উল্লাস: বিশ্বকাপ নিয়ে ইংল্যান্ড। রবিবার লর্ডসে। রয়টার্স
ববি মুরের পরে নতুন বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক পেল ইংল্যান্ড। অইন মর্গ্যান। ফুটবলে ১৯৬৬। তার পর ক্রিকেটে ২০১৯। ফের বিশ্বজয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে লেগে গেল ৫৩ বছর। এবং কী অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে! রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ পঞ্চাশ ওভারের শেষে টাই হয়ে সুপার ওভার। দু’টো দল এক-এক ওভার করে ব্যাট করবে। সেখানেও দু’টো দল তুলল ১৫ রান। কিন্তু ম্যাচে বেশি বাউন্ডারি মারার জন্য বিজয়ী ইংল্যান্ড।
একই দিনে হওয়া উইম্বলডন ফাইনালের মতোই দুই প্রতিপক্ষ কেউ কাউকে সূচ্যগ্র মেদিনী ছাড়তে নারাজ। উইম্বলডনে রজার ফেডেরার বনাম নোভাক জোকোভিচ। টাইব্রেকারের পর টাইব্রেকার হয়ে চলেছে। এখানেও একই অবস্থা। জোকোভিচের মতোই কান ঘেঁষে চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড। ফেডেরারের মতোই হয়তো বিনিদ্র রজনী অপেক্ষা করছে নিউজ়িল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনের জন্য। ফেডেরার তবু উইম্বলডনের অবিসংবাদী বিজয়ী থেকেই যাবেন। নিউজ়িল্যান্ডের বিশ্বকাপ জয় সেই অধরাই থেকে গেল।
কিন্তু তীরে এসে তরী ডুবলেও সব সময়ে মাটিতে পা রেখে চলা উইলিয়ামসন যে বিশ্বকাপে সকলের হৃদয় জিতে নিয়েছেন, তা বোঝা গেল পুরস্কার বিতরণের সময়ে। টুর্নামেন্টের সেরা হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা হওয়া মাত্র গ্যালারি অভিনন্দনে ভরিয়ে দিল তাঁকে। এমনকি, ভারতীয় দর্শকেরা রোহিত শর্মার পুরস্কার না-পাওয়ার শোক ভুলে জয়ধ্বনি দিতে থাকলেন।
ও দিকে মর্গ্যানের দল এবং ইংল্যান্ডের দর্শকেরা দ্রুতই লর্ডসের দখল নিতে শুরু করেছেন। বিশ্বকাপের শুরু থেকে তাঁরা ছিলেন হট ফেভারিট। মাঝে কয়েকটা ম্যাচ হেরে সংশয় তৈরি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বিশ্বজয়ী হয়েই মাঠ ছাড়লেন জনি বেয়ারস্টো, জস বাটলার, বেন স্টোকসরা। বিশ্বকাপের প্রত্যেকটা মাঠে ‘ভারত আর্মি’ হারিয়ে দিচ্ছিল ইংল্যান্ডের দর্শকদের গ্রুপ ‘বার্মি আর্মি’-কে। শেষ হাসি হাসল তারাই। এ দিন ভিকট্রি ল্যাপের সময়ে ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারেরা সব চেয়ে বেশি করে উৎসবে মাতলেন ‘বার্মি আর্মি’র সদস্যদের সামনে গিয়ে।
ছেষট্টিতে ববি মুরের দলে ছিলেন জেফ হার্স্ট। ওয়েম্বলিতে সে দিনও খেলা গড়িয়েছিল অতিরিক্ত সময়ে। আর হ্যাটট্রিক করে ইংল্যান্ডকে বিশ্বজয়ের স্বাদ দিয়েছিলেন হার্স্ট। লর্ডসের নায়ক বেন স্টোকস। কনকনে ঠান্ডায় স্যাঁতসেঁতে উইকেটে বোলারদের দাপটের মধ্যে ৯৮ বলে ৮৪ রান করে হারের আতঙ্ক থেকে তিনি লড়াইয়ে ফিরিয়ে এনেছিলেন দলকে। এক বছর আগে পানশালায় মারামারি করার জেরে ক্রিকেট জীবনই শেষ হয়ে যাচ্ছিল স্টোকসের। তাঁর হাত ধরেই প্রথম বার বিশ্বকাপ জিতল ইংল্যান্ড। পঞ্চাশ ওভারের শেষে জিততে না-পারলেও ইংল্যান্ড যে টাই করতে পেরেছিল, তার প্রধান স্থপতি ছিলেন স্টোকস। তিনি এবং বাটলার পঞ্চম উইকেটে ১১০ রান যোগ করে মহাকাব্যিক এই জয়ের মঞ্চ তৈরি করে দেন।
যদিও সেই জয় এল নাটকীয় সব মোচড়ের পরে। সুপার ওভারে ইংল্যান্ড প্রথমে ব্যাট করতে নেমে পাঠাল জস বাটলার এবং বেন স্টোকসকে। এর মধ্যে স্টোকস সদ্য ৮৪ নট আউট করে ফিরেছেন। দু’জনে মিলে সুপার ওভারে তুললেন ১৫ রান। নিউজ়িল্যান্ড পাঠাল মার্টিন গাপ্টিল আর জিমি নিশামকে। তাদের দলের দুই সেরা হিটার। তাঁদের সামনে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের সুপার বোলার জোফ্রা আর্চার। দ্বিতীয় বলেই নিশাম মিড-উইকেটের উপর দিয়ে ছয় মেরে দিলেন। শেষ দুই বলে চাই ৩। একটু আগে ঠিক এই পরিস্থিতি থেকেই ইংল্যান্ড ম্যাচ জিততে পারেনি। টাই হয়েছে। আর্চারের সুপার ওভারের পঞ্চম বলে হল ১ রান। লর্ডসকে তখন ঠিক উইম্বলডনের মতো দেখাচ্ছে। একে তো অল ইংল্যান্ড কোর্টের মতোই সবুজ ছিল লর্ডসের পিচ। শুরুতে গুলিয়ে যাচ্ছিল, এখানে বিশ্বকাপ ফাইনাল হবে, নাকি উইম্বলডনের ট্রফির লড়াই? তার উপরে ফেডেরার বনাম জোকোভিচের মতোই চলছে টাইয়ের দ্বৈরথ। শেষ বলে নিউজ়িল্যান্ডের চাই ২ রান। মার্টিন গাপ্টিল মেরেই ছুটলেন দু’রানের জন্য। এবং, এ বারও টাই! এক রান নিয়ে রান আউট হয়ে গেলেন গাপ্টিল। টানটান ফাইনালে দু’দলকে স্কোর দিয়ে আলাদা করা গেল না। পঞ্চাশ ওভারে দু’টো দলই তুলেছে ২৪১। সুপার ওভারে দু’জনেই ১৫।
প্রথমে কেউ বুঝতেই পারছিল না, ইংল্যান্ড সত্যিই জিতেছে? জোফ্রা আর্চারের উন্মাদের মতো দৌড় আর মাঠে স্লাইড করে শুয়ে পড়ার উৎসব দেখেই মনে হল, ইংল্যান্ড বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। সুপার ওভারে টাই হলে কোন দল বেশি বাউন্ডারি মেরেছে, তা দেখা হবে। সেই হিসেবেই চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড! এই নিয়ম নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে। নিউজ়িল্যান্ড সমর্থকেরা বলতে শুরু করে দিয়েছেন, আগে যারা উইকেট কম হারাত, তারাই জিতত। অথচ ইংল্যান্ড অল আউট হওয়ার পরেও চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল।
এ রকমই টানটান উত্তেজনা দেখা গিয়েছে ইংল্যান্ডের শেষ দুই ওভারে। মর্গ্যানের দলের জেতার জন্য সেই সময় দরকার ছিল ২৪। হাতে চার উইকেট। বেন স্টোকস তখনও ক্রিজে আছেন এবং ৬২ ব্যাটিং। ইংল্যান্ড সমর্থক এক দম্পতিকে দেখা গেল শ্যাম্পেন কিনে নিয়ে এলেন। এখনই ইংল্যান্ড জিতবে আর বিজয়োৎসবও শুরু করে দেবেন তাঁরা। কে জানত, সেই শ্যাম্পেন খুলতে খুলতে লেগে যাবে আরও আধ ঘণ্টা। আরও অনেক মোচড় বাকি আছে ফাইনালের থ্রিলারে।
ঊনপঞ্চাশতম ওভার করলেন জিমি নিশাম। ভারতের বিরুদ্ধে যিনি গালিতে দাঁড়িয়ে দীনেশ কার্তিকের অসাধারণ ক্যাচ নিয়েছিলেন। তার চেয়েও চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, বিশ্বকাপ চলাকালীন অনলাইনে একটি ম্যানেজমেন্ট কোর্সের পরীক্ষায় বসেছিলেন তিনি। কারণ? ক্রিকেট খেলাটা মাঝেমধ্যে খুব একঘেয়ে লাগে তাঁর। কখনও যদি একেবারে অসহ্য হয়ে ওঠে, ছেড়েছুড়ে দিয়ে যোগ দেবেন অন্য চাকরিতে। সেই নিশামই এ দিন তাঁর দলকে দারুণ ভাবে প্রতিযোগিতায় রেখেছিলেন। কী বল হাতে, কী ফিল্ডিংয়ে, কী সুপার ওভারে ব্যাট করতে এসে। নিউজ়িল্যান্ডের হয়ে ঊনপঞ্চাশতম ওভারে নিশাম তুলে নিলেন দুই উইকেট। শেষ ওভারটি করলেন ট্রেন্ট বোল্ট। ইংল্যান্ডের দরকার ১৫ রান। চতুর্থ বলে দু’রান সম্পূর্ণ করার জন্য দৌড়চ্ছিলেন স্টোকস। দ্বিতীয় রানটি শেষ করার সময়ে গাপ্টিলের থ্রো স্টোকসের হাতে লেগে বাউন্ডারি হয়ে যায়। সেই গাপ্টিল, যাঁর থ্রো ভারত এবং মহেন্দ্র সিংহ ধোনির দৌড় সেমিফাইনালে থামিয়ে দিয়েছিল। ক্রিকেট যেমন দেয়, তেমন ছিনিয়েও নেয়। শেষ বলে ২ রান দরকার। স্টোকস ব্যাটে লাগিয়ে পড়িমড়ি করে দৌড়লেন দু’রানের জন্য। দ্বিতীয় রান নেওয়ার সময়েই রান আউট। থ্রো করলেন? সেই জিমি নিশাম!
জোরে বোলারদের সহায়ক পিচ। আর সেই সঙ্গে সুইং বোলারদের চনমনে করে দেওয়ার মতো আবহাওয়া। ভোরের দিকে বৃষ্টি হয়েছে। মাঠ শুকিয়ে তোলার জন্য পনেরো মিনিট দেরিতে খেলা শুরু হল। অইন মর্গ্যান এবং কেন উইলিয়ামসন যখন টস করতে যাচ্ছেন, তাঁদের মাথার উপরে আকাশ রীতিমতো কালো। জোরে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। সামনে ব্যাটসম্যানদের হাড় হিম করার মতো সবুজ উইকেট। আর উইলিয়ামসন টস জিতে কি না বলে দিলেন, ‘‘আমরা ব্যাটিং করছি।’’ বিস্মিত হয়ে কেউ কেউ বললেন, এটা কী রকম সিদ্ধান্ত হল? উইলিয়ামসনের হাতে এত ভাল সব ফাস্ট বোলার আছে। যাঁরা ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে সেমিফাইনালে ভারতকে শুইয়ে দিয়ে এসেছে। এই আবহাওয়ায় তাঁদের দিয়ে ইংল্যান্ডের ব্যাটিংকে চাপে ফেলব না? উইলিয়ামসন কিন্তু তখনই তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়ে বলে গেলেন, ‘‘কে প্রথমে ব্যাট করল, কে পরে ব্যাট করল, এ সব ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেবে না। আসল হচ্ছে, কারা ভাল চাপ নিতে পারল। ফাইনালে সেটাই পার্থক্য গড়ে দেবে।’’ শেষে গিয়ে সেটাই হল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের, সেই বিজয়ী দল নিউজ়িল্যান্ড নয়, ইংল্যান্ড। যদিও পরাভূত হিসেবে মোটেও ক্রিকেট মনে রাখবে না উইলিয়ামসনকে। ম্যাচের সেরা বেন স্টোকসের মতোই বন্দিত হচ্ছেন ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট।
লর্ডসের গ্যালারিতে তিনটে রং মিশে গিয়েছিল এ দিন। ইংল্যান্ডের হাল্কা নীল, ভারতের নীল আর নিউজ়িল্যান্ডের কালো। এর মধ্যে ভারতের নীল সমর্থন করছিল ইংল্যান্ডের নীলকে। সম্ভবত নিউজ়িল্যান্ডের কাছেই হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে বলে। এক বার ইংল্যান্ডের দর্শকদের উদ্দেশে গানও ধরলেন ভারতীয়রা, ‘‘ইয়ে দোস্তি, হম নহি তোড়েঙ্গে।’’
এ ছাড়া ফাইনালে ভারতীয় উপস্থিতি বলতে পুরস্কার মঞ্চে সচিন তেন্ডুলকর আর কমেন্ট্রি বক্সে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। আর হ্যাঁ, জায়ান্ট স্ক্রিনে হঠাৎ ভেসে উঠলেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। শোনাতে থাকলেন, হেলিকপ্টার শট আবিষ্কারের কাহিনি। কিছু ক্ষণ দেখার পরে বোঝা গেল, পুরনো বক্তব্যের হাইলাইটস। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারেরা তত ক্ষণে তাঁদের পরিবারকে নিয়ে এসেছেন মাঠের মধ্যে। তাঁদের বাচ্চারা খেলে বেড়াচ্ছে লর্ডসে। বিশ্বজয়ী বাবারা মাঝেমধ্যে এসে তাঁদের কোলে তুলে নিয়ে নাচতে নাচতে মাঠে ঘুরছেন।
স্বাগত, নতুন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন!