এজবাস্টনে রোহিত শর্মার বিক্রম। ছবি: এএফপি।
মেঘের উপর দিয়ে এখন হাঁটছেন রোহিত গুরুনাথ শর্মা। চলতি বিশ্বকাপে চারটি সেঞ্চুরি করা হয়ে গিয়েছে ‘হিটম্যান’-এর। সচিন তেন্ডুলকরের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছেন তিনি। যে ফর্মে বিলেতে ব্যাট করছেন রোহিত, তাতে এক বিশ্বকাপে ‘মাস্টার ব্লাস্টার’-এর করা সর্বোচ্চ রানের (৬৭৩) রেকর্ড ভাঙল বলে। রোহিতের ছোটবেলার কোচ দীনেশ লাড ছাত্রের বিধ্বংসী ফর্ম দেখে আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘রোহিত নিজেকে এখন পুরোদস্তুর বদলে ফেলেছে। প্রথম ১০-১৫ ওভার খেলে দিতে পারলে ও বড় ইনিংস খেলবেই।’’
রোহিতের এই ব্যাপক পরিবর্তনের কারণ কী? এক সময়ে তো তিনি ভারতীয় ক্রিকেটের মূলস্রোত থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। ক্রিকেট থেকে মন চলে যাচ্ছিল। সেই রোহিতই দুরন্ত ভাবে ফিরে এসেছেন ভারতীয় ক্রিকেটে। রোহিতের আমূল পরিবর্তনের রহস্য ফাঁস করে দীনেশ বলছেন, ‘‘২০০৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত খুবই খারাপ সময় গিয়েছে রোহিতের। ক্রিকেটের প্রতি মন ছিল না। কয়েকটা সিরিজে ভাল পারফর্ম করতে পারেনি। তার উপরে ২০১১ বিশ্বকাপ দলে জায়গা পায়নি। বিরাট কোহালি ঢুকে গেল বিশ্বকাপ দলে। মাঠের বাইরে থেকে রোহিতকে বসে দেখতে হল ভারত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল। এটা প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছিল রোহিতকে।’’ সেই সময়ে ছাত্রকে ‘দ্রোণাচার্য’ বুঝিয়েছিলেন, ‘‘ক্রিকেটের জন্যই আজ তোর যত নাম ডাক। সেই ক্রিকেটকে অবহেলা করছিস কেন?’’
এর পরেই বদলের হাওয়া রোহিতের ক্রিকেট জীবনে। প্রচণ্ড পরিশ্রমে নিজেকে ডুবিয়ে দেন ভারতের ওয়ানডে-র ওপেনার। ছাত্রের কথা বলতে গিয়ে অনর্গল দীনেশ, ‘‘আইপিএল-এ মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে খেলার সময়ে খুব কাছ থেকে সচিনকে (তেন্ডুলকর) দেখে রোহিত। সচিনই ছিল ওর আদর্শ। সচিনকে দেখে অনেক কিছু শিখেছে রোহিত। তার উপরে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের নেতৃত্ব পাওয়ার পরে দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে এখন বদলে গিয়েছে রোহিত।’’
আরও পড়ুন: ৭ ম্যাচে ১ উইকেট, ব্যাট হাতে ১৯ রান, শুধুমাত্র অধিনায়ক বলেই কি দলে মোর্তাজা?
আরও পড়ুন: রোহিতের সেঞ্চুরি না বুম বুম বুমরা... ভারতের জয়ের প্রধান কারণ কী
এ বারের বিশ্বকাপে শুরু থেকেই কথা বলছে রোহিতের ব্যাট। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করে বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করেন ভারতের সহ-অধিনায়ক। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৪০ রানের দুরন্ত ইনিংস খেলেন। ইংল্যান্ড ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও রোহিত-ধামাকা চলে। শেষ দুটো ম্যাচে সেঞ্চুরি করার পর পরই ফিরে যান মুম্বইকর। দীনেশ বলছেন, ‘‘ভুল শট নির্বাচন করায় আউট হয়ে যাচ্ছে। আরও বেশি ক্ষণ ওকে ক্রিজে টিকে থাকতে হবে। রোহিত যদি ক্রিজে আরও বেশি ক্ষণ টিকে যায়, তা হলে দুশো করবেই। ভারতের মিডল অর্ডার দ্রুত রান তুলতে পারছে না। রোহিতকে আরও কিছুক্ষণ উইকেটে থাকতেই হবে।’’
একই ফ্রেমে গুরু ও শিষ্য। বাঁ দিকে রোহিত। ডান দিকে দীনেশ লাড।
এই ভুল শট নির্বাচন খেলে উইকেট ছুড়ে দেওয়ার জন্য এক দিন গুরুর কাছে মার পর্যন্ত হজম করতে হয়েছিল রোহিতকে। সাধারণত কোনও ছাত্রের গায়ে হাত তোলেন না দীনেশ। বকাঝকা করেন, কিন্তু মারধরের রাস্তায় একেবারেই হাঁটেন না। দীনেশ বলছিলেন, ‘‘জানেন তো, মুম্বইয়ের ক্রিকেটমহলে প্রচলিত রয়েছে, উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসা একেবারেই চলবে না। ভাল ডেলিভারিতে আউট হলে অন্য কথা। কিন্তু, খারাপ বলে আউট হওয়া মহা অপরাধ। রোহিত তখন স্কুলের ছাত্র। এগারো-বারো বছর বয়স হবে। একটা ম্যাচে নিজের উইকেট ছুড়ে দিয়ে এল। ম্যাচটা ছিল কোয়ার্টার ফাইনাল। রোহিতের স্কুল স্বামী বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলও জয়ের দোরগোড়া থেকে ফিরে এল। ম্যাচটা হারতে হয়েছিল। রোহিতের আউট হওয়ার ধরন দেখে আমি নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি। রোহিতের কানের পাশে কষিয়ে একটা চড় মেরে বসলাম।’’
খুদে শিক্ষার্থীকে ক্রিকেট শেখাচ্ছেন দীনেশ লাড।
ইংল্যান্ড, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ক্রিজে জমে যাওয়ার পরে ছাত্রের আউট হওয়ার ধরন দেখে নিশ্চয় এখনও নিজেকে স্থির রাখতে পারতেন না দীনেশ। হেসে ফেলেন ‘হিটম্যান’-এর কোচ। বিলেতে থাকা ছাত্রের জন্য মুম্বই থেকে গুরুর উপদেশ, ‘‘ধৈর্য ধরে ক্রিজে থাকো। শট নির্বাচন ঠিক করো। তা হলেই আরও বড় রান পাবে।’’ ‘দ্রোণাচার্য’-এর মতোই গোটা দেশ যে তাকিয়ে রোহিতের চওড়া ব্যাটের দিকে। তিনি চলতে শুরু করলে ভারতও অপ্রতিরোধ্য।