সেরা: ৬৩ বলে ৯৭ করে ম্যাচের সেরা ধওয়ন। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
এ যেন ক্রিকেটের স্বর্গোদ্যানে বাঁ-হাতিদের রাজত্ব!
এক বাঁ-হাতি ম্যাচ জেতানো অপরাজিত ৯৭ করে গেলেন। এক বাঁ-হাতি জয়ের মঞ্চ গড়ে দিলেন ৩১ বলে ৪৬ করে। এক বাঁ-হাতি পীযূষ চাওলাকে লং অনের উপর দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে উইনিং শটটা নিলেন।
আর এক বাঁ-হাতি ডাগআউটে বসে তৃপ্তি ভরে দেখলেন তাঁর দল দিল্লি ক্যাপিটালস হারিয়ে দিয়ে গেল কলকাতা নাইট রাইডার্সকে।
কলিন ইনগ্রামের মারা শটটা গ্যালারিতে গিয়ে পড়তে হেলমেট খুলে দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন শিখর ধওয়ন। তিন রানের জন্য সেঞ্চুরি না পাওয়ার দুঃখটা তিনি নিশ্চয়ই ভুলে যেতে পারবেন। ইনগ্রাম যদিও সেঞ্চুরি না হওয়ায় দুঃখপ্রকাশ করে গেলেন ধওয়নের কাছে। ঋষভ পন্থ তখন ডাগআউট থেকে মাঠে নামার জন্য ছুটতে শুরু করেছেন।
কিন্তু চতুর্থ বাঁ-হাতি কী করছেন? টিভি ক্যামেরা জয়ের মুহূর্তে দিল্লির ডাগআউটের ছবিটা ধরল। দেখা গেল, রিকি পন্টিং জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। আর দিল্লির ‘দাদা’ মুঠো করে হাতটা একবার শুধু ঝাঁকালেন। চাপা চোয়ালে হাসি ফুটল না। কিন্তু তৃপ্তির ঝলকটা ঠিকই ধরা পড়ল।
শুক্রবারের এই বাঁ-হাতি রাজের দিনে কেকেআর তাদের সেরা অফস্পিনারকে পেল না। টসের সময়ই চমক। দেখা গেল, সুনীল নারাইনকে ছাড়াই দল নামাচ্ছে নাইটরা। ম্যাচের পরে নাইট অধিনায়ক দীনেশ কার্তিক এসে বলে গেলেন, হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটের জন্যই বাইরে রাখতে হয়েছে নারাইনকে। ছিলেন না ক্রিস লিনও।
নারাইন না থাকায় কেকেআরের বোলিং আক্রমণে কোনও ভেদশক্তিই দেখা যায়নি। বাঁ-হাতিদের উপরে সামান্য চাপ তৈরি করা যায়নি। ব্যাট করার সময় চোট পেয়েছিলেন আন্দ্রে রাসেল। বোলিংয়ে সেই ছন্দে পাওয়া যায়নি তাঁকে। আগের দিনই কুলদীপ যাদব বলেছিলেন, ইডেনের পিচে এখন স্পিনাররা সাহায্য পায় না। তিনি এবং পীযূষ— কাউকে দেখেই মনে হয়নি ম্যাচ জেতাতে পারেন! এই কেকেআর বোলিংকেই শাসন করে গেলেন ধওয়ন। দিল্লি জিতল সাত উইকেটে।
সানরাইজার্স হায়দরাবাদ থেকে এ বারই দিল্লিতে এসেছেন ধওয়ন। হায়দরাবাদ এই বছর যখন ছেড়ে দেয় ধওয়নকে, তখন অবাক হয়ে গিয়েছিল দিল্লি ম্যানেজমেন্ট। তাদের জনৈক কর্তাকে বলতেও শোনা যায়, ‘হায়দরাবাদ কেন ধওয়নকে ছেড়ে দিল, বুঝতে পারলাম না।’
হায়দরাবাদ দলের আনাচে কানাচে খোঁজ নিলে শোনা যায়, ধওয়নকে ছেড়ে দেওয়ার কারণটা নাকি এই বাঁ-হাতির প্রতি অসন্তুষ্টি। গত বার ডেভিড ওয়ার্নার শাস্তি পাওয়ার পরে ধওয়ন আশা করেছিলেন, হায়দরাবাদের অধিনায়কত্ব তিনিই পাবেন। কিন্তু সেটা না পাওয়ায় সমস্যার শুরু। সেখান থেকে দলত্যাগ। দিল্লিতেও ধওয়ন অধিনায়ক নন। কিন্তু নিজের শহরের হয়ে খেলতে তাঁর অন্তত কোনও সমস্যা হচ্ছে না।
ধওয়নের মধ্যে যদি সেই পরিচিত আগ্রাসন দেখা যায়, তবে আর এক বাঁ-হাতিকে পাওয়া গেল পুরো অন্য মেজাজে। ঋষভ পন্থ যেন শিখতে নেমেছিলেন, কী ভাবে ম্যাচ বার করতে হয়। কোনও তাড়াহুড়ো নয়, কোনও অযথা ঝুঁকি নিয়ে খেলা বড় শট নয়। ‘ছাত্র’ ঋষভ যেন সামনে দিল্লির জয়ের চেয়েও বড় কোনও লক্ষ্য রেখে ব্যাট করতে নেমেছিলেন। হয়তো সোমবার বিশ্বকাপ দল নির্বাচনের আগে জাতীয় নির্বাচকদের বোঝাতে চেয়েছিলেন, ‘আমি এখন অনেক পরিণত।’ ঋষভ আউট হলেন ৩১ বলে ৪৬ করে। দিল্লির জয়ের জন্য তখন ১৭ বলে ১৭ রান দরকার। দুই বাঁ-হাতির জুটিতে উঠেছে ৬৯ বলে ১০৫।
শুক্রবারের রাতে কুলদীপ যাদবকে মারা ঋষভের এক হাতের ছয়টা ইডেনকে বিহ্বল করে দিতে পারে, কিন্তু দর্শক এবং প্রেসবক্সকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল তাঁর কিপিংয়ের একটি মুহূর্ত।
কাগিসো রাবাডার বাউন্সার হুক করতে গিয়ে গ্লাভসে লাগিয়েছিলেন উথাপ্পা। বল সেকেন্ডের ভগ্নাংশে ঋষভের বাঁ পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। প্রেসবক্স থেকে দেখা গেল, নীল জার্সি পরা শরীরটা মাটি থেকে ছিটকে উঠে ক্যাচটা ধরে নিল। ইডেনের দর্শকদের মতো প্রেসবক্সও বিশ্বাস করতে পারছিল না ঋষভ ওই ক্যাচ ধরেছেন।
ব্যতিক্রম এক জন। তবে তিনি এখন কলকাতায় নেই। মুম্বইয়ে বসে টিভিতে তাঁর ‘ছাত্রের’ এই অবিশ্বাস্য ক্যাচ দেখলেন। এবং তার পরে ফোনে আনন্দবাজারকে কিরণ মোরে বলছিলেন, ‘‘আমি কিন্তু এতটুকু অবাক হইনি। ঋষভের কিছু ছোটখাটো টেকনিক্যাল জিনিস ঠিক করে দিয়েছি। ছেলেটা দারুণ পরিশ্রম করতে পারে। তার ফল পাওয়া যাচ্ছে। আগামী দশ বছরের জন্য ভারতীয় ক্রিকেটের সম্পদ হয়ে উঠবে ও।’’
নাইটদের হয়ে আবার সেই আন্দ্রে রাসেল ঝড় তুললেন ২১ বলে ৪৫ করে। মারলেন তিনটে চার, চারটে ছয়। তাঁর একটা স্ট্রেট ড্রাইভ নন স্ট্রাইকার এন্ডে দাঁড়ানো কার্লোস ব্রাথওয়েটের মুণ্ডু প্রায় নিয়ে যাচ্ছিল। ব্রাথওয়েট বেঁচে গেলেন, কিন্তু নাইটরা বাঁচল না। বোঝা গেল, রোজ রোজ একা রাসেল বাঁচাতে পারবেন না।
চেষ্টা করেছিলেন শুভমন গিলও। ম্যাচের ২৪ ঘণ্টা আগে নাইট কোচ জাক কালিস আনন্দবাজারকে বলেছিলেন, ‘‘শুভমন অবিশ্বাস্য। যে কোনও পরিস্থিতিতে খেলতে পারে।’’ এ দিন দেখা গেল, কালিস ঠিকই বলেছেন। সাত নম্বর থেকে একেবারে ওপেনে। এই তরুণ ব্যাটসম্যানের ৩৯ বলে ৬৫ রানের ইনিংসে পেশিশক্তির আস্ফালন নেই। রয়েছে ক্রিকেটীয় আভিজাত্যের ছাপ। যে ছাপ বলছে, তিনি কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে ফুটতে শুরু করেছেন। কিন্তু কেকেআর ব্যাটিংয়ের মিডল অর্ডার ফের ডুবিয়ে দিয়ে গেল দলকে।
ম্যাচ শেষ হয়ে গিয়েছে মিনিট কুড়ি হল। দর্শকশূন্য ইডেনে দেখা গেল একটা দৃশ্য। ধওয়ন তাঁর ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে। পাশে এসে দাঁড়ালেন তিনি। হাতটা রাখলেন ম্যাচের নায়কের কাঁধে। মুখে অনাবিল হাসি।
সাত বছর আগে পুণে ওয়ারিয়র্সের জার্সিতে এই কেকেআরের বিরুদ্ধেই হারের যন্ত্রণা নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে। সেই যন্ত্রণায় কিছুটা হয়তো প্রলেপ পড়ল ১২ এপ্রিলের রাতে।
দিল্লির চার বাঁ-হাতির মধ্যে সব চেয়ে খুশি বোধ হয় তিনিই। সেই চতুর্থ বাঁ-হাতির নাম? সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়!