থঙ্গরাসু নটরাজন এক বার বলছিলেন, ‘‘ওভারের ৬টা বলই আমি ইয়র্কার দিতে পারি।’’ জীবনের প্রথম ওয়ান ডে-তেই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তাক লাগানো পারফরম্যান্সে তিনি এখন ভারতীয় ক্রিকেটের আকর্ষণের নতুন কেন্দ্র। অথচ কৈশোর অবধি জানতেনই না আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট বল ঠিক কী রকম দেখতে! তামিলনাড়ুর সালেম থেকে ৩৬ কিমি দূরে প্রত্যন্ত গ্রাম চিন্নাপ্পমপট্টি থেকে ক্যানবেরার ভৌগোলিক দূরত্বও ম্লান হয়ে যায় তাঁর জীবনের বন্ধুর যাত্রাপথের কাছে।
বাবা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করা গ্রামবাসী। কখনও কারখানায় ঠিকা কাজ করছেন। সেটা না থাকলে স্টেশনে গিয়ে মালবাহক হয়ে মোট বয়েছেন। রাস্তার ধারে বসে মা মুরগি বিক্রি করেন। কখনও কখনও চটজলদি মুখরোচক খাবারও সাজিয়ে বসেন। তাঁদের দু’জনের সামান্য উপার্জনের দিকে তাকিয়ে ঘরে অপেক্ষা করে থাকে পাঁচটি খুদে মুখ। সব সময় ভাল করে দু’বেলা খাবারও জুটত না। এই পরিবারেই নটরাজনের জন্ম ১৯৯১ সালের ২৭ মে।
ভর্তি হয়েছিলেন গ্রামের স্কুলে। এমনই আর্থিক অবস্থা, বইখাতা বা পেনসিল কেনাটাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ত। তার মধ্যে ৫ বছর বয়স থেকে শুরু হল ক্রিকেট খেলা। টেনিস বল দিয়ে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শানিত হল তাঁর বোলিং দক্ষতা। ধীরে ধীরে ডাক পেতে লাগলেন স্থানীয় টুর্নামেন্টে। কিন্তু যোগ দেবেন কী করে! না আছে ভাল জামা, না বোলিং করার উপযুক্ত জুতো। এমনকি, খেলতে যাওয়ার পয়সাও থাকত না।
সে রকম এক প্রতিযোগিতায় নটরাজনকে চোখে পড়েছিল জয়প্রকাশের। তিনি ছিলেন তাঁদের প্রতিবেশী। বুঝেছিলেন এই প্রতিভাকে ঘষামাজা করলে আরও সুদূরপ্রসারী হবে ইয়র্কারের বিষ। ক্রিকেটে নটরাজনের সম্ভাবনা নিয়ে তাঁর বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলেন জয়প্রকাশ। জয়প্রকাশের উপরেই ছেলের ভার ছেড়ে দেন তাঁরা। সে দিন থেকে জয়প্রকাশকে নিজের গডফাদার বলে বিশ্বাস করেন নটরাজন।
তিনি প্রথম নজরে আসেন তামিলনাড়ু ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের চতুর্থ ডিভিশনে বিএসএনএল-এর হয়ে খেলে। গ্রামের ধুলোয় টেনিস বলে ক্রিকেট খেলতে শুরু করা নটরাজনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল তামিলনাড়ুর হয়ে খেলা। সেই স্বপ্ন পূরণ হয় ২০১৪ সালে। তিনি সুযোগ পান রঞ্জি দলে।
এর পর আন্তঃরাজ্য টি-২০, বিজয় হজারে ট্রফি এবং তামিলনাড়ু প্রিমিয়ার লিগে ডিন্ডিগুল ড্রাগনস-এর হয়ে খেলার দিনগুলি পেরিয়ে অবশেষে আইপিএল-এর ময়দান। তার পর অভিষেক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। কিন্তু এক সময় মনে হয়েছিল এটা অসম্ভব। যখন বোলিং অ্যাকশনের জন্য ‘চাকার’ পরিচয় হয়েছিল নটরাজনের।
বিসিসিআই-এর কাছ থেকে ‘চাকার’ তকমা পেয়ে এক বছর ক্রিকেট থেকে দূরে থাকতে হয়েচিল নটরাজনকে। বহু পরিশ্রমে আবা ফিরে এসেছিলেন বাইশ গজে। মাঠের বাইরে থাকার সময়টুকু তাঁকে আগলে নিয়ে রেখেছিলেন জয়প্রকাশ। কখনও মনোবল ভেঙে পড়তে দেননি। তাঁর কাছে এই ভোকাল টনিকের গুরুত্ব অপরিসীম। জানিয়েছেন নটরাজন। পাশাপাশি, তাঁর বোলিং অ্যাকশন শুধরে দেওয়ার জন্য তিনি কৃতজ্ঞ প্রাক্তন ক্রিকেটার সুনীল সুব্রমানিয়ন, ডি বাসু এবং এম ভেঙ্কটরামনের কাছে।
২০১৭ সালের আইপিএলে নটরাজনকে নিলামে ৩ কোটি টাকায় কিনে নেয় কিংস ইলেভেন পঞ্জাব। পরে মরশুমে তিনি খেলেন সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে। আইপিএল-এ সুযোগ পাওয়ার পরে নটরাজনের পরিবারে রাতারাতি আর্থিক দিক থেকে অভাবনীয় পরিবর্তন হয়।
চলতি বছরেই তিনি প্রথম সুযোগ পান জাতীয় দলে। ২ ডিসেম্বর ক্যানবেরায় অভিষেক জীবনের প্রথম ওয়ান ডে ম্যাচে। অস্ট্রেলিয়ার মার্নাস লাবুশানে হয়ে থাকলেন তাঁর প্রথম আন্তর্জাতিক উইকেট।
জীবনে ছোট ছোট লক্ষ্য রেখে চলতে ভালবাসেন নটরাজন। আপাতত তাঁর ইচ্ছে দুই বোনের বিয়ে দেওয়া। বড় বোনের বিয়ে ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে।
ভাইয়ের লেখাপড়াও যাতে নির্বিঘ্নে সম্পূর্ণ হয়, সে খেয়ালও রেখেছেন। ভাইয়ের সঙ্গে মিলে অনেক দিনের স্বপ্ন পূরণ করেছেন। গ্রামে ক্রিকেট অ্যাকাডেমি খুলেছেন। সেখানে বিনামূল্যে ক্রিকেট শেখে আরও অনেক নটরাজন।
আরও একটা লক্ষ্য আছে। সেটা ঠিক করে দিয়েছিলেন বীরেন্দ্র সহবাগ। বলেছিলেন হিন্দি রপ্ত করতে। বোলিং অ্যাকশন আরও নিখুঁত করার পাশাপাশি হিন্দিও অনুশীলন করে চলেছেন নটরাজন।
কোনও এক সময় যখন খেলতে যেতেন, উদ্যোক্তাদের কাছে জুতো চাইতেন। কারণ ভাল জুতো কেনার পয়সা ছিল না। এখন তিনি কোটিপতি। তবে এখনও প্রত্যেক জোড়া জুতোকে খুব যত্ন করে রাখেন নটরাজন।
খ্যাতির আলোকবৃত্তে এসেও ভুলতে চান না নিদারুণ অতীতকে। তাই আইপিএল-এ তাঁর জার্সিতে নামের জায়গায় থাকত ‘জে পি নাট্টু’। অর্থাৎ জয়প্রকাশ নাট্টু। এ ভাবেই তিনি কুর্নিশ জানিয়েছেন নিজের গডফাদারকে। যিনি না থাকলে হয়তো নটরাজনের ইয়র্কার নির্বিষ হয়ে হারিয়ে যেত গ্রামের আলপথে। নটরাজনের হাতের উল্কিতেও লেখা ‘জে পি’।
আরও এক জনের কাছে কৃতজ্ঞ নটরাজন। তিনি তাঁর অর্ধাঙ্গিনী, প্রতিভা। জীবনের অমসৃণ মুহূর্তগুলোয় তিনি নটরাজনের পাশে ছিলেন মানসিক ভরসার অন্যতম উৎস হয়ে।
অতিমারির বছর হলেও ২০২০ নটরাজনের কাছে ভাল বার্তাবাহক হয়েই থাকল। শুধু জাতীয় দলে সুযোগই নয়। এ বছর তিনি পেয়েছেন পিতৃত্বের স্বাদও। আইপিএল চলাকালীন কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছেন প্রতিভা। নটরাজনকে অবশ্য ভিডিয়োতেই সদ্যোজাতকে দেখে খুশি থাকতে হয়েছিল। তিনি সে সময় ব্যস্ত ছিলেন সানরাইজার্সের হয়ে খেলায়।
অস্ট্রেলিয়া উড়ে যাওয়ার আগে মানতস্বরূপ দাড়ি রেখেছিলেন নটরাজন। সেই দাড়ি বিসর্জন দিয়ে মন্দিরে পুজো উৎসর্গ করার পরেই অস্ট্রেলিয়ার বিমানে পা রেখেছেন নটরাজন। আরও অনেক উড়ান ভবিষ্যতে অপেক্ষা করে আছে তাঁর জন্য।