প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে লুকিয়ে ছিল ৩০০ বছরের পুরনো প্রবালটি। প্রথমে যাকে দেখে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ ভেবেছিলেন গবেষকেরা। পরে সেই ভুল ভাঙতে চোখ কপালে ওঠে সমুদ্রবিজ্ঞানীদের। এ যে এক বিশাল প্রবাল! শুধু বিশালই নয়, বিশ্বের বৃহত্তম প্রবালের সন্ধান মিলল প্রশান্ত মহাসাগরের সলোমন দ্বীপপুঞ্জের কাছে।
সলোমন দ্বীপপুঞ্জের স্বচ্ছ জলের নীচে ভেসে বেড়ানো প্রবালটি এতটাই বিশাল যে, উপর থেকে দেখে মনে হবে বিশাল আকারের এক নীল তিমি ভেসে বেড়াচ্ছে। ৩৪ মিটার (১১১ ফুট) চওড়া এবং ৩২ মিটার (১০৪ ফুট) দীর্ঘ এই প্রবালটি একশো কোটি ছোট ছোট প্রবাল কীট (পলিপ) দিয়ে তৈরি।
ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিকের একটি অভিযানের সময় এই চমকপ্রদ আবিষ্কার করেন সামুদ্রিক গবেষকেরা। সেই দলের গবেষক ও সামুদ্রিক পরিবেশবিদ এনরিক সালা জানিয়েছেন, যখন পৃথিবীতে আবিষ্কার করার মতো বিষয় শেষ হয়ে এসেছে বলে কারও কারও মনে হচ্ছে, তখনই এই রঙিন বিশাল প্রবালটি আবিষ্কার করেছেন গবেষকেরা।
বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন আকারে নীল তিমির থেকে বড় এই প্রবালটি এতই বিশাল যে, এটি মহাশূন্য থেকে দৃশ্যমান।
অক্টোবর নাগাদ ওই অঞ্চলের সমুদ্রের গভীরে ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফির বিজ্ঞানী ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একটি দলের সদস্যরা অভিযান চালাচ্ছিলেন। তখনই জাহাজের মতো দেখতে ওই বিশাল কাঠামোটি দেখেন তাঁরা। এলাকাটি আরও ভাল ভাবে পর্যবেক্ষণ করে তাঁরা নিশ্চিত হন, এটি কোনও ধ্বংসস্তূপ নয়, বরং জীবন্ত একটি প্রবাল।
প্রথমে এর বিস্তীর্ণ আকার ও বাদামি চেহারা দেখে একটি জাহাজের ধ্বংসাবশেষ বলে ভুল করেছিলেন গবেষকেরা। ভাল ভাবে নিরীক্ষণ করার পর প্রবালের উজ্জ্বল বেগনি, হলুদ, নীল এবং লাল রঙের ছটা দেখতে পান তাঁরা।
প্রবাল প্রাচীরের সম্পূর্ণ বিপরীত এই একক প্রবালটি ক্রমবর্ধমান, যা কয়েক শতাব্দী ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যেই নিজেকে টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছে। বিশ্ব জুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন প্রবাল প্রাচীরের অস্তিত্বকে সঙ্কটের মুখে ফেলেছে।
বিশাল আকারের প্রবালটি সমুদ্রের নীচের বাস্তুতন্ত্রের সৌন্দর্য ও স্থিতিস্থাপকতার প্রমাণ। একে এক বিরল ঘটনা বলে বর্ণনা করেছেন বিজ্ঞানীরা।
অভিযানকারী দলের চিত্রগ্রাহক ফেলিক্স বলেন, সলোমন দ্বীপপুঞ্জের এই প্রবালটিকে জলের নীচে দেখতে বড়সড় এক গির্জার মতো লাগছিল। গবেষণা দলের প্রধান মলি টিমারস আবার জানিয়েছেন, নতুন আবিষ্কার হওয়া প্রবালটিকে গলে যাওয়া আইসক্রিমের মতো দেখতে।
গবেষকদের মতে, বালি দিয়ে ঘেরা এই বিশাল প্রবালে প্রায় একশো কোটি প্রবাল কীট বাস করতে পারে। হাজার হাজার ক্ষুদ্র কীট মিলে গঠিত হয়েছে এটি। এই প্রবালগুলো মিলে তৈরি হয় বিশাল প্রবাল প্রাচীর। প্রবাল ও প্রবাল প্রাচীরগুলি হল মাছ, কাঁকড়ার মতো সামুদ্রিক প্রাণীর নিশ্চিত আস্তানা।
এত দিন আমেরিকার সামোয়ায় ‘বিগ্ মামা’ নামে পরিচিত প্রবালটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রবাল হিসাবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছিল। তবে ‘বিগ্ মামা’ প্রবালের চেয়ে নতুন সন্ধান পাওয়া প্রবালটি আকারে তিন গুণ বড়।
সলোমন দ্বীপ অঞ্চলে যে দলটি অভিযান চালিয়েছিল, তার প্রধান বিজ্ঞানী মলি টিমারস জানান, জলবায়ু পরিবর্তন কী ভাবে প্রশান্ত মহাসাগরকে প্রভাবিত করছে, তা দেখাই এই দলের প্রধান লক্ষ্য ছিল। এই সুবিশাল প্রবালটি খুঁজে পাওয়ার ঘটনা নিছকই কাকতালীয়। কারণ প্রথমে এর অস্তিত্ব নিয়েই মাথা ঘামানো হয়নি।
সলোমন দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় প্রান্তের একটি জায়গায় প্রবালটির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এ জায়গাটি ‘থ্রি সিস্টারস’ নামে পরিচিত।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজ়ারভেশন অফ নেচার অনুসারে জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত মাছ ধরা, দূষণ এবং সমুদ্রের ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার কারণে প্রবাল ও প্রবাল প্রাচীর বিশ্বব্যাপী ঝুঁকির সম্মুখীন। তাদের গবেষণা বলছে, উষ্ণ জলে থাকা ৪৪ শতাংশ প্রবাল বিলুপ্তির পথে।