করিম ও তাঁর সেরা অস্ত্র ওডাফা ওকোলি। -ফাইল চিত্র।
৩৪ বছর ধরে বয়ে বেড়ানো ক্ষতে প্রলেপ দিয়েছিলেন তিনি। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গলকে ৫ গোল ফিরিয়ে দিয়ে পঁচাত্তরের শিল্ড ফাইনালের মধুর প্রতিশোধ নিয়েছিল মোহনবাগান। তখন তাঁর হাতে সবুজ-মেরুনের রিমোট কন্ট্রোল। শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাবের বস হিসেবে টানা ১০ ম্যাচ জিতে ফিফার ওয়েবসাইটে নাম তুলে ফেলেছিলেন। সেই করিম বেনচারিফার কোচিংয়েই আবার ২০১২ সালে বিরতির পরে আর মাঠেই নামেনি মোহনবাগান। সালগাওকরকে এনে দিয়েছেন আই লিগ। এর পরেও ভারতীয় ফুটবলে তিনি নেই। শুক্রবার আইএসএল-এর প্রথম ডার্বিতে নামছে তাঁর পুরনো দল। একসময়ে তাঁর ক্ষুরধার মস্তিষ্ক অনেক ডার্বির ফলাফল গড়ে দিয়েছে। আজ বহু দূরে বসে তিনিও বাকিদের মতোই দর্শক। বহু প্রত্যাশিত ডার্বির আগে আনন্দবাজার ডিজিটালের কাছে ফেলে আসা দিনের স্মৃতিচারণ করলেন করিম বেনচারিফা।
এ দেশের ফুটবল ইতিহাসে করিম বেনচারিফার নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। ২০০৯ সালে আপনার কোচিংয়ে মোহনবাগান ৫-৩ গোলে হারিয়েছিল ইস্টবেঙ্গলকে। সেই ম্যাচের গুরুত্ব আপনার জীবনে কতটা?
আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এক জন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকের মন্তব্য বেশ মনে পড়ে যাচ্ছে। সেই সমর্থক আমাকে উদ্দেশ করে লিখেছিলেন, আমাদের হাত থেকে একাধিক ডার্বি এবং ট্রফি ছিনিয়ে নিয়েছিলেন করিম বেনচারিফা। তার মধ্যে রয়েছে ৫-৩-এর সেই ডার্বি। তরুণ একটা দল নিয়ে ডার্বি ম্যাচ ড্র করার পরে মোহনবাগানকে কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। ফেডারেশন কাপের সেমিফাইনালে ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে ফাইনালে তুলেছিলেন মোহনবাগানকে। তার পরে ডেম্পোকে ০-১ হারিয়ে চ্যাম্পিয়নও করেছিলেন। ৭০ হাজার ইস্টবেঙ্গল সমর্থকের সামনে ৩-১-এ ম্যাচ জিতে সালগাওকরকে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন আপনি। আই লিগে ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়া অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ইস্টবেঙ্গলকে ২-৩ গোলে হারিয়ে আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। এক জন ইস্টবেঙ্গল সমর্থক এ ভাবেই আমার কেরিয়ারকে মূল্যায়ণ করেছেন। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দলের এক জন সমর্থকের কাছ থেকে এই শ্রদ্ধা ও সম্মান অর্জন করে নেওয়া আমার কাছে বিশাল একটা জয় বলেই মনে হয়।
আইএসএল-এর প্রথম ডার্বি কাল। এক সময়ে বহু ডার্বিতে আপনি কোচিং করিয়েছেন। স্টেডিয়ামে আপনার নামে জয়ধ্বনি উঠত। এ বারের ডার্বিতে আপনি কাকে এগিয়ে রাখছেন?
খেলার মাধ্যমে মাঠেই জিতে নিতে হয় ডার্বি। খেলা না হলে বলা যায় না কে জিতবে এই ম্যাচ। আগে কে কী করেছে, তা দিয়ে এই ম্যাচের বিচার হয় না। প্লেয়ারদের উৎসাহ, আবেগকে যে দলের কোচ সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারবেন, সেই দলই মাঠে জয় ছিনিয়ে নেবে।
আরও পড়ুন: ডার্বির আগে অধিনায়কের নাম ঘোষণা করল এসসি ইস্টবেঙ্গল
কেরল ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে মোহনবাগানের প্রথম ম্যাচ নিশ্চয় দেখেছেন আপনি। শুক্রবার মোহনবাগানের ডাগ আউটে যদি আপনি বসতেন, তা হলে আপনার স্ট্র্যাটেজি কী হত? ডার্বির জন্য কী ভাবে প্রস্তুতি নিতেন?
আমি আগেই বলেছি, আবারও বলছি, ম্যাচের উপরে ফোকাস রাখতে হবে। আবেগ, উৎসাহ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ডার্বিতে অনেক অঙ্ক কষে খেলতে হয়। বিপক্ষের আসল প্লেয়ারকে মার্কিং করে তাঁকে অকেজো করে ফেলতে হয়। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত ম্যাচে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। ৯০ মিনিট ফিটনেস লেভেলের সেরা জায়গায় থাকতে হবে। অহেতুক কার্ড দেখলে চলবে না। ডার্বির জন্য দরকার দীর্ঘ দিনের প্রস্তুতি। এগুলোও প্রস্তুতির মধ্যেই পড়ে।
এডে চিডির পায়ে বল। বল কাড়তে উদ্যত মেহেরাজ।
মোহনবাগান বস হিসেবে দারুণ ধারাবাহিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। আপনার কোচিংয়ে টানা ১০টি ম্যাচ জিতে ফিফার ওয়েবসাইটে নাম উঠেছিল ক্লাবের।
ওই পর্বে টানা ১০টা ম্যাচ জিতেছিলাম আমরা। তার মধ্যে ৩টি ম্যাচ তো আবার ১০ জনে খেলে জিতেছিলাম। গোয়ার মাঠে গিয়ে ডেম্পোকে ১০ জনে খেলে হারানো খুব একটা সহজ ব্যাপার ছিল না। জয়কে অভ্যাসে পরিণত করতে হয়। আমার সময়ে সেটাই হয়েছিল।
করিম বেনচারিফা।
আপনার কোচিংয়ে সাফল্য এসে ধরা দিয়েছিল মোহনবাগানে। আবার আপনার সময়তেই কলঙ্কিত হয়েছিল মোহনবাগান। ৯ ডিসেম্বর, ২০১২ সালের ডার্বির কথা বলছি। নবি মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন। এক গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় বিরতির পরে আর মাঠে নামেনি মোহনবাগান। টাচলাইনের বাইরে দাঁড়িয়ে আপনাকে দেখতে হয়েছিল সেই দৃশ্য। সে দিনের কথা মনে পড়লে নিশ্চয় আফশোস হয় আপনার?
সে বারের ডার্বিতে বিরতির পরে দল আর খেলতে নামেনি। খুব কঠিন পরিস্থিতি ছিল। ইস্টবেঙ্গল দারুণ ফর্মে ছিল। সে দিন কোনও কিছুই ঠিকঠাক হচ্ছিল না আমাদের। নবি চোট পেয়ে গেল। ওডাফা লাল কার্ড দেখল। হাফটাইমে ম্যানেজমেন্ট স্থির করল আর মাঠে নামবে না।
ম্যাচ পুরো না খেলার পরিণাম হয়েছিল ভয়ঙ্কর। আপনাদের সব পয়েন্ট কেটে নেওয়া হয়েছিল। প্রায় শূন্য থেকে নতুন করে শুরু করতে হয়েছিল। এ দিকে অবনমনের খাঁড়া ঝুলছিল। কিন্তু আপনার কোচিংয়ে মোহনবাগান সেই অবনমনও বাঁচিয়ে ফেলে।
কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছিল আমাদের। মোটা অঙ্কের জরিমানা গুনতে হয়েছিল। আমাদের সব পয়েন্ট কেটে নেওয়া হয়েছিল। লিগ তালিকায় সবার শেষে নেমে গিয়েছিলাম আমরা। অবনমন বাঁচানোর জন্য লড়াই করতে হয়েছিল। সব চেয়ে ভাল দিক ছিল, ওই দুর্দিনে দল নিয়ে আমরা কলকাতার বাইরে চলে গিয়েছিলাম। দুর্গাপুরে থেকে আমরা পরের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। মিডিয়া, সমর্থকদের চাপ ছিল। সেই চাপ থেকে দূরে সরে থাকার জন্য আমরা কলকাতার বাইরে চলে গিয়েছিলাম। আগে কী ঘটেছিল, তা ভুলে গিয়ে নতুন উদ্যমে অনুশীলন শুরু করে দিয়েছিলাম। তার ফলাফলও হাতেনাতে পেয়েছিলাম। শূন্য পয়েন্ট নিয়ে খেলতে নেমেও আমরা অবিশ্বাস্য ভাবে অবনমন বাঁচিয়ে ফেলতে পেরেছিলাম। তাও আবার লিগ শেষ হওয়ার ৩ রাউন্ড আগেই। ওই মরসুমের কথা মনে পড়লে এখনও শিহরিত হই।
আরও পড়ুন: ‘এগিয়ে থাকবে ইস্টবেঙ্গল’, বলছেন ডার্বি থেকে বেঁচে ফেরা রহিম নবি
মোহনবাগানে আপনার কোচিং পর্ব ছিল বেশ উল্লেখযোগ্য। সালগাওকরকেও এনে দিয়েছেন সাফল্য। এত কিছুর পরেও কিন্তু আপনি এ দেশের ফুটবলে এখন আর নেই। অতীত হয়ে গিয়েছেন।
মিডিয়া এবং সমর্থকদের এই দিকটা ভেবে দেখার অনুরোধ করছি। আমি খুব জোর দিয়ে বলছি, কোনও বিদেশি বা স্থানীয় কোচেরও কিন্তু ধারাবাহিক ভাবে এমন সাফল্যের রেকর্ড নেই। আক্রমণাত্মক এবং দৃষ্টিনন্দন ফুটবল সমর্থকদের উপহার দিতে পেরেছিলাম বলেই মনে করি। নতুন তারকার উত্থান হয়েছিল আমার হাতে। যে ৪টি দলে কোচিং করিয়েছিলাম সর্বত্রই একই ভাবে কোচিং করিয়েছি। একই দর্শনে কোচিং করিয়েছি। সে দিক থেকে দেখলে আমি বলতেই পারি, আরও একটু সম্মান, শ্রদ্ধা প্রত্যাশা করেছিলাম। তবে খুব জোর দিয়ে বলছি, এক দিন আমি ফিরে আসবই। ভাগ্যের একটু সাহায্য পেলে আমি হয়তো তিনটি আই লিগও জিতে নিতে পারতাম। কিন্তু দিনের শেষে আমার নামের পাশে লেখা একটা আই লিগ ট্রফি আর ২ বার রানার্স। ভারতীয় ফুটবলে অনেক ট্রফি জিতলেও ডুরান্ড কাপ, আইএফএ শিল্ড ও ভূটানের কিংস কাপে রানার্স হয়েছিলাম। ওগুলোতেও চ্যাম্পিয়ন হতে পারতাম।