হাজার দিন পেরিয়ে গেল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামার নামগন্ধ নেই। উল্টে পূর্ব ইউরোপে বাড়ছে পরমাণু হামলার শঙ্কা। পরিস্থিতি যে দিকে মোড় নিচ্ছে, তাতে সংঘাতে আরও অনেক দেশের জড়িয়ে পড়া আশ্চর্যের নয়। আর সেটা যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনছে, তাতে একরকম নিশ্চিত প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা।
চলতি বছরের ১৯ নভেম্বর আমেরিকার থেকে পাওয়া মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার ব্রিয়ানস্ক এলাকায় হামলা চালায় ইউক্রেনীয় সেনা। হাতিয়ারটির পোশাকি নাম ‘আর্মি ট্যাকটিক্যাল মিসাইল সিস্টেম’ বা এটিএসিএমএস। ওয়াশিংটনের থেকে অনুমোদন মেলার পরই মস্কোর উপর এই ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগের সাহস দেখাল কিভ।
নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট ভোটে আমেরিকার নতুন রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। জানুয়ারিতে শপথ নেওয়ার পর কার্যভার গ্রহণ করবেন তিনি। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সরকার ইউক্রেনের জন্য শেষ দফার যে হাতিয়ার বরাদ্দ করেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল এটিএসিএমএস।
ব্রিয়ানস্কে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র আছড়ে পড়তেই পাল্টা রণকৌশল সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ১৯ নভেম্বর বিশেষ একটি ডিক্রিতে সই করেন তিনি। সেখানে বলা হয়েছে, আণবিক শক্তিবিহীন শত্রু রাষ্ট্র যদি পরমাণু শক্তিধর দেশের সাহায্য পায় তা হলে আত্মরক্ষার্থে তার উপর পরমাণু হামলা চালাতে পারবে মস্কো।
প্রেসিডেন্ট পুতিন এই ডিগ্রিতে সই করায় পূর্ব ইউরোপের ‘নর্ডিক’ (মতান্তরে স্ক্যান্ডেনেভিয়া) দেশগুলিতে দেখা দেয়েছে আতঙ্ক। সেখানকার নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্কের সরকার নাগরিক ও সেনাকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছে। এই চারটি রাষ্ট্রই আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘নেটো’-র সদস্য। ফলে এদের সঙ্গে মস্কোর যুদ্ধ বাধলে তাতে যে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো শক্তিধর দেশ জড়িয়ে পড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
২০২২ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিনের ফৌজ ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ (স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন) শুরু করলে জোট নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে আসে সুইডেন। এর পরই নেটোতে যোগ দেয় স্টকহোলম। হাজার দিন পেরিয়ে যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নেওয়ায় সম্প্রতি নাগরিকদের মধ্যে লক্ষ লক্ষ প্রচার পুস্তিকা ও লিফলেট বিলি করেছে সেখানকার সরকার। এর শিরোনামে লেখা রয়েছে ‘যদি সঙ্কট বা যুদ্ধ আসে’।
সুইডিশ প্রশাসনের পদস্থ আধিকারিক মিকেল ফ্রিসেল বলেছেন, ‘‘পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া আশ্চর্যের নয়। তাই নাগরিকদের এর মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হচ্ছে।’’ লিফলেটে সাইবার হামলার সম্ভাবনার উল্লেখ রয়েছে। পাশাপাশি, আম সুইডিশবাসীকে অপচনশীল খাবার, জল, ওষুধ ও নগদ মজুত রাখতে বলা হয়েছে।
গত শতাব্দীর ছয়ের দশকে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে এই ধরনের লিফলেট ও পুস্তিকা আমজনতার মধ্যে বিলি করেছিল সুইডিশ সরকার। ২০১৮ সালে শেষ বার এই ধরনের লিফলেট ও প্রচার পুস্তিকাগুলিকে সংশোধন করেছিল স্টকহোলম। সেখানে নিজের বাড়িতেই চাষাবাদের কথা বলা হয়েছে। প্রায় ৬৩ বছর পর ব্যাপক ভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতিতে কোমর বেঁধেছে উত্তর ইউরোপের এই দেশ।
প্রায় একই ছবি দেখা গিয়েছে ফিনল্যান্ডেও। যুদ্ধ সংক্রান্ত সঙ্কটের মোকাবিলায় নাগরিকদের সতর্ক করতে বিশেষ একটি ওয়েবসাইট চালু করেছে হেলসিঙ্কি। সেখানে সামরিক হামলা শুরু হলে কী ভাবে আত্মরক্ষা করা যাবে, তার বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। বাসিন্দাদের বোঝার সুবিধার্থে ওয়েবসাইটটিতে একাধিক ভাষায় যাবতীয় তথ্য দেওয়া হয়েছে।
রাশিয়ার সঙ্গে ১ হাজার ৩৪০ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত রয়েছে ফিনল্যান্ডের। সেখানে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কাজ শুরু করে হেলসিঙ্কি। সূত্রের খবর, ২০২৬ সালের মধ্যে শেষ হবে সেই কাজ। ওই বেড়া ১০ ফুট লম্বা হবে বলে জানা গিয়েছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মস্কোর সঙ্গে থাকা সীমান্তের আটটি চেকপয়েন্ট বন্ধ রেখেছে ফিনল্যান্ড।
সুইডেনের মতো নাগরিকদের মধ্যে লিফলেট বিলি করেছে নরওয়েও। অন্য দিকে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি ও সতর্কতার জন্য সরকারের থেকে ইমেল পাচ্ছেন ড্যানিশরা। নর্ডিক এলাকার চারটি দেশই তাদের সামরিক বাজেট কয়েক গুণ বৃদ্ধি করতে চলেছে বলে দাবি করেছে একাধিক পশ্চিমি সংবাদমাধ্যম।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, রুশ আক্রমণের আশঙ্কায় এ বার খোলাখুলি ভাবে স্ক্যান্ডেনেভিয়ার দেশগুলি ইউক্রেনকে সেনা ও হাতিয়ার দিয়ে সাহায্য করতে পারে। শেষ পর্যন্ত এই পদক্ষেপ করলে যুদ্ধের গতি বদলাতে পারে। মস্কো অবশ্য জানিয়ে দিয়েছে, কিভ সেই সাহায্য পেলেও তাদের অপারেশনে কোনও প্রভাব পড়বে না। বরং দ্রুত তা শেষ করা যাবে বলে আত্মবিশ্বাসী পুতিন প্রশাসন।
পরমাণু হাতিয়ারের ব্যবহার সংক্রান্ত ডিক্রিতে রুশ প্রেসিডেন্ট সই করার পর বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ। তাঁর কথায়, ‘‘আণবিক অস্ত্র আমাদের কাছে প্রতিরোধের হাতিয়ার। বাধ্য করা না হলে তা মোতায়েন করা হবে না। কিন্তু পরমাণু শক্তিবিহীন কোনও রাষ্ট্র যদি ক্রমাগত আণবিক হাতিয়ার সমৃদ্ধ দেশের সাহায্য নিয়ে আগ্রাসী মনোভাব দেখায়, তা হলে সেটাকে যৌথ হামলা বলেই আমরা মেনে নেব।’’
প্রেসিডেন্ট পুতিনের সই করা ডিক্রির সুবিধা প্রতিবেশী বেলারুশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে মস্কো। তবে তাঁর এই পদক্ষেপ আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দেশগুলিকে পিছু হটতে বাধ্য করবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। নেটোর প্রধান ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেন, পুতিনকে ইউক্রেনে কোনও রাস্তা দেওয়া যাবে না। পাশাপাশি, রাশিয়াকে দায়িত্বজ্ঞানহীন ও বেপরোয়া বললেও আণবিক হামলার আশঙ্কা নেই বলেও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
দীর্ঘ দিন ধরেই সীমান্ত পেরিয়ে রাশিয়ার অনেকটা ভিতরে আক্রমণ চালানোর জন্য আমেরিকার কাছে লম্বা দূরত্বের ক্ষেপণাস্ত্র চেয়ে আসছিলেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি। মেয়াদ শেষের মুখে এটিএসিএমএস তাঁর হাতে তুলে দেন বাইডেন। এর নির্মাণকারী সংস্থা হল আমেরিকার বিখ্যাত প্রতিরক্ষা কোম্পানি ‘লকহিড মার্টিন’।
এটিএসিএমএস ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের জন্য ‘এম২৭০ মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেম’ অথবা চাকাযুক্ত ‘এম১৪২ হাই মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম’-এর প্রয়োজন হয়। ব্রিয়ানস্কতে হামলার জন্য এর কোনটি জ়েলেনস্কির ফৌজ ব্যবহার করেছে, তা জানা যায়নি। ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ২২৫ কিলোগ্রাম ওজনের উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন বিস্ফোরকের পাশাপাশি কয়েকশো ‘ক্লাস্টার বোমা’ নিয়ে নিখুঁত নিশানায় আক্রমণ শানাতে সক্ষম।
মস্কো জানিয়েছে, ১৯ নভেম্বর মোট ছ’টি মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চলায় ইউক্রেন সেনা। যার পাঁচটিকেই মাঝ আকাশে ধ্বংস করেছে রুশ ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম)। বিশেষজ্ঞদের দাবি, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এটিএসিএমএসের আক্রমণ হতাহতের সংখ্যা কয়েক গুণ বৃদ্ধি করতে পারে। যদিও ওই দিনের হামলায় কত জনের মৃত্যু হয়েছে, তা জানা যায়নি।
চলতি বছরের অগস্টে রাশিয়ার পশ্চিমে কুর্স্ক এলাকায় ঢুকে পড়ে হাজার হাজার ইউক্রেনীয় সেনা। সীমান্ত পেরিয়ে প্রায় ৩০ কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে যায় তারা। জ়েলেনস্কি ফৌজের থেকে কুর্স্ককে মুক্ত করতে উত্তর কোরিয়ার সাহায্য নিচ্ছে মস্কো। দুই দেশের মধ্যে হওয়া প্রতিরক্ষা চুক্তি অনুযায়ী কয়েক হাজার সেনার বাহিনী ‘বাদামি ভালুকের দেশ’-এ পাঠিয়েছেন সেখানকার সুপ্রিম লিডার কিম জং-উন। তাদের দ্রুত কুর্স্ক রণাঙ্গনে ক্রেমলিন মোতায়েন করবে বলে সূত্র মারফত মিলেছে খবর।
কুর্সিতে বসেই যুদ্ধ থামানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ইউক্রেনকে কোনও ভাবেই নেটোতে যুক্ত করা হবে না বলে বিবৃতি দিয়েছেন তিনি। কিন্তু তার আগে যে ভাবে জ়েলেনস্কির হাতে মারাত্মক মারণাস্ত্র তুলে দিচ্ছেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বাইডেন, সেটা যে ট্রাম্পের শান্তি প্রতিষ্ঠার চিন্তাভাবনায় জল ঢালার শামিল, তা বলাই বাহুল্য।