বিতর্ক: গাপ্টিলের সেই থ্রো। ফিল্ডারের বল ছোড়ার সময় দেখা যাচ্ছে ব্যাটসম্যানরা একে অন্যকে পেরিয়ে যাননি। টুইটার
ইংল্যান্ডের রাস্তায় রাস্তায় বিজয়োৎসব আর জাতীয় দলের সংবর্ধনার ঢেউয়ের মধ্যে প্রবল বিতর্কের ঝড়ের মুখে পড়েছে লর্ডসের বিশ্বকাপ ফাইনাল। একে তো দু’বার টাই হওয়ার পরেও শুধু বাউন্ডারি বেশি মারার ভিত্তিতে ইংল্যান্ডের চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না অনেকে। সেটা যদিও বা নিয়মের খাতিরে সহ্য করতেও হয়, আম্পায়ারিং নিয়ে ক্ষোভ গোপন রাখা যাচ্ছে না।
বিরাট বিতর্ক বেধেছে মার্টিন গাপ্টিলের ওভার থ্রো থেকে ইংল্যান্ডকে ৬ রান দেওয়া নিয়ে। বেন স্টোকসের ব্যাটে লেগে বলটি বাউন্ডারি হয়ে যায়। তর্ক উঠেছে যে, ৫ রানের বদলে ৬ রান কেন দিলেন আম্পায়ারেরা? ইংল্যান্ড কি আম্পায়ারের ভুলের আশীর্বাদ পেয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল? লন্ডনের রাস্তায় গাড়ির হর্ন বাজিয়ে আর জাতীয় পতাকা দুলিয়ে অভিনব উৎসবের মধ্যেও থামছে না প্রশ্ন।
ক্রিকেটের নিয়ম অনুযায়ী, থ্রো হওয়ার সময় যদি দ্বিতীয় রানের জন্য দুই ব্যাটসম্যান একে অপরকে পেরিয়ে গিয়ে থাকেন, তবেই বাউন্ডারির সঙ্গে ২ রান যোগ হয়ে ৬ রান হতে পারে। কিন্তু নিউজ়িল্যান্ডের গাপ্টিল যখন থ্রো করেন, তখন দুই ইংরেজ ব্যাটসম্যান ‘ক্রস’ করেছেন কি না, তা নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছে। রিপ্লেতে দেখা গিয়েছে, তাঁরা তখনও একে অন্যকে পেরিয়ে যাননি। এ দিন ভারতের নামী আম্পায়ার পিলু রিপোর্টার আনন্দবাজারকে ফোনে বললেন, ‘‘আমার পক্ষে এখানে বসে বলা কঠিন যে, দুই ব্যাটসম্যান ক্রস করেছিল কি না। তবে নিয়মটা খুব পরিষ্কার। ওভার থ্রোর ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটা ধরা হবে থ্রো করার মুহূর্ত থেকে। আর নিয়ম হচ্ছে, যদি ওভার থ্রোতে বাউন্ডারি হয়, তার সঙ্গে ব্যাটসম্যান যে রানটা সম্পূর্ণ করেছে তা যোগ হবে এবং যদি দ্বিতীয় রানের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে থাকে, সেটাও ধরা হবে।’’ ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এর পর তিনি বলছেন, ‘‘রানের প্রক্রিয়া শুরু বলতে কী? না, দুই ব্যাটসম্যানকে ক্রস করতে হবে। তবেই দ্বিতীয় রান যোগ হওয়ার প্রশ্ন আসবে। না হলে এক রানই যোগ হওয়ার কথা বাউন্ডারির সঙ্গে।’’ রিপ্লেতে দেখা গিয়েছে, নিয়ম অনুযায়ী দ্বিতীয় রানের প্রক্রিয়া চালু হয়নি, অর্থাৎ গাপ্টিল যখন থ্রো করেন, তখনও দুই ইংরেজ ব্যাটসম্যান দ্বিতীয় রানের জন্য একে অন্যকে পেরিয়ে যাননি। পিলু বলছেন, ‘‘খুব ভাল করে খুঁটিয়ে না দেখে চূড়ান্ত রায় দিতে চাই না। তবে এখনকার দিনে প্রযুক্তি এসে গিয়েছে। বিশ্বকাপের ফাইনালে ত্রুটি কেন রাখব?’’ যে-হেতু এমন একটা হাড্ডাহাড্ডি ফাইনাল হচ্ছে এবং হার-জিতের ব্যবধান এত কম যে, দু’দলকে আলাদা করা যাচ্ছে না, সেখানে এমন ভুল হওয়ায় আরও বেশি করে কথা উঠছে। মাঠের আম্পায়ার কুমার ধর্মসেনা তাঁর সতীর্থদের সাহায্য নিয়েই ৬ রান দেন ইংল্যান্ডকে। কিন্তু ঠিক দিয়েছিলেন কি? এ দিন অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যমে প্রাক্তন নামী আম্পায়ার সাইমন টফেল বলেন, ‘‘সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। ওটা ছয় রান নয়, পাঁচ রান হবে।’’ টফেলকে মোবাইলে ফোন করা হলে তিনি বক্তব্য থেকে সরে এলেন না। আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘আমি যেটা বলেছি, সেটাই আবার বলব। সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। এর বেশি আর কিছু যোগ করার নেই।’’
শুধু এই একটি ভুল সিদ্ধান্তের জোরে ইংল্যান্ড কাপ নিয়ে গেল, এমন কথা হয়তো কেউ বলছে না। কিন্তু ম্যাচের রং আচমকাই যে অনেকটা পাল্টে দিয়েছিল ওই মুহূর্তটা, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। ওই বলটার আগে ইংল্যান্ডের দরকার ছিল তিন বলে ৯ রান। শেষ ওভার করছিলেন ট্রেন্ট বোল্ট। বেশ কঠিন দেখাচ্ছিল। ওভারথ্রো থেকে ৬ হয়ে যাওয়ায় শেষ দুই বলে টার্গেট ঝুপ করে কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৩। ইংল্যান্ডের আশা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আরও একটা ব্যাপার রয়েছে। আম্পায়ারেরা ৫ রানের বদলে ৬ রান দেওয়ায় স্ট্রাইক পেয়ে যান স্টোকস। নিয়ম মেনে ৫ রান দিলে সেই সময় ব্যাট করার কথা তাঁর পার্টনার আদিল রশিদের। বলটা যখন স্টোকসের ব্যাটে লেগে বাউন্ডারি হয়ে যায়, তখন সকলে বলছিলেন, ভাগ্য আজ ইংল্যান্ডের সঙ্গে। তখনও আম্পায়ারিংয়ের গলদের কথা জানাজানি হয়নি। এখন অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, শুধু দুর্ভাগ্যই নয়, এত বড় আম্পায়ারিং ভুলেরও শিকার হতে হল নিউজ়িল্যান্ডকে।
বিশ্বকাপ ফাইনালকে অনেকেই মহাকাব্যিক আখ্যা দিচ্ছেন। কারও কারও মতে, সর্বকালের সেরা ওয়ান ডে ম্যাচ হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিতে পারে লর্ডসের ফাইনাল। রজার ফেডেরার এবং নোভাক জোকোভিচের উইম্বলডন ফাইনালের মতোই যা থ্রিলার হয়ে উঠেছিল। আর এমন ঐতিহাসিক দ্বৈরথেই কি না ঐতিহাসিক ভুল!
নিউজ়িল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন সব চেয়ে ভদ্র ক্রিকেটারদের এক জন। তিনিও ফাইনালের হারকে ‘লজ্জাজনক’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। দু’বার টাইয়ের পরে ইংল্যান্ডকে জয়ী ঘোষণা করা হয় বেশি বাউন্ডারি মারার জন্য। উইলিয়ামসন বলে যান, ‘‘এত সুন্দর, এত নাটকীয় একটা ম্যাচের পরে যে ভাবে চ্যাম্পিয়নকে বেছে নিতে হল, সেটা লজ্জাজনক।’’ নিউজ়িল্যান্ডের কোচ গ্যারি স্টিড এবং ব্যাটিং কোচ ক্রেগ ম্যাকমিলানকে জিজ্ঞেস করা হয়, দ্বিতীয় বারও যখন টাই হল, তার পরে বাউন্ডারি বেশি মারা দিয়ে বিচার না করে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা উচিত ছিল কি না? তাঁরা দু’জনেই বলেন, এমনটাই ভেবে দেখা উচিত ছিল। এর আগে ভারতীয় দলের কোচ রবি শাস্ত্রী প্রশ্ন তুলেছিলেন, গ্রুপে এক নম্বর হওয়া টিম একটা বাজে দিনের জন্য টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যাবে কেন? অধিনায়ক কোহালিও আইপিএলের মতো প্লে-অফের কথা ভেবে দেখার পক্ষে। শাস্ত্রী যে আনন্দবাজারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যে দলই চ্যাম্পিয়ন হোক, ভারতের চেয়ে বেশি ম্যাচ হেরে বিজয়ী হবে, সে দিকটা নিয়েও ভাবার জায়গা রয়েছে।
টাইয়ের নিয়ম নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে যে, বেশি বাউন্ডারি মারার ব্যাপারটাই আইনে আসবে কেন? আগে নিয়ম ছিল টাই হলে দেখা হবে, কে কম উইকেট হারিয়েছে। এখন সুপার ওভার এসে গিয়েছে। সেখানেও টাই হলে বাউন্ডারি বেশি মারার হিসাব। কিন্তু লর্ডসের ফাইনাল তর্কের ঝড় তুলে দিয়ে গেল। পিলু রিপোর্টার ১৯৯২ বিশ্বকাপে আম্পায়ার ছিলেন। সেই বিশ্বকাপ যেখানে দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে নির্মম এবং অভাবনীয় রায় ভেসে উঠেছিল জায়ান্ট স্ক্রিনে— ১ বল, ২২ রান।
পিলু বলছেন, ‘‘সেই বিশ্বকাপে সকলের আলোচনায় উঠে এসেছিল বৃষ্টির নিয়ম। ১ বল, ২২ রান কেউ ভুলতে পারছিল না। এর পরেই কিন্তু নিয়ম পাল্টানো হল। এ বারে টাই নিয়ে এত কথা উঠছে। দেখা যাক, অদূর ভবিষ্যতে কী হয়!’’