তখনও বৃষ্টি নামেনি। কোণঠাসা নিউজ়িল্যান্ডের রান আউট হাতছাড়া হওয়ায় আক্ষেপ বিরাট কোহালির। মঙ্গলবার ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে। ছবি: গেটি ইমেজেস
কপিল দেবের সামনে তিরাশির ঐতিহাসিক বিশ্বকাপ যাত্রার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর মঞ্চ তৈরি করেও থমকে দাঁড়িয়ে বিরাট কোহালির ভারত। তার কারণ ম্যাঞ্চেস্টার আবার ‘রেনচেস্টার’ হয়ে উঠল মঙ্গলবার।
৪৬.১ ওভারে নিউজ়িল্যান্ড ২১১-৫, এই অবস্থায় বৃষ্টি নামে। ইংল্যান্ডের সময় বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ তা সাময়িক ভাবে থামলও। গ্যালারিতে তখন বেশ কিছু ভারতীয় দর্শক ছাতা মাথায় বসে। হাতে তেরঙ্গা। গায়ের নীল জার্সি ভিজে গেলেও পাল্টাননি। ছাদ না-থাকায় অনেকে নীচে নেমে গিয়েছিলেন। তাঁরা ফিরে এসেছেন। গ্যালারি আবার ভর্তি হতে শুরু করেছে। একটা অংশ অবশ্য অধৈর্য হয়ে পাশের স্টেশন থেকে ট্রাম ধরে ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু যাঁরা ছিলেন, মাঠ থেকে কভার সরাতে দেখে এমন গর্জন করে উঠলেন যে, মনে হবে, কোহালিরা বুঝি জিতেই গিয়েছেন!
আর তার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল বৃষ্টি। তড়িঘড়ি কভার ফিরিয়ে আনা হল মাঠ ঢাকার জন্য। পিচের উপর থেকে চাকা লাগানো কভার সরানোর তখনও কোনও সম্ভাবনা নেই। কোনও রকম বিঘ্ন না-ঘটে পুরো খেলা হলে তা শেষ হয়ে যায় ইংল্যান্ডের সময় ৬টা নাগাদ। এখানে সাড়ে ৫টা বেজে যাওয়ার পরেও ম্যাচ শুরু হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি। কেউ কেউ তখনই আবহাওয়ার অ্যাপ খুলে দেখলেন, ইংল্যান্ডের সময় ৭টা পর্যন্ত বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। কিছু পরে আবার থামল, তার পরে ফের নামল। শেন ওয়ার্ন তখন মাঠে নেমে টিভি ধারাভাষ্যে বলে চলেছেন, ‘‘মাঠে এখনও এত দর্শক বসে রয়েছেন। চেষ্টা করা উচিত যাতে আজই খেলা করা যায়।’’ তার কিছু পরেই সরকারি ভাবে খেলা আজকের মতো স্থগিত রাখার কথা ঘোষণা করে দেওয়া হল।
বিশ্বকাপের নিয়ম অনুযায়ী প্রথম দিনে যদি খেলা থেমে যায় এবং ফের শুরু করা না-যায়, তা হলে যেখানে খেলা শেষ হয়েছিল, তার পর থেকে চালু হবে। অর্থাৎ বুধবার রিজার্ভ ডে-তে নিউজ়িল্যান্ড যে ৪৬.১ ওভারে শেষ করেছিল, সেখান থেকেই আবার ম্যাচ হবে। প্রথমে তারা পুরো
পঞ্চাশ ওভার খেলবে, তার পরে রোহিত শর্মারা নামবেন। যদি প্রথম দিনেই খেলা চালু করা যেত, তা হলে ডাকওয়ার্থ-লুইস নিয়মে পরিবর্তিত টার্গেট সামনে নিয়ে ব্যাট করতে নামতে হত ভারতকে।
কোনও সন্দেহ নেই, কোহালিদের পক্ষে দ্বিতীয় পথটাই বেশি সুবিধাজনক। কারণ, যশপ্রীত বুমরারা নিউজ়িল্যান্ড ব্যাটিংকে শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলেছিলেন। বৃষ্টিবিঘ্নিত প্রথম দিনে খেলতে নামা মানে তাঁদের সামনে অপেক্ষাকৃত কঠিন টার্গেট স্কোর দেওয়া হত। যেমন, কোহালিরা যদি ২০ ওভার ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেতেন, তা হলে তাঁদের টার্গেট হত ১৪৮। যেখানে পুরো ৫০ ওভারের ম্যাচ হলে হয়তো খুব বেশি হলে ২৪০-এর স্কোর তাড়া করতে হত। ডাকওয়ার্থ-লুইস নিয়মে চললে তাই অ্যাডভান্টেজ নিউজ়িল্যান্ড। শুরুর দিকে ভারতীয় বোলারদের একচ্ছত্র শাসনের ফায়দাই তোলা কঠিন হত।
এখন যা দাঁড়িয়েছে, বুধবার প্রথমে বাকি খেলার পুরোটাই করার চেষ্টা হবে। যদি বৃষ্টি তা হতে না-দেয়, ডাকওয়ার্থ-লুইস নিয়মে পরিবর্তিত টার্গেট ঝোলানো হবে ভারতের সামনে। সে-ক্ষেত্রে প্রথম চেষ্টা করা হবে, ভারত যেন ন্যূনতম ২০ ওভার ব্যাট করতে পারে। যদি ভারত ব্যাট করারই সুযোগ না-পায়, তখন রাউন্ড রবিন পর্বে যে-দল পয়েন্ট টেবলে উপরে ছিল, তারা যাবে। সে-ক্ষেত্রে কোহালিরাই ফাইনালে উঠবেন কেন উইলিয়ামসনদের হারিয়ে।
বিশ্বকাপে বৃষ্টিতে খেলা ভেস্তে যাওয়া নিয়ে অনেকেরই ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে শুরু করেছে। প্রশাসনিক এবং আয়োজনগত গাফিলতির কথাও উঠতে শুরু করেছে জোরালো ভাবে। আজ এক বার বৃষ্টি যখন কিছুটা থেমেছে, দেখা গেল, মাঠের মধ্যে আম্পায়ার, কর্মীরা দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেন। সেই সময় তাঁরা তড়িঘড়ি মাঠ শুকোনোর ব্যবস্থা করছিলেন না কেন, সেটাই প্রশ্ন। প্রাক্তন ইংল্যান্ড অধিনায়ক মাইকেল আথারটন পর্যন্ত বলে ফেললেন, ‘‘বৃষ্টি তো থেমে গিয়েছে। তা হলে ওরা কভার সরাতে উদ্যোগী হচ্ছে না কেন?’’
বৃষ্টির সামনে হাত গুটিয়ে বসে থাকার এই প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠতে বাধ্য। ইডেনে গোটা মাঠ ঢেকে রাখার ফর্মুলাকে এত দিন অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু বিশ্বকাপে ইডেনের ফর্মুলাই সকলের মুখে মুখে ঘুরছে। কেভিন পিটারসেন, ব্রায়ান লারাদের মতে, ইডেনে অনেক বারই এই প্রক্রিয়ার জন্য তাড়াতাড়ি খেলা শুরু করা গিয়েছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইডেনে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের কথা বলছেন সকলে। প্রবল বৃষ্টির পরেও পুরো ম্যাচ হয়েছিল। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচে ভারতীয় দল খেলা হবে না ধরে নিয়ে হোটেলে ফিরে গিয়েছিল। এত বৃষ্টি হয়েছিল যে, কেউ ভাবেননি খেলা হতে পারে। এক ঘণ্টার মধ্যে ইডেন থেকে তাঁদের কাছে ফোন যায়, মাঠ তৈরি করে ফেলা হয়েছে। চলে আসুন।
বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে মাঠ শুকোনোর জন্য মাত্র দু’টো সুপার সপার থাকবে কেন, সেই প্রশ্নও জোরালো ভাবে উঠে পড়ছে। টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছে ৩০ মে। এক মাস দশ দিন পরেও খুঁত মেরামতির কোনও প্রয়াস নেই। মাঠের অত্যাধুনিক জল নিষ্কাশনী ব্যবস্থার উপরে নির্ভর করছিলেন সংগঠকেরা। পাল্টা প্রশ্ন উঠছে, ইংল্যান্ডে বৃষ্টি হচ্ছে, সকলে তো দেখতেই পাচ্ছে। ম্যাঞ্চেস্টারে যে অহরহ বৃষ্টি হয়, এটা আর নতুন কী? এ শহরের অন্য নামই তো হয়ে গিয়েছে ‘রেনচেস্টার’। তা হলে সেমিফাইনালের কথা ভেবে আগাম সতর্কতা নেওয়া হল না কেন? প্রয়োজনে অন্য মাঠ থেকেও কয়েকটা সুপার সপার বা মাঠ ঢাকার জন্য কভার উড়িয়ে এনে রাখা যেত দু’টি সেমিফাইনাল এবং ফাইনালের মাঠে।
দর্শকদের জন্য মাথার উপরে ছাদের ব্যবস্থাটুকুও নেই। যা নিয়ে অনেককেই অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গেল। অথচ সকাল থেকে ম্যাঞ্চেস্টারকে মুম্বই বানানোর অফুরন্ত উদ্যম আর সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন ভারতীয় দর্শকেরা। ‘ভারত আর্মি’র সদস্যেরা ঢাক নিয়ে এসেছিলেন। সেই ঢাকের সুর একেবারে কলকাতার পুজো প্যান্ডেলকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল। সেখানে ভাংড়া নাচ শুরু হয়ে গিয়েছিল সকালেকেই। কে জানত, অষ্টমীতে বৃষ্টির মতো পুরো আয়োজনটাই এমন ধাক্কা খাবে!
সেই আবহের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারকা উপস্থিতি। তিরাশির ঐতিহাসিক বিশ্বজয়ের অধিনায়ক কপিল দেব ছিলেন। তিরাশিতে এখানেই প্রথম ম্যাচে তাঁর দল অঘটন ঘটিয়ে হারিয়ে দিয়েছিল ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। সেই জয় গোটা দলের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি করে দেয় যে, তাঁরাও পারেন। তার পরে সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডকেও উড়িয়ে দেন তাঁরা ওল্ড ট্র্যাফোর্ডেই।
উপরে কমেন্ট্রি বক্সে সচিন তেন্ডুলকর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, ভিভিএস লক্ষ্মণ, হরভজন সিংহেরা। কপিল এক বার জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘সচিন কি উপরে আছে?’’ কপিল যখন প্রেস বক্সের পাশের লাউঞ্জে চায়ে চুমুক দিয়ে টিভির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখান এলেন স্টিভ ওয়। একটু উপরের দিকে তাকান। কমেন্ট্রি বক্সের ব্যালকনিতে শেন ওয়ার্ন। যেন চাঁদের হাটই বসেছিল ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে।
আর মহাতারকাদের সামনে অসাধারণ বোলিং প্রদর্শনী তুলে ধরেছিলেন যশপ্রীত বুমরারা। শুরু থেকেই বুমরা আর ভুবনেশ্বর কুমরা এমন চেপে ধরেছিলেন নিউজ়িল্যান্ডের দুই ওপেনারকে যে, প্রথম রানটাই মার্টিন গাপ্টিলরা করতে পারলেন ১৬ বল পরে। স্কোরার জানালেন, বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বাধিক বল খেলে প্রথম রান করার তালিকায় এটা দ্বিতীয়। প্রথম বলেই জোরালো এলবিডব্লিউয়ের আবেদন হল ভুবনেশ্বরের বলে। আম্পায়ার দিলেন না। কোহালিরা রিভিউ নিলেন। ওয়ান ডে-তে মাত্র একটি রিভিউয়েরই সুযোগ থাকে। শুরুতেই সেটা চলে গেল।
নিউজ়িল্যান্ডের ব্যাটিংকে কখনও মাথা তুলতে দেননি বুমরারা। বুমরা ফের বোলারদের মধ্যে সেরা। আট ওভারে মাত্র ২৫ রান দিয়ে এক উইকেট। তাঁর আরও দুই ওভার আছে এবং নিয়ম অনুযায়ী বুধবার খেলা শুরু হলে সেই দুই ওভার করতে পারবেন। দিনের শেষে এটাই একমাত্র প্রাপ্তি। বুমরাদের শাসন ধুয়ে দিতে পারেনি বৃষ্টিও। নিউজ়িল্যান্ড ২১১-৫ থেকেই খেলা আবার শুরু হবে বুধবার। কোহালিরা যখন মাঠ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, দেখতে পেলেন অদ্ভুত একটা দৃশ্য। গ্যালারি ফাঁকা, কিন্তু ভারতীয় দর্শকেরা অনেকে তেরঙ্গা পতাকা স্ট্যান্ডের সঙ্গে লাগিয়ে রেখে গিয়েছেন। বার্তা স্পষ্ট— কাল আবার আসছি। ওই একই জায়গায় বসে আবার আমরা চেঁচাব তোমাদের জন্য।
পয়মন্ত ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে লড়াই চলবে! বৃষ্টি নিস্তেজ করে দিতে পারেনি ভারতীয় উদ্যমকে।