বিশ্বকাপে চোট-আঘাত আর বৃষ্টি পিছু ছাড়ছে না ভারতীয় দলের

বিদায় শিখরের, সব নজর এখন ঋষভে

লের ম্যানেজার সুনীল সুব্রমহ্মণ্যম আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করে দিলেন, শিখরের  বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গিয়েছে। তাঁকে আর পাওয়া যাবে না। ইতিমধ্যেই দলের সঙ্গে প্র্যাক্টিস শুরু করা ঋষভ পন্থ যোগ দিচ্ছেন পরিবর্ত হিসেবে।

Advertisement

সুমিত ঘোষ 

সাউদাম্পটন শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৯ ০৪:২৭
Share:

হতাশ: বাঁ হাতের চোটেই শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেলেন শিখর।— ফাইল চিত্র

শেন ওয়ার্নের কাউন্টি হ্যাম্পশায়ার মাঠের উপরে তখন বেশ কালো মেঘ। একটু পরে বৃষ্টিও নামল। ভারতীয় দলের এক তারকা ক্রিকেটারের মাথার উপর তত ক্ষণে বজ্রপাত ঘটে গিয়েছে। তিনি শিখর ধওয়ন— আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণিত করে ছিটকেই গেলেন বিশ্বকাপ থেকে।

Advertisement

ইংল্যান্ডে কোনও ক্রিকেট কেন্দ্রেই মূল স্টেডিয়ামে নেট প্র্যাক্টিস করতে দেওয়া হয় না। বাইরেও একাধিক মাঠ থাকে। ব্যাটিং-বোলিং প্র্যাক্টিস করার জন্য সেখানে যেতে হয়। কান-মাথা ঢাকা হুড তোলা জ্যাকেট পরে এসে তিনি দাঁড়ালেন নেট থেকে কিছুটা দূরে। বাঁ হাতের তালুর জায়গাটা জুড়ে সাদা রঙের সেই ব্যান্ডেজ। দু’-এক জন সতীর্থের সঙ্গে কথা বললেন। প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে নেটে ব্যাট করতে গেলেন রোহিত শর্মা। কিছু ক্ষণ সে দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন তিনি। এই ক’দিন আগেও যে তাঁরা একসঙ্গে ব্যাট করতে যেতেন। তার পরেই প্র্যাক্টিসের জায়গা ছেড়ে ড্রেসিংরুমের দিকে হনহন করে হাঁটতে শুরু করে দিলেন তিনি।

এটাই বিদায়ী ছবি হয়ে থাকল। বিশ্বকাপের মঞ্চ ছেড়ে শিখর ধওয়নের পাকাপাকি ভাবে বেরিয়ে যাওয়ার শেষ দৃশ্য। একটু পরে দলের ম্যানেজার সুনীল সুব্রমহ্মণ্যম আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করে দিলেন, শিখরের বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গিয়েছে। তাঁকে আর পাওয়া যাবে না। ইতিমধ্যেই দলের সঙ্গে প্র্যাক্টিস শুরু করা ঋষভ পন্থ যোগ দিচ্ছেন পরিবর্ত হিসেবে। ম্যানেজার বললেন, ‘‘শিখরের বাঁ-হাতের প্রথম মেটাকার্পলের গোড়ায় চিড় ধরেছে। আমরা একাধিক ডাক্তারি মত নিয়েছি। দেখা যাচ্ছে, জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ ভাবেই ব্যান্ডেজ লাগানো অবস্থায় থাকতে হবে। তাই ওর পক্ষে বিশ্বকাপে আর খেলা সম্ভব হবে না।’’

Advertisement

পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুলের কাছেই চিড়টা ধরেছে। সেই কারণে সম্পূর্ণ সেরে না-উঠলে বাঁ-হাতি ওপেনারের পক্ষে ব্যাট ধরাই কার্যত অসম্ভব। গত ৯ জুন ওভালে ডেভিড ওয়ার্নারদের বিরুদ্ধে বাঁ-হাতের কব্জির উপরিভাগে বল আছড়ে পড়ে। প্রথমে শোনা গিয়েছিল নেথান কুল্টার-নাইলের বল লেগেছে। এ দিন কেউ কেউ বললেন, প্যাট কামিন্সের বলে আঘাত পেয়েছিলেন শিখর। বিশ্বের দ্রুততম বোলারদের এক জন কামিন্স। তাঁর বল লাগা মানে প্রভাব অনেক বেশি হতে বাধ্য। কুল্টার-নাইলের চেয়ে অনেক বেশি গতিসম্পন্ন তিনি।

১৮ জুন আনন্দবাজারে প্রকাশিত সেই এক্সক্লুসিভ খবর। ফাইল চিত্র

আকার-ইঙ্গিতে অবশ্য বোঝাই যাচ্ছিল। ১৮ জুন আনন্দবাজারে এক্সক্লুসিভ খবর প্রকাশিতও হয় যে, ধওয়নের বিশ্বকাপ সম্ভবত শেষের পথে। তখনই জানা গিয়েছিল, বাঁ-হাতের অবস্থার দারুণ কিছু উন্নতি হচ্ছে না। হাতের ব্যান্ডেজ কবে খোলা যাবে, নিশ্চয়তা নেই। ঠিক ছিল, সাউদাম্পটনে এসে ফের ডাক্তারি পরামর্শ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ম্যাঞ্চেস্টারে পাকিস্তানকে মহারণে হারিয়ে ভারতীয় দল সাউদাম্পটনে আসে গত সোমবার। সে-দিন আর পরীক্ষা করানো যায়নি। গত কাল শিখরের হাতের অবস্থার ফের পর্যবেক্ষণ হয় এবং তখনই কার্যত সব আশা শেষ হয়ে যায়।

ডাক্তারেরাও বলে দেন, জুলাইয়ের শেষ ভাগে গিয়ে হয়তো ব্যান্ডেজ খোলা যাবে। ও-দিকে বিশ্বকাপের ফাইনালই হয়ে যাবে ১৪ জুলাই। তার আগে দু’টো সেমিফাইনাল ৯ এবং ১১ জুলাই। আশা করা হচ্ছিল, যদি নক-আউট পর্ব থেকেও অন্তত শিখরকে ফের পাওয়া যায়। ম্যাঞ্চেস্টারে পাকিস্তান ম্যাচ খেলার সময় থেকেই সংশয় বাড়তে থাকে। সাউদাম্পটনে এসে সর্বশেষ ডাক্তারি পরীক্ষায় নিশ্চিত হয়ে যায়, শিখর পারবেন না।

বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে খুব আবেগপূর্ণ একটি টুইট করেছেন শিখর। সেখানে তিনি দল এবং ভক্তদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তাঁকে সমর্থন করার জন্য। ভারতীয় শিবিরে সকলে শ্রদ্ধাবনত তাঁর লড়াই দেখে। কেউ কেউ এ দিনও বলছিলেন, ‘‘ওর যে এত বড় চোট লেগেছে, কাউকে বুঝতেই দেয়নি। দুঃসাহসিক আর অমর হয়ে থাকবে শিখরের লড়াই।’’

ছোটবেলার ক্রিকেটার-বন্ধুরা অবশ্য সে-দিনের ব্যাট করে যাওয়া দেখে অবাক হননি। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘ক্রিকেট মাঠে শিখর কোনও কিছুতে ভয় পায় না। নিজে ইচ্ছা করে গিয়ে দাঁড়াত সিলি পয়েন্ট, শর্ট লেগে। ব্যাটসম্যানদের মুখের উপরে দাঁড়িয়ে শোলের গব্বর সিংহের সংলাপ আওড়াত। তা থেকেই তো ওর নাম হয়েছিল গব্বর।’’ এর পর এক বার ঠোঁটে সংক্রমণ হওয়ায় গোঁফ বড় হয়ে যায়। সেই শুরু পাকানো গোঁফের। সম্পূর্ণতা পেয়ে গেল ক্রিকেট মাঠের গব্বর চরিত্র।

অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে যখন চোট লাগে, শিখর ছিলেন পঞ্চাশের আশেপাশে। যন্ত্রণা সহ্য করেই ব্যাটিং করে চলেন তিনি এবং শেষ পর্যন্ত ১০৯ বলে ১১৭ রান করে ভারতকে ৩৫২ রানের বিশাল স্কোরে পৌঁছে দেন। শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়াকে সেই ম্যাচে ৩৬ রানে হারিয়ে বিশ্বকাপ অভিযানই জমিয়ে দেয় কোহালির ভারত। আর ম্যাচের সেরার পুরস্কার জিতে নায়ক হয়ে থাকেন শিখর ধওয়ন। কিন্তু ব্যাটিং চালিয়ে গেলেও হাতের চোটের জন্য পরে ফিল্ডিং করতে পারেননি তিনি।

এমনিতে ডাকনাম ‘গব্বর’ হলেও শোলের খলনায়ক নয়, সব চেয়ে পছন্দের চরিত্র মহাভারতের অর্জুন। শরীরে থাকা একাধিক ট্যাটুর মধ্যে প্রিয়তম অর্জুনেরটাই। পৌরাণিক কাহিনিতে বেশ আগ্রহ রয়েছে তাঁর। আর শ্রীকৃষ্ণ-অর্জুনের কথোপকথনের চেয়ে আকর্ষক কিছু জীবনে শোনেননি বলে স্বীকার করেন। ক্রিকেটের বাইশ গজে অর্জুনের মনঃসংযোগকে বরাবর উদাহরণ করতে চেয়েছেন শিখর।

প্র্যাক্টিস শেষে লাঞ্চ রুম থেকে মধ্যাহ্নভোজ সেরে বেরোনোর সময় দেখা গেল, ব্যান্ডেজ বাঁধা হাত দিয়ে মোবাইলটা কোনও রকমে ধরে আছেন। কী নির্মম আর বাস্তব উপলব্ধি! আপাতত শুধু মোবাইলই ধরা যাবে, ব্যাট নয়। শূন্য দৃষ্টিতে এক বার আকাশের দিকে তাকিয়ে ড্রেসিংরুমে ঢুকে গেলেন শিখর ধওয়ন। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, বিশ্বকাপের মঞ্চে আর অর্জুন হওয়া হল না তাঁর। একলব্য হয়েই থেকে যেতে হবে। আঙুল হারিয়ে দলকে সেরা দক্ষিণা দিয়ে গেলেন!

অস্ট্রেলিয়া-বধের দক্ষিণা! সে-দিন না-জিতলে যে কোহালিদের বিশ্বকাপ রথ এই টগবগে গতিটাই পায় না! কাপ এলে ভারতীয় ক্রিকেটের শিখরেই স্থান পাবে তাঁর লড়াই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement