কেন হারাকিরি করলেন পন্থ ও পাণ্ড্য?
ভারতের ব্যাটিং লাইন আপ নিয়ে এতদিন ধরে কত স্তুতি, প্রশংসা! যে কোনও টার্গেট দেওয়া হোক, সেই রান খুব সহজেই তুলে ফেলবে বিরাট কোহালির দল। আসল দিনে থেমে গেল ভারতের বিজয় রথ। আজকের দিনের ক্রিকেটে ২৪০ বিশাল কোনও রান নয়। খুব সহজেই এই রান তোলা সম্ভব। বিশেষ করে ভারতীয় দলে যখন রয়েছেন রোহিত শর্মা, বিরাট কোহালি, মহেন্দ্র সিংহ ধোনির মতো ব্যাট। বুধবার কিউয়িদের তোলা ২৪০ রানই এভারেস্ট-সম হয়ে গেল। ১৮ রানে দূরে থেমে যেতে হল ভারতকে।
সাংবাদিক বৈঠকে ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহালি বললেন, প্রথম ৪৫ মিনিটের ব্যাটিং ব্যর্থতায় আমাদের ছিটকে যেতে হল। ভুল কিছু বলেননি ভারত অধিনায়ক। বিশ্বকাপে প্রথম বার বোধহয় এরকম শক্তিশালী বোলিং শক্তির বিরুদ্ধে খেলতে নামল ভারত। বিশ্বকাপের আগে প্রস্তুতি ম্যাচে এই কিউয়িদের বিরুদ্ধেই ১৭৯ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল ভারত। তখন সবাই খুব একটা গুরুত্ব দেননি। প্রস্তুতি ম্যাচ বলে সেই ব্যর্থতাকেও বড় করে দেখা হয়নি। ট্রেন্ট বোল্ট, নীশাম আগুন জ্বালিয়েছিলেন সে দিন। চলতি বিশ্বকাপে দুরন্ত ফর্মে কিউয়ি পেসাররা। ভারতের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে মুখোমুখি হওয়ার আগে কিউয়ি পেসাররা নিয়েছিলেন ৫৮টি উইকেট। এই পরিসংখ্যানেই পরিষ্কার কী দুরন্ত ফর্মে ছিলেন নিউজিল্যান্ডের বোলাররা। আর তাঁদের বিরুদ্ধেই কিনা ভারতের ব্যাটসম্যানরা ভুল শট নির্বাচন করে উইকেট ছুড়ে দিলেন।
গোটা টুর্নামেন্ট জুড়ে রাজ করে গিয়েছেন রোহিত। এক বিশ্বকাপে পাঁচটা সেঞ্চুরি হয়ে গিয়েছে তাঁর। সেমিফাইনালে নামার আগে ইংল্যান্ড, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে টানা তিনটি ম্যাচে সেঞ্চুরি করা হয়ে গিয়েছিল তাঁর। ক্রিকেটে ‘ল অফ অ্যাভারেজ’ বলে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে। টানা রান করতে থাকলে একটা ইনিংসে এসে ব্যাটসম্যানকে ব্যর্থ হতেই হয়। এ দিনের সেমিফাইনাল ছিল সেরকমই একটা ম্যাচ। অফস্টাম্পের সামান্য বাইরের বলে খোঁচা দিয়ে আউট হন ‘হিটম্যান’। তাঁকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। একটা দিন তাঁকে ব্যর্থ হতেই হত। ঘটনাক্রমে আজই ছিল সেই দিন।
আরও পড়ুন : বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেল ভারত, দেখে নিন হারের কারণগুলি
আরও পড়ুন : শত কোটির স্বপ্ন ভঙ্গ ম্যাঞ্চেস্টারে, সেমিফাইনালেই থেমে গেল ভারতের বিশ্বকাপ অভিযান
শেষ চারের বল গড়ানোর আগে বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন, সেমিফাইনালে বড় ইনিংস খেলবেন কোহালি। আসল সময়ে ভারত অধিনায়কও ব্যর্থ। বিশ্বকাপের ইতিহাস বলছে, সেমিফাইনালে কোহালির ব্যাট কথা বলে না। ২০১১ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোহালি করেছিলেন ৯ রান। চার বছর আগের বিশ্বকাপে তিনি আউট হন মাত্র ১ রানে। এ দিনও করেন ১ রান। ক্রিকেট অবশ্য এক বলের খেলা। যে কোনও মুহূর্তে ব্যাটসম্যানের মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে হাজির হতে পারে বোলার। এ দিন বোল্টের ডেলিভারিটা ছিল সেরকমই। কোহালি পরে স্বীকারও করেন, তিনি এবং রোহিত দারুণ বলের শিকার।
শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন রাহুল। আত্মবিশ্বাসে ফোটার কথা ছিল তাঁর। এদিন ব্যর্থ রাহুল। গোটা টুর্নামেন্টে শিখর ধওয়নের বিকল্প হয়ে উঠতে পারেননি তিনি। কিউয়িদের মতো দুর্দান্ত বোলিং শক্তির বিরুদ্ধে তিন জন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানই করলেন মাত্র ১ রান। ৩.১ ওভারেই ভারত হয়ে যায় তিন উইকেটে ৫ রান। এর পরেও কি জেতার আশা করা যায়? দীনেশ কার্তিক ২৫ বলে করলেন মাত্র ৬ রান। কেন তাঁকে এই ম্যাচে খেলানো হল? নির্বাচকরা তো অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখেই কার্তিককে বিশ্বকাপে পাঠিয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার পরিচয় দিলেন কোথায় কার্তিক?
ঋষভ পন্থ জমে যাওয়ার পরে উইকেট ছুড়ে দিয়ে এলেন। ম্যাচের শেষে কোহালি সাফাই দিলেন, ‘‘পন্থের বয়স কম। অল্প বয়সে এরকম ভুল অনেকেই করে থাকে। আমারও যখন বয়স কম ছিল, তখন ভুল করেছি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হতে হবে।’’ এই ধরনের বড় ম্যাচই তো একজন ক্রিকেটারকে প্রতিষ্ঠা দেয়। নিজের সেরাটা আজ দিতেই পারতেন পন্থ। উইকেট ছুড়ে না দিয়ে কেবল সিঙ্গলস নিয়ে পন্থ স্কোর বোর্ড সচল রাখতে পারতেন। বড় শট খেলার দরকার তখন ছিলই না। কেন উইলিয়ামসন ও রস টেলরের থেকে শিক্ষা নিতে পারতেন পন্থ। দুই কিউয়ি ব্যাটসম্যানও কিন্তু বড় শট না খেলে ইনিংস গড়ার কাজ করেন। পন্থ সেদিকে হাঁটলেন না। জমে যাওয়ার পরে ভুল শট খেলে আউট হলেন। তাঁর আউট হওয়ার ধরন দেখে স্থির থাকতে পারেননি কোহালিও। উত্তেজিত হয়ে পড়েন। সাংবাদিক বৈঠকে অবশ্য কোহালি শান্ত।
হার্দিক পাণ্ড্যও একই ভঙ্গিতে ফিরলেন। সেই ভুল শট নির্বাচন করে ‘হারাকিরি’ করে বসলেন। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মতো ম্যাচে এই ধরনের শট খেলা মহা অপরাধ। কে বোঝাবেন পাণ্ড্যদের? ৬ উইকেট হারিয়ে ভারত তখন ধুঁকছে। আইপিএলের সৌজন্যে বিশ্বক্রিকেটের তারকাদের সঙ্গে এখন পাণ্ড্য-পন্থদের ওঠাবসা। তাঁদের কাছ থেকে কি কিছুই শেখেননি পাণ্ড্য-পন্থরা? কঠিন পরিস্থিতি থেকে বহু যুদ্ধের সৈনিক ধোনি ও রবীন্দ্র জাডেজা লড়াই শুরু করেন। দলের সিনিয়র সদস্য হিসেবে ধোনি পরিচালনা করছিলেন জাডেজাকে। এই গাইডেন্সটারই তো দরকার ছিল।
পুরনো দিন এখন ফেলে এসেছেন ধোনি। এখন আর তিনি আগের মতো বিধ্বংসী নন। কিন্তু, অভিজ্ঞতা তাঁকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। জাডেজাকে সঙ্গে নিয়ে স্ট্রাইক রোটেট করে স্কোর বোর্ড সচল রাখছিলেন তিনি। এই কাজটাই তো করতে পারল না ভারতের টপ অর্ডার। উল্টে নিজেদের উইকেট দিয়ে ভারতকে আরও বিপন্ন করে দিলেন তাঁরা। এই হারের পরে ধোনি ক্ষতবিক্ষত হবেন। প্রশ্ন তোলা হবে, ধোনি কেন ফিনিশারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন না? কেন তিনি জাডেজাকে এগিয়ে দিচ্ছিলেন? এ সব প্রশ্ন উঠবেই। ধোনি তো তাও শেষ পর্যন্ত লড়ে গিয়েছেন। প্রায় হারতে বসা একটা ম্যাচে প্রাণসঞ্চার করেছিলেন। দিনটা তাঁর ছিল না। তাই ম্যাচ শেষ না করে প্যাভিলিয়নে ফিরতে হয় তাঁকে।
কিন্তু, বাকিরা কী করলেন? ভারতের তারকা ক্রিকেটাররা আসল সময়ে ভুলে গেলেন ক্রিকেটের প্রাথমিক পাঠ। চাপের মুখে এক বা দু’ রান নিয়ে রান রেট বাড়তে না দেওয়া, উইকেট ছুড়ে না দেওয়া— এ গুলো তো ক্রিকেটের প্রাথমিক পাঠেরই অংশ। মোক্ষম সময়ে এ গুলো কীভাবে ভুলে গেলেন কোহালির সৈনিকরা?