ত্রয়ী: ভাবিনা ও সুমিতের সঙ্গে মনোজের নিজস্বী। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
প্রতিকূলতাকে হারিয়ে টোকিয়ো প্যারালিম্পিক্সে নজির গড়েছেন ওঁরা ১৯ জন। কেউ পোলিয়ো আক্রান্ত, কেউ বা ছোটবেলায় কোনও দুর্ঘটনা বা অসুখে ভুগে অঙ্গহানি বা অঙ্গবিকৃতির শিকার। কিন্তু বিশেষ ভাবে সক্ষম ভারতের এই ক্রীড়াবিদরা নিজেদের স্বপ্নকে ব্যাহত হতে দেননি।
টোকিয়ো থেকে পাঁচটি সোনা, আটটি রুপো ও ছ’টি ব্রোঞ্জ-সহ ১৯টি পদক নিয়ে গত অগস্ট-সেপ্টেম্বরে ভারতে ফিরেছিলেন সেই সুমিত আন্তিল, ভাবিনাবেন পটেল, মনোজ সরকারেরা। যাঁদের কঠোর জীবন-সংগ্রামে জয়ী হয়ে পদক জয়ের গল্প এখন গোটা ভারত জানে। কিন্তু এই সাফল্যেও আত্মতুষ্ট হতে চান না তাঁরা। বৃহস্পতিবার ঝটিকা সফরে কলকাতায় ঘুরে গেলেন তাঁরা। যাঁর মধ্যে এই তিন জন ছাড়াও রয়েছেন, তিরন্দাজিতে ব্রোঞ্জ প্রাপ্ত হরবিন্দর সিংহ, সর্বকনিষ্ঠ প্যারা-ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় পালক কোহলি, হাই জাম্পে ব্রোঞ্জ প্রাপ্ত শরদ কুমার এবং রুপো প্রাপ্ত মারিয়াপ্পান থাঙ্গাভেলু, প্রবীণ কুমার ও নিষাদ কুমার, ডিসকাস থ্রো-তে রুপো প্রাপ্ত যোগেশ কাঠুনিয়া, জ্যাভলিনের দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়ারা। একটি বেসরকারি সংস্থা আয়োজিত, ‘উই আর দ্য উইনার’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে রাজারহাটের এক পাঁচতারা হোটেলে রাতে সংবর্ধনাও দেওয়া হল তাঁদের। ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত থাকায় আসতে পারেননি শুটিংয়ে সোনা-সহ ব্রোঞ্জ জয়ী অবনী লেখারা-সহ বাকি পদকজয়ীরা।
জ্যাভলিনে সোনাজয়ী সুমিত বলছেন, ‘‘পরের বারেও সোনা পেতে হবে।’’ রুপোর পদক প্রাপ্ত প্যারা-টেবল টেনিস খেলোয়াড় ভাবিনাবেনের কথায়, ‘‘টোকিয়োর অধ্যায় অতীত। এ বার আগামী বছরের প্যারা-এশিয়ান গেমস থেকে সোনা নিয়ে ফেরার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছি।’’ আর উত্তরাখণ্ডের বাসিন্দা প্যারালিম্পিক্সে ব্রোঞ্জ-প্রাপ্ত প্রবাসী বাঙালি ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় মনোজ সরকার বলছেন, ‘‘টোকিয়োয় পদক পাওয়ার পরে দেশের প্রধানমন্ত্রী, পুলেল্লা গোপীচন্দেরা ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। সেটাই ২০২২ সালে আরও আন্তর্জাতিক খেতাব জয়ের ইচ্ছা বাড়িয়ে দিয়েছে।’’
যা দেখে অনুষ্ঠানে হাজির রাজ্যের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মনোজ তিওয়ারি বলছেন, ‘‘মহেন্দ্র সিংহ ধোনির উঠে আসা যেমন চিত্তাকর্ষক ঘটনা, তেমনই এই ক্রীড়াবিদদের সাফল্যও অর্জনও সমান আকর্ষণীয়।’’ যোগ করেন, ‘‘আমাদের রাজ্যও বিশেষ ভাবে সক্ষম ক্রীড়াবিদদের তুলে আনতে বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়েছে। আশা করছি, এই পদকজয়ীদের দলে পরবর্তী প্যারালিম্পিক্সে পশ্চিমবঙ্গ থেকেও পদকজয়ী পাব আমরা।’’
১৯৬৮-২০১৬ সাল—এই ৪৮ বছরে প্যারালিম্পিক্সে ভারত পেয়েছিল চারটি সোনা, চারটি রুপো ও চারটি ব্রোঞ্চ। এ বার টোকিয়োতে ১৯টি পদক জিতে ২৪তম স্থানে শেষ করেছে ভারত। যা অনেকটাই বদলে দিয়েছে এই ক্রীড়াবিদদের জীবন। হরিয়ানার সুমিত বলেন, ‘‘নীরজভাই (চোপড়া) এ বার অ্যাথলেটিক্সে (জ্যাভলিন) প্রথম সোনা জিতে আত্মবিশ্বাসটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমার মনে জোর এসেছিল আমিও পারব। আমি যে বিশ্বের তিন নম্বর। ৩০ অগস্ট সোনা জেতার পরে নীরজভাই প্রথম ফোনটা করেছিল আমায় টোকিয়োতে। তখন কেঁদে ফেলেছিলাম।’’ যোগ করেন, ‘‘এ বার টোকিয়ো থেকে ফেরার পরে নিজেকে তারকা মনে হচ্ছে। বিরাট কোহলি স্যর, ভিকি কৌশল স্যরেরা ব্যক্তিগত ভাবে মোবাইল বার্তা পাঠিয়েছিলেন। বিমানবন্দরে দেখলে লোকে অটোগ্রাফ চাইছে। মনে হয়, স্বপ্ন দেখছি না তো! টোকিয়োতে ফাইনালে নামার আগের সকালে গণমাধ্যমে আমাকে ৩০০ জন ফলো করতেন। বিশ্ব রেকর্ড গড়ে সোনা জেতার পরে এক দিনে তা ৩০ হাজার হয়ে গিয়েছিল। ২০২৪ সালে ভারত প্রথম দশে থাকবেই।’’
রুপোর পদকপ্রাপ্ত রসিক ভাবিনাবেন বলছেন, ‘‘কলকাতা দেখা ও রসগোল্লা খাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। আজ সকালে পেট পুরে রসগোল্লা খেলাম।’’ যোগ করেন, ‘‘এই বছরে প্যারালিম্পিক্সে ভারতের প্রথম পদক এনেছিলাম আমিই। সে দিন রাতেই সচিন তেন্ডুলকর ফোন করে তাঁর বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণে ডেকেছিলেন। পদকের পাশাপাশি ওটাও আমার কাছে বিশেষ সম্মান।’’
নৈনিতালে বড় হওয়া বাঙালি মনোজ সরকার বলে দেন, ‘‘কলকাতা এলে দারুণ লাগে। এই শহর ক্রীড়াবিদদের প্রকৃত সম্মান দেয়। আগামী বছর ১১টা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা রয়েছে। সেগুলো থেকেও পদক আনতে হবে। তার জন্য রোজ সাত ঘণ্টা করে খাটছি।’’
সফল এই ক্রীড়াবিদদের কীর্তিতে নতুন স্বপ্ন দেখছেন ভারতের প্যারালিম্পিক্স সংস্থার সচিব গুরশরণ সিংহও। তিনি বলছেন, ‘‘প্যারালিম্পিক্স নিয়ে ভারতের আগ্রহ বেড়েছে। প্যারিস থেকে ২০২৪ সালে ১০টি সোনা-সহ ২৫ পদক এ বার লক্ষ্য আমাদের। তা হলেই প্রথম ১৫টি দেশের মধ্যে চলে আসব আমরা।’’