বৈভব অরোরা। ছবি: আইপিএল
বৈভব অরোরা। রবিবার চেন্নাই সুপার কিংসের বিরুদ্ধে আইপিএলে অভিষেক হয়েছে পঞ্জাব কিংসের এই ফাস্ট বোলারের। আনন্দবাজার অনলাইনের মতে ম্যাচের সেরাও হয়েছেন ২১ রানে ২ উইকেট নিয়ে। ২৪ বছরের এই তরুণই এক সময় ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন।
চেন্নাইয়ের বিরুদ্ধে বৈভব প্রথম উইকেট পেতেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান পঞ্জাবের আরেক ফাস্ট বোলার অর্শদীপ সিংহ। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, উইকেটটা তিনিই পেয়েছেন। আসলে বৈভব-অর্শদীপের বন্ধুত্ব এমনই। গত বছর কলকাতা নাইট রাইডার্স বৈভবকে দলে নিলেও হিমাচল প্রদেশের এই বোলারকে একটি ম্যাচেও ব্যবহার করেনি। তাই অর্শদীপের আনন্দের পরিমাণ ছিল একটু বেশিই। চণ্ডীগড়ের গুরু গোবিন্দ সিংহ কলেজের ক্রিকেট দলে তাঁরা দু’জনেই শুরু করতেন বোলিং আক্রমণ। দু’জনের বন্ধুত্বও তখন থেকেই।
আইপিএলের প্রথম ম্যাচে নজর কাড়ার পরেই আলোচনার কেন্দ্রে বৈভব। তাঁর কোচ রবি বর্মাও দারুণ খুশি ছাত্রের বোলিং দেখে। তিনি বলেছেন, ‘‘২০১৭ সালে পঞ্জাব ক্রিকেট সংস্থা ফাস্ট বোলারদের জন্য শিবির করেছিল। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আইএস বিন্দ্রা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের গেটের কাছে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অর্শদীপ এবং বৈভব। দু’জনেরই কনুই এবং হাঁটুতে চোট লেগেছিল।’’ হাসপাতাল থেকে ফোন পেয়ে দুই প্রিয় ছাত্রকে দেখতে ছুটে যান রবি। সেই স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি আরও বলেছেন, ‘‘অর্শদীপ অনূর্ধ্ব ১৯ ভারতীয় দলে সুযোগ পায়। তার পর আইপিএলেও সুযোগ পায়। কিন্তু বৈভব পঞ্জাবের অনূর্ধ্ব ১৯ দলে তিন মরসুম খেলেও সুযোগ পায়নি।’’
ভাল পারফরম্যান্সের পরেও সুযোগ না পেয়ে ভেঙে পড়েছিলেন বৈভব। সে সময়ই কোচকে অনুরোধ করেন একটি কাজের ব্যবস্থা করে দিতে। জানান আর ক্রিকেট খেলতে চান না। সে সময় বৈভবের বাবার ব্যবসায় মন্দা চলছিল। অম্বালায় গোপাল অরোরার একটি ডেয়ারি ছিল। সেটি বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের আর্থিক পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করায় বৈভব ক্রিকেট ছেড়ে রোজগারের কথা ভাবতে শুরু করেন। ছাত্রদের মধ্যে বৈভব ছিলেন প্রতিভাবান। তিনি ক্রিকেট ছেড়ে দেবেন, মানতে পারেননি রবি। তিনি বলেছেন, ‘‘ওর মুখে ক্রিকেট ছাড়ার কথা শুনে চমকে যাই। ওকে বলেছিলাম, তোমার হাঁটুতে একটা চোট আছে। মাথায় তো কোনও আঘাত লাগেনি। জানি তোমার পরিবার অর্থকষ্টের মধ্যে রয়েছে।’’
এর পরেই গোপাল অরোরাকে ফোন করেন রবি। বৈভবের বাবাকে তিনি বলেন, ‘‘আমাকে বৈভবের জন্য আর দু’টো বছর সময় দিন। আমি ওর খেলার খরচের সব দায়িত্ব নিচ্ছি। আপনাকে একটা পয়সাও খরচ করতে হবে না।’’ ২০১৮ সালে রবিই বৈভবকে হিমাচল প্রদেশে পাঠান পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে খেলার জন্য। কিন্ত মাত্র ২০ বছর বয়সে ভিন রাজ্যে পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে মানিয়ে নিতে পারেননি বৈভব। জেলা স্তরের একটি ম্যাচে বৈভবের বলে সাতটি ক্যাচ ফেলে দেন ফিল্ডাররা। সেই ম্যাচের পর বৈভব ফোন করে রবিকে অনুরোধ করেন, ‘‘স্যর দয়া করে আমাকে যে কোনও একটি কাজের ব্যবস্থা করে দিন। আমার পক্ষে আর ক্রিকেট চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।’’
না এর পরেও হাল ছাড়েননি কোচ। রেগে গিয়ে বৈভবকে বলেন, ‘‘নিজের কপালে একটা ট্যাটু করে নাও। সেখানে লিখবে, হাল ছেড়ে দেওয়া লোক। আর আমাকে কখনও ফোন করবে না।’’ রবি বলেছেন, ‘‘ওই ধমকে কাজ হয়। পরের ম্যাচেই বৈভব পাঁচ উইকেট পায়। ভাল পারফর্ম করতে শুরু করে। হিমাচলের অনূর্ধ্ব ২৩ দলে সুযোগ পায়। এক দিনের ক্রিকেটে হিমাচলের অনর্ধ্ব ২৩ দলের হয়ে ৯ ম্যাচে ২৬ উইকেট পায়। প্রতিযোগিতায় ওই সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হয়। সুযোগ পায় রঞ্জি দলে। অভিষেক ম্যাচেই সৌরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ১০৫ রান দিয়ে ৯ উইকেট নিয়েছিল। ধর্মশালার সেই ম্যাচটা আমার এখনও মনে রয়েছে। দুরন্ত ছন্দে ছিল চেতেশ্বর পুজারা। বৈভব ওর দুর্ভেদ্য রক্ষণই শুধু ভাঙেনি, মিডল স্টাম্প ছিটকে দিয়েছিল।’’
২০২০ সালে কেকেআর ছাড়াও মুম্বই ইন্ডিয়ান্স এবং রাজস্থান রয়্যালসের প্রাথমিক শিবিরে ডাক পান বৈভব। কিন্তু কেউই তাঁকে নেয়নি। পরের বার কেকেআর নিলেও খেলায়নি। এর পর বন্ধুর জন্য উদ্যোগী হন অর্শদীপ। তাঁর চেষ্টাতেই পঞ্জাব ফ্র্যাঞ্চাইজিতে সুযোগ পান বৈভব।
বৈভব বলেছেন, ‘‘৮০ দিন পঞ্জাবের শিবিরে থাকার পর আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়েছে। বোলিংয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। কেএল রাহুল, ময়ঙ্ক অগ্রবাল, ক্রিস গেল, গ্লেন ম্যাক্সওয়েলদের নেটে বোলিং করে উপকৃত হয়েছি। বড় ব্যাটারদের বিরুদ্ধে বল করতে ভয় লাগত। সেটা কেটে গিয়েছে এখন।’’ উল্লেখ্য এবার নিলামে দু’কোটি টাকায় বৈভবকে কিনেছে পঞ্জাব। তাঁর ইনস্যুইং ইয়র্কারের প্রশংসা করেছেন পঞ্জাবের কোচ অনিল কুম্বলেও।
রবিবার সকালে বৈভব ফোন করেন কোচ রবিকে। ম্যাচ খেলার সম্ভাবনার কথা জানান। রবির মতে, ‘‘আমার ধমকে যে দিন থেকে বৈভব অনূর্ধ্ব ২৩ পর্যায়ে ব্যাটারদের বেশি বেশি বাউন্সার, ইয়র্কার দিতে শুরু করল, সে দিনই বুঝেছিলাম এবার সঠিক পথে হাঁটতে শুরু করেছে ও। ফাস্ট বোলারের শরীরে একটু রাগের দরকার হয় কখনও কখনও।’’
বৈভবের বোলিংয়ে খুশি পঞ্জাবের সতীর্থরাও। শিখর ধবন বলেছেন, ‘‘নেটে আমাদের বেশ সমস্যায় ফেলছিল বৈভব। তা দেখেই ঠিক করা হয় ওকে ম্যাচে ব্যবহার করা হবে। ভাল ছন্দে রয়েছে ছেলেটা। লাইন, লেংথ দারুণ। প্রথম ম্যাচেই যে ভাবে বোলিং করল, তাতে ভরসা করাই যায়।’’