আইপিএলে ফাইনালে ওঠাটা যেন চেন্নাই সুপারকিংসের কাছে ‘স্বাভাবিক’ একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বছরের হিসাব ধরলে মোট আট বার আইপিএলের ফাইনালে গেল চেন্নাই। ডু অর ডাই ম্যাচে প্রতিপক্ষ যেই থাক, খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দিতে সিএসকে-র সময় লাগে না। শুক্রবার রাতে কোয়ালিফায়ার টু-এ দিল্লিও একই ঘটনার শিকার।
এ বছর আইপিএলের শুরু থেকেই অন্যান্য বারের চেয়ে ঢের বেশি পরিণত ও বুদ্ধিমান ক্রিকেটের ছাপ রেখে এগোচ্ছিল দিল্লি। যার অন্যতম দাবিদার দলের মেন্টর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ও কোচ রিকি পন্টিং। দুই যুযুধান ক্রিকেট মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করছিল দিল্লির সব ওঠাপড়া। বাজি হারতে হল কোয়ালিফায়ার টু-এ এসে। বিশাখাপত্তনমের ম্যাচে কোথায় পিছিয়ে পড়ল দিল্লি?
তারুণ্যের শক্তি এ বারে দিল্লির প্রধানতম জোর ছিল। পৃথ্বীর মতো তরুণ প্রতিভাবান ওপেনার, ঋষভ পন্থ, কিমো পলের মতো অন্যতম সেরা ব্যাটিংশক্তি, শ্রেয়স আইয়ারের মতো তরুণ অধিনায়ক— সব মিলিয়ে দিল্লি প্রথম থেকেই চমক দিচ্ছিল। দিল্লি বনাম চেন্নাইয়ের খেলা আসলে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল তারুণ্য বনাম অভিজ্ঞতার মাপকাঠিতে।
আর অভিজ্ঞতার ঘাটতিতেই মাত্র ১৪৭ রানেই গুটিয়ে গিয়েছিল দিল্লি। ব্যর্থতার কারণ ব্যাখ্যা করতে বসে বিশেষজ্ঞরা বার বার চারটি কারণকেই দায়ী করছেন।
এক) টসে হেরে যাওয়া। টসে জিতে পরে ব্যাট নেওয়ায় শিশিরে পিচ ভিজে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেচেন্নাই। ফলে রান তাড়া করতে অনেকটা সুবিধা পেয়েছে ধোনি ব্রিগেড।
দুই) অভিজ্ঞতার অভাব আর ভুল শটের পরিণামে টপ অর্ডারে পৃথ্বী ও শিখর ধবনের আউট অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছিল দিল্লিকে। ব্যাটিং লাইন আপে দিল্লির মূল শক্তি নিহিত ছিল টপ অর্ডারে। সেই টপ অর্ডারের ব্যর্থতাই ভোগালো দিল্লিকে।
তিন) টপ অর্ডার ব্যর্থ হওয়ায় ঋষভ পন্থের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে যায়। চাপের মুখে খেলতে গিয়ে ভুল সময়ে আউট হয়ে যান পন্থ। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের মতে, ঋষভ আরও কয়েকটা বল থেকে গেলে রানের পাল্লা ভারী হতে পারত দিল্লির। ম্যাচ জেতা সহজ হত।
চার) কিমো পলের তুলনায় ক্রিস মরিস বেশি অভিজ্ঞ। অথচ টিম ভাবনার গলদে তিনিই শুক্রবারের ম্যাচ থেকে বাদ পড়লেন। সৌরভ ও পন্টিংয়ের মাথা যে দলের নেপথ্যশক্তি, তাতে এমন ভুল কেমন করে হয় সেটাই ভাবাচ্ছে ক্রিকেটমোদীদের।
উল্টো দিকে তারুণ্যের চেয়েও অভিজ্ঞতায় ভর দিয়েই বাজিমাত করল চেন্নাই। পৃথ্বীর এলবিডব্লিউয়ের আবেদন নাকচ হওয়ার পরেও ঝুঁকি নিয়ে ডিআরএস চেয়ে বসলেন ধোনি। হ্যাঁ, ম্যাচের গোড়াতেই। এখানেই ক্ষুরধার অভিজ্ঞতার জয়। ডিআরএসের সুবিধা নিয়ে পৃথ্বীকে মাত্র পাঁচ রানে ফিরিয়ে দিয়ে দিল্লির শিবিরে প্রথম বড় ধাক্কা দিতে সক্ষম হল চেন্নাই।
ধোনিদের ব্যাটিং পরিকল্পনা ছিল, পাওয়ার প্লে-তে উইকেট দেওয়া চলবে না। সে ভাবেই খেলে গেলেন ডুপ্লেসি ও ওয়াটসন। মরণ-বাঁচন ম্যাচে যে সচেতনতা ও অভিজ্ঞতার দরকার হয়, সেটারই মিশেল দেখালেন দু’জনে। পাওয়ার প্লে-তে উইকেট না হারিয়ে ৪২ রান তুলে ফেলায় ম্যাচ ধরতে সময় লাগেনি চেন্নাইয়ের।
অবশ্য দিল্লির দুর্বল ফিল্ডিংও তাদের হেরে যাওয়ার অন্যতম কারণ। প্রথম ওভারেই টপ অর্ডারকে নাস্তানাবুদ করে ফেলার ভাল সুযোগ ছিল দিল্লির হাতে। মিসফিল্ডের জেরে তা আর হল কই! বরং ওয়াটসন (৩২ বলে ৫০) ও ফ্যাফ ডুপ্লেসি (৩৯ বলে ৫০)-র জুটিকে ভাঙতে পরে বড্ড বেগ পেতে হল দিল্লিকে।
বোলার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও খুব ঠান্ডা মাথার পরিচয় দিলেন ধোনি। অদ্ভুত ভাবে ব্যবহার করলেন ব্রাভোকে। প্রায় প্রতি বলের আগে ব্রাভোর কাছে গিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন ঠিক কী চাই। ব্যাটসম্যানকে অসুবিধায় ফেলে উইকেট টু উইকেট বল করলেন ব্রাভো। ৪ ওভারে মাত্র ১৯ বলে ২ উইকেট নিলেন তিনি। ধোনির বুদ্ধিমত্তার এই ঝলকের সামনেও পরাস্ত হল দিল্লি।
উল্টো দিকে বোলিং খুব ভাল শুরু করলে যত খেলা এগিয়েছে, ততই নিষ্প্রাণ ও ছন্নছাড়া লেগেছে দিল্লির খেলা। খেলাটা যে কেবল মাঠের বাইরের মস্তিষ্কের উপর ভর দিয়ে হয় না, মাঠের ভিতরেও একই রকম সক্রিয় একটা ক্রিকেটমস্তিষ্ক লাগে, তারই প্রমাণ দিলেন ধোনি তথা চেন্নাই।