রোহিত ঝড়, কুলদীপ ম্যাজিকে খড়কুটোর মতো উড়ে গেল পাকিস্তান

ব্যাটিং জোয়ারে ভারত পঞ্চাশ ওভারে তুলল ৩৩৬-৫। জবাবে ৩৫ ওভারের শেষে পাকিস্তান যখন ১৬৬-৬ এবং বৃষ্টি এসে তৃতীয় বারের জন্য খেলা থামিয়ে দিল, তখনই মনে হচ্ছে ম্যাচের ফলাফল হয়ে গিয়েছে।

Advertisement

সুমিত ঘোষ

ম্যাঞ্চেস্টার শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৯ ০৩:৪১
Share:

যুগলবন্দি: ফের শতরান রোহিতের। ৭৭ রানের ইনিংস খেললেন বিরাটও। রবিবার ম্যাঞ্চেস্টারে। এপি

ম্যাঞ্চেস্টার মহারণ শুরু হতে তখনও ঘণ্টা খানেক বাকি। দেখা গেল, ভিআইপি গ্যালারির গেট দিয়ে অমোল পালেকর ঢুকছেন। আশেপাশে তখন নীল জার্সি আর তেরঙ্গা নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তের দলের ভিড়। তাঁকে দেখে তৎক্ষণাৎ অনেকে গুন গুন করে গাইতে শুরু করে দিলেন, ‘আনেওয়ালা পল, জানেওয়ালা হ্যায়’। আহা ‘গোল্ডেন ওল্ডিজ’!

Advertisement

একটু পরে দেখে মনে হল, আরও প্রাসঙ্গিক গান হবে ‘দো দিওয়ানে শহর মে’। কারণ, ঠিক তখনই যে একই গেট দিয়ে ঢুকছেন আর এক ভারতীয় মহাতারকা। অমল পালেকর যেমন ফিল্মের, ইনি তেমন ক্রিকেটের। নাম? সচিন রমেশ তেন্ডুলকর। ইনিও যে ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’-এর সার্থক প্রতীক। আজও বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে, যে কোনও মাঠে ভারত-পাক মহারণ মানে তেরঙ্গা হাতে জনতা স্মরণ করে সেঞ্চুরিয়নে তাঁর সেই মহাকাব্যিক ইনিংস। শোয়েব আখতার, ওয়াসিম আক্রমদের পিটিয়ে করা ৭৫ বলে ৯৮। ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পরে এখনও এমনই চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি রয়েছে যে, ‘গোলমাল’, ‘চিতচোর’ খ্যাত পালেকরও এগিয়ে গেলেন সচিনের দিকে। দু’জনে কিছুক্ষণ কথা হল, তার পর ভারতীয় দলের জয় কামনা করে যে যাঁর বক্সের দিকে এগোলেন।

ও দিকে ভারতীয় জনতা তত ক্ষণে বলতে শুরু করে দিয়েছে, ‘‘ঢোকার মুখে সচিনের মুখ দেখেছি। সঙ্গে সদা হাস্যময় অমল পালেকর। এটা নিশ্চয়ই শুভলক্ষণ। বিশ্বকাপে পাক ম্যাচের স্কোরবোর্ড এত দিন ৬-০ ছিল। আজ ওটাকে ৭-০ করে মাঠ ছাড়ব।’’ তার পরেই সেই বিখ্যাত ধ্বনি ‘স্যা-চিন-ন, স্যা-চি-ন’। কে জানত, রবিবাসরীয় ম্যাঞ্চেস্টার সচিনেরই শহরের ছেলের নামে নতুন ধ্বনি তুলবে ‘রো-হিত, রো-হিত’! বিশ্বকাপের পাক দ্বৈরথে সচিনের সেঞ্চুরিয়ন ইনিংসের পাশে আরও একটি মণিমুক্তো খোদাই করা মুকুট এ দিন তৈরি হয়ে থাকল। রোহিতের ১১৩ বলে ১৪০।

Advertisement

আরও পড়ুন: ৭-০, বিরাটদের হেলায় পাক বধের নেপথ্য কারণগুলো কী?

সেই ব্যাটিং জোয়ারে ভারত পঞ্চাশ ওভারে তুলল ৩৩৬-৫। জবাবে ৩৫ ওভারের শেষে পাকিস্তান যখন ১৬৬-৬ এবং বৃষ্টি এসে তৃতীয় বারের জন্য খেলা থামিয়ে দিল, তখনই মনে হচ্ছে ম্যাচের ফলাফল হয়ে গিয়েছে। পাক দর্শকেরা মাঠ ছাড়তে শুরু করে দিলেন। তাঁদের ক্রিকেটারদের দেখেও মনে হচ্ছিল না, এখান থেকে অভাবনীয় কিছু ঘটানোর স্বপ্ন দেখছেন। ঘোষণাও করে দেওয়া হল, এখানেই যদি ম্যাচ থেমে যায় ভারত জিতবে। ডাকওয়ার্থ-লুইস নিয়ে তারা এগিয়ে। যদিও আধ ঘণ্টা মতো বিরতির পরে মাঠ কর্মীরা ফের মাঠ শুকিয়ে তোলার অভিযান শুরু করে দিলেন।

সচিনেরই ভবিষ্যদ্বাণী মিলিয়ে দিয়ে ভারতীয় ইনিংসের নায়ক হয়ে উঠলেন তাঁর দুই প্রিয় উত্তরসূরি। অবসর নেওয়ার পরে মুম্বইয়ে এক পার্টিতে সচিনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ব্যাটিংয়ে তাঁর এত সব অবিশ্বাস্য রেকর্ড কে ভাঙতে পারেন? সচিন বলেছিলেন, ‘‘এই ঘরেই তারা দু’জন বসে রয়েছে। বিরাট আর রোহিত।’’ জহুরি ঠিক সোনা চিনেছিলেন। সচিন পরবর্তী যুগে বিরাট কোহালি এবং রোহিত শর্মাই ভারতীয় ক্রিকেটের রোলস রয়েস এবং ফেরারি। যত বড় মঞ্চ, তত যেন চওড়া হয় তাঁদের ব্যাট।

উৎসব: রবিবার ম্যাঞ্চেস্টারের গ্যালারিতে এ ভাবেই ভারতের পতাকা নিয়ে গলা ফাটালেন মহিলা ভক্ত। এএফপি

ওয়ান ডে ক্রিকেটে চব্বিশতম সেঞ্চুরি হয়ে গেল রোহিতের। স্বপ্নের বিশ্বকাপ যাচ্ছে তাঁর। চতুর্থ ম্যাচে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি হয়ে গেল। তা-ও আবার নিউজ়িল্যান্ড ম্যাচে একটা বলও খেলা হয়নি। বৃষ্টিতে ধুয়ে গিয়েছে। অমল পালেকর মানে যেমন মিষ্টি সব গান, রোহিত শর্মা ক্রিজে থাকা মানেও মায়াবী সব স্ট্রোক। সে কারণেই তো তাঁর নামে হয়েছে ‘রো-হিট’।

বলিউড উপস্থিতি অবশ্য পালেকর দিয়েই শেষ হল না। রণবীর সিংহও হাজির। মাঠে ঢুকে পাকিস্তানের তরুণী অ্যাঙ্করের সঙ্গে নিজস্বী তুললেন। শোনা গেল, কপিল দেব আর তিরাশি বিশ্বকাপ জয়ের শুটিংয়ের কাজে ইংল্যান্ডে আছেন। ম্যাঞ্চেস্টারের মহামঞ্চ ঘুরে গেলেন। কোনও এক হরিয়ানা হারিকেনের আন্তর্জাতিক উদয় ঘটেছিল যে পাকিস্তানেই! পর্দার কপিল দেব ভুললে চলবে কী করে!

বলা হয়, ব্যাটসম্যানদের দিক থেকে ম্যাঞ্চেস্টার হল ইংল্যান্ডের কঠিনতম পরীক্ষার শহর। যে কোনও সময় আকাশ মেঘলা করে আসবে, বৃষ্টি নামবে, কনকনে ঠান্ডা বাতাস বইবে। ফাস্ট বোলারেরা তো এ রকম পরিবেশেরই প্রার্থনা করেন। এ দিন সে রকম হলও মাঝেমধ্যে। বৃষ্টিতে খেলা থামল তিন বার। তার মধ্যেও রোহিত স্ট্রোকের ফুলঝুরি প্রদর্শনী খুলে বসলেন। যেমন পুল-হুক মারতে থাকলেন, তেমনই কাট।

এত দিন মনে করা হত, বিশ্বকাপে কোনও ভারতীয় ব্যাটসম্যানের খেলা সেরা শট তিরাশির ফাইনালে অ্যান্ডি রবার্টসের বলে হাঁটু মুড়ে মারা শ্রীকান্তের স্কোয়ার ড্রাইভ। যা কি না বিধ্বংসী এক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান দলের বুক সে দিন প্রথম কাঁপিয়ে দিয়েছিল। চরম ঔদ্ধত্য মেশানো ওই স্কোয়ার ড্রাইভে লেখা ছিল ভয়ঙ্কর ক্যারিবিয়ান পেসারদের জন্য বার্তা যে, আমরা তোমাদের ভয় পাই না। রোহিতকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি শ্রীকান্তের থেকে বিশ্বকাপের সর্বসেরা শটের কোহিনুর ছিনিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। এ দিন হাসান আলিকে পয়েন্টের উপর দিয়ে একটা ছক্কা মারলেন। ভুল লেখা হয়নি। হ্যাঁ, পয়েন্টের উপর দিয়েই। চাবুকের মতো ব্যাট গিয়ে আছড়ে পড়ল বলে। ওই একটা শট মুহূর্তে দু’টো দলের শরীরী ভাষাই যেন পাল্টে দিল। পাকিস্তান পুরো কুঁকড়ে গেল। ভারত ততই ডানা মেলে উড়তে শুরু করল।

ভারত-পাক ম্যাচ নিয়ে কলকাতা পুলিশের মিম।

এর পর কোহালি এসে পাক বোলারদের যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে দিলেন। হার্দিক পাণ্ড্য যখন ব্যাট করছেন, ইংল্যান্ডের প্রাক্তন ক্রিকেটার ডেভিড লয়েডকে বলতে শোনা গেল, ‘‘পাণ্ড্য যদি দশ ওভার টেঁকে, জানি না কত রানে গিয়ে থামবে ভারত। স্কাই ইজ দ্য লিমিট।’’ পাণ্ড্য ১৯ বলে ২৬-এর বেশি করতে পারলেন না। রোহিত ঝুঁকি নিয়ে স্কুপ শট মারতে গিয়ে থামলেন ১৪০ রানে। ইনিংসে চোদ্দোটা চার, তিনটে ছয়। কোহালি করলেন ৬৫ বলে ৭৭। ওয়ান ডে-তে দ্রুততম এগারো হাজারে পৌঁছে গেলেন ভারত অধিনায়ক। সচিনের থেকেও কম ইনিংস নিয়েছেন। যে রকম টপ গিয়ারে তিনি এগোচ্ছেন, মুম্বইয়ের পার্টিতে বলা মাস্টার ব্লাস্টারের সেই ভবিষ্যদ্বাণীই না সত্যি হয়।

পাক অধিনায়ক সরফরাজ় আহমেদ টসে জিতেও কেন ফিল্ডিং নিলেন, তা নিয়ে হয়তো বাকি জীবন তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। সকালে ইমরান খান পর্যন্ত টুইট করেন তাঁর উদ্দেশে, ‘‘টসে জিতে ব্যাট করো। হারবে ভেবে নামবে না। বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যান, বোলারের উপর আস্থা রাখো।’’ সরফরাজ় শুধু তাঁর দেশের সেরা মস্তিষ্ককেই নয়, দেশের প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ না শোনার দুঃসাহস দেখালেন। এর পর তাঁর গর্দান গেলে আবাক হওয়ার থাকবে না। টসের ভুল সিদ্ধান্ত, ভারতের বিরুদ্ধে গতির চেয়ে স্পিনে বেশি আস্থা দেখানো আর একেবারে শুরুতে রোহিত শর্মার সহজতম রান আউটের সুযোগ নষ্ট করা দুর্ভোগ ডেকে আনল পাকিস্তানের জন্য।

দেখা গেল আক্রম, ওয়াকারদের সেই বোলিং সাম্রাজ্যও অস্ত গিয়েছে। দীর্ঘ কাল ধরে যা পাকিস্তানকে ম্যাচ জিতিয়েছে। টিমটিম করে জ্বলছেন শুধু মহম্মদ আমির। ভারত ৩৩৬ তোলার দিনেও আমিরের দশ ওভারে উঠল মাত্র ৪৭ রান। সঙ্গে তিন উইকেট। আর ভারত যা যা করল, সব ঠিক হল। টস হেরে ব্যাট করতে হল। তবু রোহিত এবং কে এল রাহুল প্রথম উইকেটেই ১২৬ রান তুলে ম্যাচের রিংটোন সেট করে দিলেন। এর পর রোহিত আর কোহালি মিলে দ্বিতীয় উইকেটে তুললেন ৯৮ রান। বৃষ্টি ভেজা মাঠে চোট পেয়ে ভুবনেশ্বর কুমারকে বেরিয়ে যেতে হল। তিনি আর বলই করতে পারলেন না। কিন্তু ওভার শেষ করতে আসা বিজয় শঙ্করই উইকেট তুলে নিলেন।

ভারত-পাক ম্যাচ আর চিরকালের সেই রীতি। কাউকে রাজা বানায়, কাউকে ফকির!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement