প্রস্তুতি: থ্রো ডাউনে পন্টিং (বাঁদিকে)। নেটে ফুরফুরে স্মিথ। গেটি ইমেজেস
ক্যালিপসো ক্রিকেট বলতে অজ্ঞান জাস্টিন ল্যাঙ্গার। ক্রিকেটে হাতেখড়ির সময় থেকে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটারেরা তাঁর স্বপ্নের নায়ক। সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধেই ট্রেন্ট ব্রিজে বৃহস্পতিবারের ম্যাচের জন্য অস্ট্রেলিয়াকে তৈরি করেছেন স্টিভ স্মিথদের হেড কোচ। এবং এমন দু’টি দেশের খেলা, যারা এগারোটি বিশ্বকাপের সাতটিতেই জিতেছে।
স্বপ্নের ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে তুলনা অপছন্দ হলেও এ বারের দলটার খেলা বেশ লেগেছে ল্যাঙ্গারের। বিশেষ করে ক্যারিবিয়ান পেস বোলিংয়ের ‘আগুন’ নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা রয়েছে তাঁর। ল্যাঙ্গার যা বলছেন তাতে অস্ট্রেলিয়ার সমস্যার দিক, গত চার মাস স্পিনের বিরুদ্ধে খেলার জন্য বেশি প্রস্তুতি নেওয়া। কিন্তু ইংল্যান্ডে চলতি বিশ্বকাপে ফাস্ট বোলারদের দাপাদাপি দেখে রাতারাতি নতুন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে। আসলে শেষ ছ’মাস অস্ট্রেলিয়াকে মূলত খেলতে হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে। তাই স্পিনের বিরুদ্ধে খেলার জন্য বেশি করে তৈরি হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু বিশ্বকাপে ছবিটা ঠিক উল্টো। ডেভিড ওয়ার্নার, অ্যারন ফিঞ্চদের সামনে এ বার পেস আক্রমণ সামলানোর চ্যালেঞ্জ।
গত বারের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার ‘গুরু’ ল্যাঙ্গার বলেছেন, ‘‘সম্ভবত চার মাস আমরা তৈরি হয়েছি স্পিনের বিরুদ্ধে খেলতে। কিন্তু এখন দেখছি পরিস্থিতি অন্য রকম।’’ তাঁর বিশ্লেষণ, ‘‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে খেলার আগে স্পিন নিয়ে বেশি ভেবে লাভ নেই। ওদের বেশ কয়েক জন পেসার রীতিমতো ভাল। একই কথা বলতে হচ্ছে, দক্ষিণ আফ্রিকা আর ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে। নতুন রণকৌশলও নিতে হচ্ছে। তার উপর নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপার থাকছে। সবচেয়ে বড় কথা, হাতে একেবারে সময় নেই। যা করার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। তাই নেটে ছেলেরা সারাক্ষণই শর্ট বলের বিরুদ্ধে ব্যাট করছে। পেসারদেরও সে রকমই বলে দেওয়া হয়েছে।’’ অস্ট্রেলিয়ার উদ্বেগ বেড়েছে গত শুক্রবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং দেখে। যেখানে মূলত আন্দ্রে রাসেলের ভয়ঙ্কর শর্টপিচ বোলিংয়ের সৌজন্যে পাকিস্তানের ইনিংস শেষ হয়ে যায় মাত্র ১০৫ রানে। তার উপর বিশ্বকাপের আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি ম্যাচে রাসেলের লাফিয়ে ওঠা বল বিশ্রী ভাবে লেগেছিল উসমান খোয়াজার চোয়ালে। আর সেই প্রস্তুতি ম্যাচেই ওশেন থমাসের শর্টপিচ বলে কব্জিতে চোট পেয়েছিলেন ওয়ার্নারও। মনে হয়, অস্ট্রেলিয়াকে এ সবই এখন ভাবিয়ে তুলছে।
আন্দ্রে রাসেল, ক্রিস গেলদের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সম্পর্কে ল্যাঙ্গারের আরও মন্তব্য, ‘‘আক্ষরিক অর্থে ওরা ভয়ঙ্কর দল। যে ভাবে ব্যাট করছে আর বোলিংয়ে আগ্রাসন দেখাচ্ছে, তাতে এটা মানতেই হবে।’’ তা হলে কি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে নিজেদের আন্ডারডগ ভাবছেন? স্মিথদের হেড কোচের জবাব, ‘‘একেবারেই না। ভাল করেই জানি, ওদের কোথায় দুর্বলতা রয়েছে। তা ছাড়া হালফিলে আমরাও বেশ ভাল খেলছি।’’
প্রথম দু’টি বিশ্বকাপে জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১৯৭৫ এবং ’৭৯। দু’দশক ক্যারিবিয়ানরা বিশ্বক্রিকেটে দাপট দেখিয়েছে। ধারাবাহিক ভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তুলে এনেছে ক্রিকেট প্রতিভা। একই সঙ্গে ক্যালিপসো ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনা তীব্র হয়েছে তাদের অসাধারণ সব পেসার এবং আকর্ষণীয় ব্যাটসম্যানদের জন্য। ল্যাঙ্গারের স্মৃতিচারণ, ‘‘ছোটবেলায় ক্যালিপসো ক্রিকেট সব ছিল। তখন থেকেই আমি ওদের ভক্ত। সেই যে প্রচুর দৌড়ে এসে অসম্ভব জোরে বল করার ছবি, সে কথা কি ভোলা যায়? হতে পারে সে সব বলের প্রত্যেকটা ঠিক জায়গায় পড়ত না। কিন্তু ওদের বোলিং করার ভঙ্গি আর মেজাজটা বড় ভাল লাগত। আর ব্যাট করতে নেমে সবাই যেন ছক্কা মারবে! যে কারণে ওদের দলে ডারেন ব্র্যাভোকে খানিকটা বেমানান লাগে। ব্র্যাভো তো ক্রিকেট ব্যাকরণ মেনে খেলে, তাই এটা বলছি।’’ ল্যাঙ্গার যোগ করেছেন, ‘‘প্রতিপক্ষ হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সত্যিই বর্ণময় দল। যখন বড় হচ্ছি, তখন ওদের ক্রিকেটারেরাই আমার নায়ক ছিল।’’
ল্যাঙ্গার আলাদা করে বলেছেন ক্রিস গেলের কথা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই বিশ্বকাপে ৭ উইকেটে জয়ের ম্যাচে গেল হাফসেঞ্চুরি করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘ও অসম্ভব ভাল এক জন ক্রিকেটার। তবে শুধু গেল না, আরও বেশ কয়েক জন ভয়ঙ্কর ক্রিকেটার এ বারের ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে আছে। আর গেলের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটাকে যেন আরও বিশাল দেখায়। আমার তো মনে হয়, ওকে দেখে অন্যদের আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যায়।’’ মজা করে তিনি আরও বলেছেন, ‘‘আশা করি আমাদের বিরুদ্ধে ওরা বেশি আত্মবিশ্বাস দেখানোর চেষ্টা করবে না।’’
যে মাঠে খেলা, সেই ট্রেন্ট ব্রিজেই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে গত বছর ইংল্যান্ড ওয়ান ডে-তে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস গড়ে বিশ্বরেকর্ড করেছিল (৬ উইকেটে ৪৮১)। ল্যাঙ্গার সেই ম্যাচের কথাও ভোলেননি, ‘‘ইংরেজরা সে দিন বড্ড বেশি নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছিল।’’ ল্যাঙ্গার অবশ্য একই সঙ্গে জানিয়েছেন, ট্রেন্ট ব্রিজে খেলার ভাল অভিজ্ঞতাও তাঁদের আছে। আর বৃহস্পতিবারের ম্যাচের জন্য তিনি ভীষণ রকম ভরসা করছেন, ডেভিড ওয়ার্নারের উপর। আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে এ বারের বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে বল বিকৃতি কাণ্ডে জড়িয়ে নির্বাসন কাটিয়ে আসা ওয়ার্নার করেন অপরাজিত ৮৯ রানের অসধারণ ইনিংস। ‘‘আপনার নিশ্চয়ই ওর (ওয়ার্নারের) দু’চোখে রানের খিদেটা লক্ষ্য করেছেন। ওকে নিয়ে অনেকে অনেক কিছু বলছে। কিন্তু ছেলেটার একাগ্রতা আজও একই রকম। নিজের রান ৮০-৯০ হয়ে গেলেও একই রকম ভাবে ব্যাটটা করে। সবচেয়ে বড় কথা, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে। যে কোনও দলের কাছেই এ রকম এক জন ক্রিকেটার থাকা বিরাট ব্যাপার,’’ বলেছেন অস্ট্রেলিয়ার হেড কোচ।