হুঙ্কার: বুমরার বিষাক্ত রিভার্স সুইংয়ে বিধ্বস্ত ইংল্যান্ড। ফাইল চিত্র ফাইল চিত্র
রিভার্স সুইং শিল্পের আবিষ্কর্তাও মুগ্ধ যশপ্রীত বুমরার ওভাল জাদুতে। তিনি— প্রাক্তন পাক পেসার সরফরাজ় নওয়াজ়। এখনকার পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে রিভার্স সুইং শেখানো মহাগুরু। সেই রিভার্স সুইংয়ের জনক সরফরাজ় লন্ডনের ফ্ল্যাট থেকে ফোনে মঙ্গলবার বলে দিলেন, ‘‘মাঠে যেতে পারিনি। কিন্তু টিভিতে শেষ দিনের খেলা পুরো দেখেছি। মন ভরিয়ে দিয়েছে আপনাদের যশপ্রীত বুমরা। দুর্দান্ত রিভার্স সুইং দেখলাম। লাঞ্চের পরে বুমরার স্পেলটাই ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়ে গেল।’’
সহজ হয়ে আসা ওভালের পিচে ইংল্যান্ডের তরী নিরাপদেই এগোচ্ছিল। দিনের শুরুতে ইংল্যান্ডের সমর্থকেরা আশা করছিলেন, তাঁরা এই টেস্ট জিতবেন। লাঞ্চের পরে রিভার্স শুরু হতেই অধিনায়ক বিরাট কোহালির কাছ থেকে নিজে বল চেয়ে নেন বুমরা। বাকিটা ক্রিকেট রূপকথায় স্থান করে নিচ্ছে। পর-পর দু’ওভারে দুই উইকেট তুলে ম্যাচের রং পাল্টে দেন তিনি। সরফরাজ় যা দেখে উচ্ছ্বসিত, ‘‘রিভার্স একটা শিল্প। ওভালের শেষ দিনে সেই শিল্পের প্রদর্শনী দেখলাম বুমরার হাতে। ওয়াসিম, ওয়াকারদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল ও।’’ এর পরেই আবেগপ্রবণ হয়ে বলে ফেললেন, ‘‘আমি খুব খুশি হয়েছি ভারতের জয় দেখে আর ভারতীয় বোলারদের রিভার্স সুইং সাফল্য দেখে। ভারতে আমার অনেক বন্ধু। এখনও কত ফোন পাই। এত বছরের পারস্পরিক টান কোথায় যাবে!’’ কে বলল, ভারত-পাক মানে শুধুই মাঠের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর শিঙা ফোঁকাফুঁকি? ওয়াসিম আক্রম যেমন কলকাতা নাইট রাইডার্সের বোলিং কোচ থাকার সময় মহম্মদ শামিকে রিভার্সের মন্ত্র শিখিয়ে গিয়েছেন, তেমনই বুমরাদের সাফল্যে সরফরাজ় নওয়াজ়ের গলাতেও বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস! কলকাতা থেকে ফোন যাওয়ায় যোগ করলেন, ‘‘বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভকে আমার শুভেচ্ছা জানাবেন। ভারতীয় ক্রিকেটে প্রচুর অবদান সৌরভের। আর সবচেয়ে ভাল লাগে যে, এক জন ক্রিকেটার বোর্ডের প্রধান হয়েছে, তাতে খেলা এবং খেলোয়াড়েরা প্রাধান্য পাবে।’’
বুমরা কেন রিভার্স সুইংয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেন? সরফরাজ়ের বিশ্লেষণ, ‘‘বুমরার অন্য রকম অ্যাকশনের জন্য রিভার্স করাতে সুবিধা হবে। ওয়াকার রিভার্স করার সময় অন্য রকম ডেলিভারিতে বল করত। হাত, কব্জিকে আরও বেশি ব্যবহার করত। তাতে আরও বেশি গতি, আরও লেট সুইং পেত। বুমরার অ্যাকশনের জন্য রিভার্সের সময় সেটা আপনা-আপনিই হবে।’’ আর বুম বুম ইয়র্কার? বরাবর আক্রম-ওয়াকারেরা এই ব্রহ্মাস্ত্রে ব্যাটসম্যানদের ঘায়েল করেছেন। এখন এক ভারতীয় পেসার ইয়র্কারে ব্যাটসম্যানদের রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছেন। ‘‘অসাধারণ! বুমরার ইয়র্কারের বিশেষত্ব হচ্ছে, একদম উইকেটের নীচে গোঁত্তা খেয়ে এসে আছড়ে পড়ে। যে-হেতু দুরন্ত গতিও রয়েছে, ব্যাটসম্যানের পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যায়,’’ বলে চলেন সরফরাজ়, ‘‘আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে, অক্লান্ত ভাবে ছেলেটার উইকেটের মধ্যে বল রেখে যাওয়ার অভ্যাস এবং মাথা খাটিয়ে বল করার প্রবণতা। সব বল ব্যাটসম্যানকে খেলতে বাধ্য করছে। এ রকম বোলার যে কোনও দলের জন্য সম্পদ।’’
ভারতের এই পেস বোলিংকে বিশ্বের সেরা হিসেবে মানতে দ্বিধা নেই সরফরাজ়ের। ‘‘অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের গতি বেশি। নিউজ়িল্যান্ডের সুইং আছে। কিন্তু ভারতের পেসারেরা অনেক বেশি কার্যকরী। বিশ্বের সর্বত্র ওরা সফল। দলের বড় বড় সব জয় বোলারদের এনে দেওয়া।’’ যোগ করলেন, ‘‘টোটাল ফুটবলের মতো টোটাল বোলিংয়ের উদাহরণ রাখছে ওরা। যেমন গতি, তেমন সুইং, তেমনই রিভার্স সুইং। কী নেই ওদের হাতে! বুমরাকে দেখুন। কী অসাধারণ বৈচিত্র! টেস্টে স্লোয়ারেও উইকেট নিচ্ছে।’’
সরফরাজ় নওয়াজ় ফাইল চিত্র
একটা সময় ছিল যখন পাক বোলারদের হাতে ছিল রিভার্সের ক্ষেপণাস্ত্র। ভারত ছিল স্পিনের দেশ। কপিল দেবের আবির্ভাবে পেস বোলিংকে দুয়োরানির সন্তান করে রাখার প্রবণতা কিছুটা কমলেও পুরোপুরি যায়নি। এখন যদিও ছবিটা আমূল বদলে গিয়েছে। আর অশ্বিনের মতো স্পিনারকে বসিয়ে ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা ইমরান খানের পাকিস্তানের মতো ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহালিও চার পেসারে রণসজ্জা তৈরি করছেন। এই পেস বিপ্লব দেখে কী মনে হয়? সরফরাজ়ের জবাব, ‘‘ভারতে স্পিনারদের প্রভাব কমছে কারণ পেসারদের হাতে রিভার্স সুইং এসে গিয়েছে। এখন ভারতীয়রাই সব চেয়ে ভাল রিভার্স করাচ্ছে। তাই বল পুরনো হয়ে গেলেও স্পিনার নয়, পেসারদের উপরেই ভরসা রাখছে অধিনায়ক।’’
আরও একটা কথা তাঁর মনে হচ্ছে, ‘‘ভারতের পেসারেরা এখন শারীরিক ভাবেও অনেক বেশি শক্তিশালী। বোঝাই যাচ্ছে, জোরে বোলিংয়ের উপযুক্ত শরীরও তৈরি করার উপর জোর দিচ্ছে ওরা।’’ হাসতে হাসতে বলে ওঠেন, ‘‘আগের মতো রোগাপাতলা মিডিয়াম পেসার আর ভারতীয় দলে দেখি না!’’ যোগ করছেন, ‘‘শামিও রিভার্স দারুণ রপ্ত করেছে। নতুন বলেও ভাল সুইং করায়। খুবই উচ্চ মানের বোলার। ওরা প্রত্যেকেই এখন রিভার্স করাতে পারে।’’ মহম্মদ সিরাজকে দেখেও ভাল লেগেছে তাঁর। তবে তাঁর পরামর্শ, ‘‘সিরাজকে আরও ব্যাটসম্যানকে খেলানোর অভ্যাস তৈরি করতে হবে। বুমরাকে দেখে শেখা উচিত, কী করে বল নষ্ট করতে নেই।’’ দিল্লিতে পেস বোলিং ক্লিনিকে এসে ১৮ বছরের ইশান্তকে তিনি রিভার্স সুইং মন্ত্র শিখিয়েছিলেন। বললেন, ‘‘তরুণ ইশান্তকে দেখে দিল্লি কর্তাদের বলেছিলাম, এই ছেলে ভারতের হয়ে খেলবেই। কয়েক মাস পরেই অস্ট্রেলিয়া গিয়ে রিকি পন্টিংকে নাচিয়ে দিল।’’
পাকিস্তানে এক দিন নেটে পুরনো বল দিয়ে বোলিং করার সময় সরফরাজ় হঠাৎই আবিষ্কার করেছিলেন, সাধারণ সুইংয়ে যে দিকে বল বাঁক নেয়, এক্ষেত্রে তার উল্টোটা হচ্ছে। উৎসুক হয়ে তিনি ভাল করে বলটা পালিশ করতে থাকেন এবং দেখেন, আরও গতিতে একই চমক ঘটে চলেছে। এবং, অনেক দেরিতে বল সুইং হচ্ছে। ধুরন্ধর পাক পেসার বুঝে যান, সুইংয়ের নতুন ‘ট্রেজ়ার আইল্যান্ড’-এর খোঁজ পেয়েছেন। ‘‘এখনও মনে আছে, সে দিনটার কথা। আউটসুইং করাতে গিয়েছিলাম। বলটা ইনকাটার হয়ে গেল,’’ স্মৃতিচারণ করছিলেন সরফরাজ়।
সেই ছিল প্রথম চকমকি পাথরে ঠোকাঠুকি করে রিভার্স সুইংয়ের আগুন জ্বালিয়ে তোলা। বল উল্টো দিকে সুইং করে বলেই নামকরণ হয় রিভার্স। সরফরাজ় এর পরে ম্যাচে এই দাওয়াই প্রয়োগ করেন, যা দেখতে পেয়ে ইমরান ছুটে আসেন নতুন কৌশল রপ্ত করার জন্য। ‘‘ইমরানকে আমি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে শিখিয়ে দিয়েছিলাম। ও তার পরে ওয়াসিম, ওয়াকারকে শেখায়।’’ লাহৌরের নেটে সে দিন জ্বলে ওঠা আগুনে এখন প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করছেন স্পিনের দেশ বলে পরিচিত ভারতের
এক্সপ্রেস বোলাররা।
ক্রিকেট, সুন্দর ক্রিকেট— আপন স্রোতে বয়ে চলে যে! সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়াকে পাত্তা দেওয়ার তার কী দায় ঠেকেছে!