এশিয়ান গেমসে ভারতের হয়ে পদকজয়ী ক্রীড়াবিদেরা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
এশিয়ান গেমস শুরুর অনেক আগে থেকেই সম্প্রচারকারী চ্যানেলের তরফে প্রচার শুরু করে দেওয়া হয়েছিল, যার স্লোগান ছিল, ‘ইস্ বার ১০০ পার’। অর্থাৎ এ বার ১০০ পদকের গণ্ডি পেরিয়ে যাবে ভারত। সেই প্রচার অবশেষে প্রাণ পেল শনিবার। এশিয়ান গেমসে সত্যি সত্যিই ১০০ পদক পেরিয়ে গেল ভারত। এটি সর্বকালীন রেকর্ড। এর আগে কোনও দিন ১০০ পদক ছোঁয়া তো দূর, তার ধারেকাছেও যেতে পারেননি অ্যাথলিটেরা। সোনা পাওয়ার ব্যাপারেও এ বার রেকর্ড হয়েছে।
সম্প্রচারকারী চ্যানেল যতই এর প্রচার করুক, এর পিছনে কেন্দ্রীয় সরকারে ভূমিকার কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। ভারতকে খেলাধুলোর দেশ হিসাবে প্রমাণ করতে মরিয়া খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তবে বিশ্বে দাপট দেখানোর আগে এশিয়া সেরা হয়ে উঠতে হবে। এশিয়ায় ভারত যে কারও থেকে কম যায় না, সেটা বোঝানোর জন্যে এশিয়াডের থেকে ভাল মঞ্চ আর হয় না। তাই প্রচারের শুরুটা হয়েছিল এশিয়ান গেমস থেকেই। সেখানেই অভূতপূর্ব সাফল্য মিলল। আগের মোট পদকের থেকে ৩০টিরও বেশি পদক জিতে এশিয়াডে ‘সেঞ্চুরি’ করে ফেলল ভারত। মোদী অবশ্য প্রচার আগে থেকেই শুরু করে দিয়েছিলেন। ৭০টি পদক পেরোনোর পরেই তিনি টুইট করে ১০০ পদকের স্বপ্ন উস্কে দেন। ভারতীয় ক্রীড়াবিদেরা হতাশ করেননি।
১৯৫১ সালে শুরু হয়েছিল এশিয়ান গেমস। এই প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার অন্যতম কারিগর ভারত। প্রথম প্রতিযোগিতার আসর বসেছিল নয়া দিল্লিতে। সে বার ভারত পেয়েছিল ৫১টি পদক। তার পর থেকে সর্বমোট পদকের সংখ্যা ৫০-ও ছুঁতে পারেনি। ৩১ বছর পর আবার দিল্লিতে এশিয়াডের আসর বসে। সে বার ৫৭টি পদক পায় ভারত। আবার কয়েক বছরের খরা। ২০০৬ দোহা গেমসে ৫৩টি পদক জেতে তারা। সেই শুরু। তার পর থেকে কখনও ৫০-এর নীচে নামেনি পদকসংখ্যা।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
গত বছর এশিয়াডের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সোনা এবং পদক পেয়েছিল ভারত। ১৬টি সোনা ছিল। মোট পদক ছিল ৭০। চার বছরের ব্যবধানে যে ৩০টিরও বেশি পদক যোগ করবে তারা, এটা অনেকেই ভাবতে পারেননি। কেন্দ্রীয় সরকারের মদতে সম্প্রচারকারী সংস্থা প্রচার শুরু করে দেওয়ার পর তাই অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। সেটা যে নিছক ফাঁকা আওয়াজ ছিল না তা বোঝা গিয়েছে এখন।
খেলোয়াড়রা তো বটেই, এই প্রচারে এগিয়ে এসেছিলেন রাজনীতিবিদ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর কর্তারাও। কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর প্রচারে তো ছিলেনই। তাঁর সঙ্গে জেনারেল অনিল চৌহান (চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ), জেনারেল মনোজ পাণ্ডে (চিফ অফ আর্মি স্টাফ), অ্যাডমিনাল রাধাকৃষ্ণণ হরি কুমার (চিফ অফ নাভাল স্টাফ) এবং এয়ার চিফ মার্শাল বিবেক রাম চৌধরি।
এ ছাড়াও প্রচারে ছিলেন অমিতাভ বচ্চন, আমির খান, হেমা মালিনী, মাধুরী দীক্ষিত, অভিষেক বচ্চন, কপিল শর্মার মতো অভিনেতারা। শিক্ষাবিদ এবং লেখক সুধা মূর্তিকেও প্রচার করতে দেখা যায়। ক্রীড়াবিদদের মধ্যে মীরাবাই চানু, জাহির খান, অঞ্জু ববি জর্জ, রাজা রণধীর সিংহ এবং আরও অনেকে ছিলেন।
জাকার্তার পদকসংখ্যা টপকে যেতেই শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। গত বুধবার সকালে তিরন্দাজিতে সোনা জেতার সঙ্গেই ভারতের পদকসংখ্যা হয়ে যায় ৭১। তার পরেই এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে মোদী লেখেন, ‘‘এশিয়ান গেমসে ভারত এ বারই সব থেকে বেশি উজ্জ্বল। ৭১ পদক আমাদের সব থেকে ভাল ফল। ভারতীয় অ্যাথলিটদের দায়বদ্ধতা, পরিশ্রম ও খেলোয়াড়ি মানসিকতার ফল পাচ্ছি। প্রতিটা পদকের নেপথ্যে রয়েছে এক কঠিন লড়াইয়ের গল্প। দেশের কাছে এক গর্বের মুহূর্ত। প্রত্যেক অ্যাথলিটকে শুভেচ্ছা।’’
বস্তুত, অনেকেই মনে করছেন, মোদীর অনুপ্রেরণাতেই নাকি এশিয়াতে খেলাধুলোয় নিজেদের শক্তিপ্রকাশ করার সুযোগ পাচ্ছেন ভারতীয় ক্রীড়াবিদেরা। ভারতকে খেলাধুলোর দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে মোদী মরিয়া। গত কয়েক বছর ধরেই কেন্দ্রীয় বাজেটে খেলাধুলোয় বরাদ্দ বাড়ছে। বিভিন্ন প্রকল্প তৈরি করে সেখানে ক্রীড়াবিদদের যুক্ত করা হচ্ছে। যেমন টার্গেট অলিম্পিক্স পোডিয়াম স্কিম (টপ্স)। সেটাই এখন কাজে দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অলিম্পিক্স সংস্থার সভাপতি পিটি ঊষা সম্প্রতি বলেছিলেন, “প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছেতেই ভারত আগামী দিনে খেলাধুলোয় অন্যতম শক্তি হয়ে উঠবে। তার জন্য সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ক্রীড়াবিদদের পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। বিদেশি কোচদের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। তিন-চার বছর আগে এটা শুরু হয়েছে। এখন একটা জায়গায় চলে এসেছে তারা। তার ফলাফলও দেখতে পাচ্ছি আমরা।”
জ্যাভলিনে রুপোজয়ী কিশোর জেনার সঙ্গে সোনাজয়ী নীরজ চোপড়া। —ফাইল চিত্র।
টপ্স পরিকল্পনা যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত, সেই ক্রীড়া আইনজীবী নন্দন কামাথ বলেছেন, “ভারত যে এশিয়ার অন্যতম সেরা শক্তি হয়ে উঠছে এটাই তার প্রমাণ। শুটিং এবং অ্যাথলেটিক্সের মতো খেলাধুলোয় আরও জোর দেওয়া হচ্ছে। প্রতি দিন উন্নতি করছে তারা। নতুন নতুন খেলাধুলোয় আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।”
এশিয়ার মধ্যে চিনকে ছোঁয়া এখনও ভারতের কাছে স্বপ্ন। কিন্তু এ বারের প্রতিযোগিতায় তাইপেই, উজবেকিস্তান বা ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশকে টপকে যাওয়া কম ব্যাপার নয় বলে মত সংশ্লিষ্ট মহলের। ভারতের শেফ দ্য মিশন ভূপেন্দ্র সিংহ বাজওয়া বলেছেন, “আগামী দিনে চিনকে তাড়া করার স্বপ্ন দেখতেই পারি আমরা।”
এর পিছনে সূক্ষ্ম রাজনীতিও কাজ করছে বলে মনে করছেন অনেকে। এমনিতে ভারত ক্রিকেটখেলিয়ে দেশ হিসাবেই পরিচিত। সাধারণ মানুষের যা মাতামাতি, তা ক্রিকেট নিয়েই। ফুটবল তো বটেই, বাকি কোনও খেলাধুলোই তার ধারেকাছে আসে না। ক্রিকেটের এই আধিপত্যই কিছুটা খর্ব করতে চাইছেন মোদী। বাকি খেলাধুলোকে সমর্থন করে তিনি প্রমাণ করতে চাইছেন, ভারত শুধু ক্রিকেটই খেলে না, হকি, কুস্তি, টেনিস, তিরন্দাজিতেও পাল্লা দিতে পারে।
তা ছাড়া অলিম্পিক্স বা এশিয়ান গেমসের অন্তর্ভুক্ত খেলাগুলি নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা ন্যাশনাল স্পোর্টস ফেডারেশন। এই খেলাগুলি তথ্যের অধিকার আইনের (আরটিএ) আওতায়। ক্রিকেট এই আইনের আওতায় পড়ে না। এই নিয়ে একটা গাত্রদাহ মোদী সরকারের থাকতেই পারে।
ক্রিকেটের সর্বময় কর্তা এখন জয় শাহ, যিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ছেলে। বিভিন্ন রাজ্য সংস্থা থেকে শুরু করে বিসিসিআই, সর্বত্রই কেন্দ্রের শাসকদলের নেতাদের রমরমা। বিপুল টাকা আসে ক্রিকেট থেকে। ভরে কোষাগার। তা সত্ত্বেও কেন ক্রিকেটের দাপট কমানোর চেষ্টা? আসলে, ক্রিকেট এখনও বিশ্বজনীন খেলা হয়ে উঠতে পারেনি। মাত্র কয়েকটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ভারতের খেলাধুলোকে গোটা বিশ্বের মধ্যে পৌঁছে দিতে অলিম্পিক্স স্পোর্টস ছাড়া গতি নেই। তাই জ্যাভলিন, স্কোয়াশ, কুস্তি, বক্সিংয়ের মধ্যে যে খেলাগুলি মোটামুটি গোটা বিশ্বেই রয়েছে, সেখানেও দাপট দেখাতে চাইছে ভারত। শুধু কেন্দ্রীয় সরকার নয়, বেসরকারি সংস্থাগুলিও এখন ক্রীড়াবিদদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে। অন্তত দশ বছর আগেও যা ভাবা যেত না। ক্রীড়াবিদদের গ্যাঁটের কড়ি খরচা করে বিদেশে প্রতিযোগিতা খেলতে যেতে হত। এখন অনেকেরই সেই চিন্তা আর নেই। দুয়ারেই রয়েছে স্পনসর।
ভারত এ বারের এশিয়াডে অভাবনীয় সাফল্য পেলেও কিছু দিন আগে এই পরিস্থিতি ছিল না। নির্বাচন না হওয়া এবং অন্তর্কলহের কারণে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক্স সংস্থা (আইওসি) নিলম্বিত করার হুমকি দিয়েছিল ভারতীয় অলিম্পিক্স সংস্থাকে (আইওএ)। সে সব মিটে গিয়েছে অনেক দিনই। বেশির ভাগ খেলাধুলোতেই দায়িত্বে প্রাক্তন খেলোয়াড়েরা। ভারতের এই উপস্থিতি দেখে আগামী ১৫ অক্টোবর মুম্বইয়ে আইওসি-র অধিবেশন বসছে। এখন থেকেই ২০৩৬ অলিম্পিক্সে ভাল ফল করার লক্ষ্য নেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে।