কুলদীপ সেন। —ফাইল চিত্র।
না! তিনি বাঙালি নন। মধ্যপ্রদেশের রেওয়ায় পেশাগত ক্ষৌরকারদের ‘সেন’ উপাধি দেওয়া হয়। কুলদীপ সেন সেই ক্ষৌরকার পরিবারের সন্তান। বাবা রামপাল সেন সেই কাজ চালান। রবিবার রাতে যে দোকানের সামনে তিলধারণের জায়গা ছিল না রাত এগারোটার পরে।
ছেলের খেলা দেখার জন্য বাড়ি ফেরেননি বাবা। সেখানেই টিভি চালিয়ে বসেছিলেন। শেষ ওভারে তাঁর ছেলের হাতে রাজস্থান রয়্যালস অধিনায়ক সঞ্জু স্যামসন বল তুলে দেওয়ায় খুবই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। হাতে ১৫ রান। গুজরাত টাইটান্সের মার্কাস স্টোয়নিস তার আগে ১৯তম ওভারে ১৯ রান তুলেছিলেন। আইপিএলের অভিষেক ম্যাচে এক ওভারে ১৫ রান তাঁর ছেলে আদৌ কি আটকাতে পারবেন?
কুলদীপ যখন ওভারের চতুর্থ বল করার জন্য ছুটে আসছিলেন, তাঁর বাবা চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলেন। সোমবার সেই মুহূর্ত নিয়ে রামপাল সেন বলছিলেন, ‘‘তিন বলে বাকি ছিল ১৪ রান। একটা ছয় হয়ে গেলেই ছেলে চাপে পড়ে যেত। আমি চোখ বন্ধ করে ছিলাম। হঠাৎ জোরে চিৎকার শুরু হল। বুঝতে পারলাম, সেই বলেও কোনও রান হয়নি।’’ ওভারের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বল ‘ডট’ দিয়ে প্রথম বার আইপিএল খেলতে নেমে রাজস্থানের জয় নিশ্চিত করেন কুলদীপ। শিমৌর স্কোয়ারে শুরু হয়ে যায় উৎসব। বেঙ্কটেশ আয়ার, আবেশ খানের পরে মধ্যপ্রদেশের আরও এক ভূমিপুত্র উঠে এল আইপিএল গ্রহে।
ছোটবেলা থেকে প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই বড় হয়েছেন কুলদীপ। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয় সন্তান। বাবা বরাবরই চাইতেন, ছেলে পড়াশোনা করুক। কিন্তু লক্ষ্য করতেন, ছেলের মন পড়ে রয়েছে মাঠেই। রামপাল ভেবেছিলেন, ছেলেকে দায়িত্ব দেওয়া হবে পারিবারিক কাজেরই। সেই অনুযায়ী মাঝেমধ্যে কাজও শেখাতে শুরু করেন। কিন্তু নানা ধরনের চুলের ছাঁট, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ির দিকে কোনও ভাবেই মন বসছিল না কুলদীপের। বাবা উপলব্ধি করেন, ছেলের ভবিষ্যৎ লেখা আছে ক্রিকেটেই। কোচিং ক্যাম্পে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সেখানের পারিশ্রমিক কী করে জোগাড় করবেন? তবুও কুলদীপকে নিয়ে রেওয়ার বিন্ধ্য ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে নিয়ে যান। সেখানে কুলদীপের বোলিং দেখে ভর্তি করে নেন কোচ এরিয়েল অ্যান্থনি। আশ্বস্ত করেন, কোনও রকম পারিশ্রমিক ছাড়াই তৈরি করা হবে কুলদীপকে। একই শহর থেকে ভারতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন ঈশ্বর পাণ্ডে। চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে আইপিএলে বেশ কিছু উইকেটও ছিল তাঁর। ঈশ্বরের সঙ্গে সেখানেই প্রথম আলাপ। ক্রিকেট সরঞ্জাম কেনার সামর্থটুকুও ছিল না। কোচ অ্যান্থনি ও ঈশ্বরই কুলদীপকে জুতো উপহার দিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে প্রথম বারের মতো মধ্যপ্রদেশের রঞ্জি ট্রফি দলে সুযোগ পান কুলদীপ। তাঁর গতিই চমকে দেয় নির্বাচকদের। পঞ্জাবের বিরুদ্ধে ঈশ্বরের উপহার দেওয়া জুতো পরেই প্রথম বারের মতো পাঁচ উইকেট পান। কোচ অ্যান্থনি বলছিলেন, ‘‘প্রথম দিন থেকেই ওর বোলিং আমাকে মুগ্ধ করেছিল। গতিই ওর অস্ত্র। ডেলিভারিতে অনেক গলদ ছিল, কিন্তু গতি কমিয়ে ডেলিভারি ঠিক করতে যাইনি।’’ যোগ করেন, ‘‘ওর সবচেয়ে বড় গুণ, ব্যাটারকে সামনের পায়ে ক্রমাগত খেলিয়ে যেতে পারে। স্টোয়নিসকেও ওয়াইড ইয়র্কার দিয়ে বিভ্রান্ত করেছে। দিনে একশোটা ইয়র্কার করাতাম এক সময়।’’
সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফিতে ২০২১-’২২ মরসুমে পাঁচ ম্যাচে চার উইকেট নেন কুলদীপ। ইকনমি রেট ছিল ৭.৭৬। সেখান থেকেই রাজস্থান রয়্যালসের ট্রায়ালে সুযোগ পান। এ বারের নিলামে ২০ লক্ষ টাকায় নেওয়া হয় তাঁকে। প্রাক্তন ভারতীয় পেসার ঈশ্বর পাণ্ডে বলছিলেন, ‘‘ওদের পরিবার এ বার উপকৃত হবে। কুলদীপের প্রতিভা নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু বাবাকে আর কত দিন ক্ষৌরকার্য করে যেতে হবে, সেই চিন্তাই ঘুরত কুলদীপের মাথার মধ্যে। বলেছিলাম, ক্রিকেট ভাল করে খেললেই বাবার মুখে হাসি ফুটবে।’’
ঈশ্বর মনে করেন, রাজস্থানের বোলিং কোচ লাসিথ মালিঙ্গার প্রশিক্ষণে উন্নতি করেছেন নতুন কুলদীপ। তাঁর কথায়, ‘‘ওর লাইন-লেংথে কিছুটা সমস্যা ছিল। মালিঙ্গার প্রশিক্ষণে সেটাও ঠিক হয়ে গিয়েছে।’’
কুলদীপের আইপিএল দরজা খুলেছে ২৫ বছর বয়সে। ঈশ্বরের বিশ্বাস, আন্তর্জাতিক স্তরেও দ্রুত পৌঁছে যাবেন নতুন কুলদীপ।