (রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু), মিথুন মানহাস (গুজরাত টাইটান্স), বিজু জর্জ (দিল্লি ক্যাপিটালস) ও ট্রেভর গনসালভেস (পঞ্জাব কিংস)। জন্টির মতো ফিল্ডার কোনও দলের কোচ থাকলে সেই দলের ফিল্ডিংয়ের মান বাকি সব দলের থেকে ভাল হওয়া উচিত। লখনউ বাকি ন’টি দলের থেকে কম ক্যাচ ফেলেছে। কিন্তু সেখানেও তো ক্রুণাল পাণ্ড্যের মতো নির্ভরযোগ্য ফিল্ডার গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ক্যাচ ধরতে পারেননি। তা হলে এই রোগের আসল কারণ কী?

ক্যাচ ছেড়েছেন বেঙ্গালুরুর উইকেটরক্ষর অনুজ রাওয়াত। ছবি: পিটিআই

ক্যাচ মিস্‌ নিয়ে উদ্বিগ্ন সুনীল গাওস্কর থেকে শুরু করে রবি শাস্ত্রী। ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় গাওস্করকে বলতে শোনা গিয়েছে, “এখন ফিল্ডারেরা ক্যাচ ধরার নিয়ম মানে না। বেশির ভাগ ফিল্ডার রিভার্স হ্যান্ডে (হাত উপরের দিকে রেখে) ক্যাচ ধরতে যাচ্ছে। ভারতের মাটিতে এ ভাবে ক্যাচ ধরলে হবে না। হাত বলের নীচে রাখতে হবে। নইলে ক্যাচ পড়বেই। সব ফিল্ডিং কোচের উচিত সেটা ক্রিকেটারদের বোঝানো।” আবার শাস্ত্রী মনে করেন, ম্যাচের চাপে ফিল্ডারেরা ভুল করে ফেলছেন। শুধু টেকনিককে দায়ী করে লাভ নেই। তিনি বলেন, “কঠিন পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে ক্যাচ ধরা সহজ নয়। যে ফিল্ডার সেটা করতে পারবে সে ক্যাচ ধরবে। এ বার অনেকে ম্যাচের চাপে ভুল করে ফেলছে।”

শুধুই কি তাই? এ বার খেলা দেখে বোঝা গিয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে ফ্লাডলাইটের কারণে ক্যাচ পড়ছে। লাইটের বিপরীতে ফিল্ডার দাঁড়িয়ে থাকলে তাঁর পক্ষে বল দেখা মুশকিল। যে সময় তিনি বল দেখতে পান তখন সময় খুব কম থাকে। সেই কারণে ঠিক জায়গায় হাত নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। আবার রাতের দিকের খেলার উঁচু ক্যাচ পড়ছে। বল আকাশে বেশি উঁচুতে উঠলে কিছু ক্ষণের জন্য তা ফ্লাডলাইটের থেকে বেশি উঁচুতে চলে যায়। সেই সময় বল অন্ধকারে থাকে। ফিল্ডার তখন বল দেখতে পান না। সেই সময় ফিল্ডারের কৃতিত্ব ঠিক জায়গায় গিয়ে নিজেকে দাঁড়ানো। তবেই তিনি ক্যাচ ধরতে পারবেন। কিন্তু ফিল্ডার যদি সেই সময় বল থেকে দূরে থাকেন তা হলে তাঁর পক্ষে বলের নীচে ঠিক জায়গায় দাঁড়ানো মুশকিল। তখনই ক্যাচ পড়ছে। যে বল আবার খুব বেশি না উঠে বাউন্ডারির দিকে যাচ্ছে, সেই ক্যাচ ধরতেও সমস্যা হচ্ছে ফিল্ডারদের। কারণ, সেই সময় বলের পিছনে গ্যালারির দর্শকেরা থাকেন। রং-বেরঙের জার্সি পড়ে থাকা দর্শকদের মাঝে বল হারিয়ে যাচ্ছে। ঠিক জায়গায় হাত নিয়ে যেতে পারছেন না ফিল্ডারেরা।

ক্যাচ ধরতে পারেননি লখনউয়ের রবি বিষ্ণোই। ছবি: পিটিআই

এই বিষয়ে কী বলছেন বিশেষজ্ঞেরা? আনন্দবাজার অনলাইন যোগাযোগ করেছিল বাংলার দুই প্রাক্তন ক্রিকেটার সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শরদিন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সম্বরণ মানতে চাইছেন না যে ফিল্ডিংকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। তাঁর মতে, বিভিন্ন কারণে ক্যাচ পড়ছে। সম্বরণ বলেন, ‘‘যে সব মাঠে খেলা হচ্ছে সেখানে ফ্লাডলাইটের উচ্চতা ও অ্যাঙ্গলের (কোণ) উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। যেমন, মোহালিতে ফ্লাডলাইট অনেক নীচে। ওখানে ক্যাচ ধরতে অসুবিধা হয়। বল যখন অনেক উপরে ওঠে তখন কিছু ক্ষণের জন্য কালো আকাশে হারিয়ে যায়। তখন ক্যাচ পড়ে। কারণ শুধুমাত্র খারাপ ফিল্ডিংয়ের জন্য এত ক্যাচ পড়বে না।” তিনি আরও বলেন, “এখন ফিল্ডিংয়ের মান অনেক উন্নত। প্রতিটা দল ফিল্ডিংকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রতিটা দলে এত সাপোর্ট স্টাফ রয়েছে। আইপিএলে ফিল্ডিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি ম্যাচে ১৫-২০ রান বাঁচান ফিল্ডারেরা। তার উপরেই খেলার ফল নির্ভর করে।”

শরদিন্দু আবার একটু অন্য কথা ভাবছেন। তাঁর কথায়, ‘‘গ্রাউন্ড ফিল্ডিং আর ক্যাচিং সম্পূর্ণ আলাদা। এমন অনেকে আছে যারা শুরু থেকেই ভাল ফিল্ডার। যত দিন যায় সে আরও ভাল হয়। আবার কাউকে ঘষে-মেজে ফিল্ডার তৈরি করা হয়। ক্যাচ ধরার সময় কয়েকটা বিষয় মাথায় রাখতে হয়। বল কোথায় পড়বে সেটা আন্দাজ করে তার নীচে পৌঁছতে হয়। মাথা সোজা রাখতে হয়। বলকে শেষ পর্যন্ত দেখতে হয়। আর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হালকা হাতে বল ধরতে হয়। অনেকে চেষ্টা করে শক্ত হাতে ক্যাচ ধরার। অনেকে আবার উঁচু ক্যাচ ধরতে গিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। তাড়াহুডো করে। তখনই ক্যাচ পড়ে।” তবে ফ্লাডলাইট ও গ্যালারির কারণেও যে ক্যাচ পড়ে তা স্বীকার করে নিয়েছেন শরদিন্দু। তিনি বলেন, “রাতের খেলায় বল উঁচুতে উঠলে একটা সময় ফ্লাডলাইটের উপরে অন্ধকারে চলে যায়। কিছু ক্ষণ পরে আবার আলোয় আসে। সেই সময় নিজেকে ঠিক জায়গায় রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে শেষে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ক্যাচ পড়ে। আবার যে বল বেশি ওঠে না সে ক্ষেত্রে গ্যালারিতে বল হারিয়ে যেতে পারে। শুধু ক্যাচ নয়, গ্রাউন্ড ফিল্ডিংয়েও সেটা দেখা যাচ্ছে। আইপিএলে ক্যাচ পড়লেও ফিল্ডিং কিন্তু খুব একটা খারাপ হচ্ছে না।”

কারণ যা-ই হোক না কেন, ক্যাচ পড়ছে। প্রতিটি ম্যাচে পড়ছে। বিশ্বের সব থেকে জনপ্রিয় ক্রিকেট লিগের পক্ষে এটা কিন্তু ভাল বিজ্ঞাপন নয়। ফিল্ডিং কোচেরা শুনতে পাচ্ছেন তো!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement