ত্রিমূর্তি: রবিবার নেটে রোহিত (মাঝখানে) ও রাহুল (বাঁ দিকে)। এ দিন অনুশীলনে না-থাকলেও লড়াইয়ে আছেন ধওয়ন(ডান দিকে)। পিটিআই, ফাইল চিত্র
কলকাতার সকালে হাড়কাঁপানো শীতে ঘুম ভাঙছে আর মুম্বইয়ে যেন গরমকাল। কলকাতায় ১১ ডিগ্রি, মুম্বইয়ে ২২। কলকাতায় ওয়ার্মার লাগলে, এখানে হাফ সোয়েটার গায়ে রাখারও উপায় নেই।
শিখর ধওয়নের অবশ্য মার্ক টোয়েনের মতো মনে হতে পারে। শীতলতম দিন আমি দেখেছিলাম সানফ্রান্সিসকোর এক গ্রীষ্মে— বলেছিলেন টোয়েন। মাঝ জানুয়ারি ঠিক গ্রীষ্মকাল না হলেও ২২ ডিগ্রি তাপমাত্রাতেও আরব সাগরের পারে শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে ধওয়নের জীবনে। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এমন মারমার-কাটকাট ওয়ান ডে সিরিজ হতে যাচ্ছে। আর প্রথম ম্যাচে রোহিত শর্মার সঙ্গী কে হবেন, সেই দৌড়ে ‘গব্বর’ কিনা দু’নম্বরে। এক নম্বরে উঠে এসেছেন তাঁর অনুপস্থিতিতে টিম ম্যানেজমেন্টের মন জিতে নেওয়া কে এল রাহুল।
বিশ্বকাপে আঙুল ভেঙেছিল ধওয়নের। এ বার হৃদয় ভাঙতে পারে। তা-ও কিনা হালফিলে দেশের মাঠে সব চেয়ে ব্লকবাস্টার সিরিজে! অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরাও মানছেন, এমন পূর্ণ শক্তির অস্ট্রেলিয়া বহু দিন পঞ্চাশ ওভারের ওয়ান ডে ক্রিকেটে দেখা যায়নি। তেমনই ওয়াংখেড়েতে নিজস্বী নিতে ভিড় করা ভারতীয় ভক্তদের কথাবার্তা শুনে মনে হল, অনেক কাল পরে সত্যিকারের জেমিনি সার্কাস এসেছে শহরে। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কায় কী আর মন ভরে! চলো, চলো, দেখবে চলো।
সত্যিই তো! বিশ্বের সেরা সব ক্রিকেটার রয়েছে দু’দলে। স্টিভ স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার ফিরে এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে বিরাট কোহালি, রোহিত শর্মার ভারতীয় যুগলের দ্বৈরথ ক্রিকেট ভক্তদের জিভে জল এনে দিতে বাধ্য। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট আকাশে নতুন তারা হিসেবে উদয় ঘটেছে মার্নাস লাবুশানের। শেষ পাঁচটি টেস্টে চারটি সেঞ্চুরি করে এসেছেন। তার মধ্যে একটি ডাবল সেঞ্চুরি। কোহালিদের দলে তেমনই আছেন শ্রেয়স আইয়ার, ঋষভ পন্থের মতো তরুণরা।
আরও পড়ুন: শিশির মাপতে ওয়াংখেড়েতে অস্ট্রেলীয় কোচের নৈশ অভিযান
এখানেই শেষ নয়। বিশ্বের সেরা দুই বোলিং শক্তির ঝনঝনানিও দেখা যাবে। অস্ট্রেলিয়ার হাতে প্যাট কামিন্স, জশ হেজলউড, মিচেল স্টার্ক, কেন রিচার্ডসন— চার জনের পেস ব্যাটারি। স্পিনার অ্যাডাম জাম্পা, অ্যাশটন অ্যাগার। ভারতের দিকে যশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ শামি, শার্দুল ঠাকুর এবং গতির আগুনে চমকে দেওয়া নতুন মুখ নবদীপ সাইনি। স্পিনার কুলদীপ যাদব, রবীন্দ্র জাডেজা, যুজবেন্দ্র চহাল। এটা যদি মহারণ না হয়, কোনটা মহারণ!
আরও পড়ুন: এ বার বলিউডে চাকদহের রূপকথা
রবিবার দুপুরের দিকে ওয়াংখেড়েতে ঢুকে দেখা গেল, ভারতের ঐচ্ছিক অনুশীলন চলছে। তা বলে ওয়াংখেড়ে সংলগ্ন মেরিন ড্রাইভে ঘুরে বেড়ানোর মেজাজের চিহ্ন নেই। ছ’জন অনুশীলনে এসেছেন। রাহুল আছেন, ধওয়ন নেই। ওয়াংখেড়ের পিচ রিপোর্ট নিয়ে যা পূর্বাভাস, ফের ব্যাটসম্যানদের স্বর্গ আর বোলারদের আতঙ্ক হতে যাচ্ছে। ভারতীয় দলের অন্দরমহলেও দু’টো বিষয় নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। টস কি ম্যাচের অন্যতম প্রধান নির্ধারক হয়ে দাঁড়াতে পারে? এবং রাতের দিকে শিশিরের প্রভাব কতটা থাকতে পারে? রাহুলকে তার মধ্যেই দেখা গেল বড় শট মারার মহড়া দিয়ে চলেছেন। নেটের পিছনে চেয়ার নিয়ে বসা হেড কোচ রবি শাস্ত্রী। পাশে বোলিং কোচ বি অরুণ। নজর রাখছেন ব্যাটিং কোচ বিক্রম রাঠৌর। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, রাহুল প্রায় দলে ঢুকেই পড়েছেন।
প্র্যাক্টিসের এই ভিডিয়ো শিখরকে দেখানো হলে, তিনি বলে উঠতেই পারেন, কত দ্রুতই না সব অঙ্ক পাল্টে যায়! অস্ট্রেলিয়া এবং তিনি— ক্রিকেট ও জীবনের বাইশ গজে এতকাল মধুচন্দ্রিমার মতোই কেটেছে। মেলবোর্ন-নিবাসী আয়েশাকে বিয়ে করেন। সেখানে এখনও শ্বশুরবাড়ি তাঁর। মোহালিতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ সেঞ্চুরি দিয়ে টেস্ট অভিষেক। এ বারও বিশ্বকাপে ভাঙা আঙুল নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরি করেন। ওই ম্যাচেই আঙুল ভেঙে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যান শিখর। সেই যে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখা দিতে শুরু করল, আর রোদ্দুরই উঠছে না! শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক টি-টোয়েন্টি সিরিজে ফিরে রান করলেন, কিন্তু রাহুল যে আরও বেশি রান করে দিয়ে বসে আছেন!
এমনও ইঙ্গিতও পাওয়া গিয়েছে যে, সামনের দিকে তাকিয়ে রাহুলের কথাই সম্ভবত বেশি করে ভাবছে দল পরিচালন সমিতি। এ বছরের অক্টোবর-নভেম্বরে অস্ট্রেলিয়ায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। সেখানে নিশ্চিত রাহুল, অনিশ্চিত ধওয়ন। আবার তথ্যাভিজ্ঞ মহলের মত, ধওয়নের প্রতি সমর্থন রয়েছে ভারতীয় বোর্ডের একটি প্রভাবশালী অংশের। তাই দল পরিচালন সমিতির বক্তব্যই শেষ কথা বলবে, এমন ধরে নিলে বোকামি হবে। দিল্লি ক্যাপিটালসের জার্সিতে শিখরের আইপিএল ফর্ম কেমন যায়, তার উপরেও নির্ভর করবে তাঁর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ভাগ্য। নির্বাচকদের একাংশের ভোটও রয়েছে তাঁর দিকে।
এমনিতে রাহুল এত বেশি সুযোগ পেয়েছেন আর এত অপচয় করেছেন যে, ক্রিকেট মহলে অনেকের সহানুভূতি ধওয়নের দিকে। এঁরা বলেন, রাহুল হাইস্পিড ফেরারি কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন। আর শিখর ক্রিকেট এবং জীবনের রাস্তায় সিগন্যাল মেনে চলা শৃঙ্খলাপরায়ণ চালক। তা সে যতই তিনি ব্যাট হাতে আক্রমণাত্মক ভঙ্গির হন। কোনও কর্ণ জোহরের কফিতে চুমুক দিতে বসে বল্গাহীন মন্তব্য করতে দেখা যাবে না। বরং ‘গব্বর’ ডাকনামের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক দিলদরিয়া ব্যক্তি। এক বার কথা দিয়ে দিয়েছিলেন বলে বন্ধুদের সঙ্গে নিউ ইয়ার পার্টি ছেড়ে অন্য শহরে এক ভক্তের অনুষ্ঠানে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। দিল্লিতে তাঁর যে সতীর্থরা ৩১ অক্টোবরের সেই রাতে পার্টি করছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন কোনও এক বিরাট কোহালি।
বহু বছর আগে বিরাটদের নতুন বছরের পার্টিতে থাকা হয়নি। এ বার নতুন বছরে অধিনায়ক বিরাটের ওয়াংখেড়ে পার্টিতে কি জায়গা পাবেন? সোমবার, প্রাক-ম্যাচ প্রস্তুতিতেই হয়তো তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। কারও কারও কাছে ক্রিকেটের টিমলিস্ট ঠিক যেন জীবনের বড় পরীক্ষার ফল প্রকাশের মতো!