অ্যালিসন ফেলিক্স। ছবি রয়টার্স
যে কোনও অলিম্পিক্সেই বিভিন্ন পদকজয়ী ক্রীড়াবিদদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নানা ধরনের গল্প, অনুপ্রেরণা এবং আত্মত্যাগ। কেউ কেউ যেমন অভাব-অনটনের মতো শত প্রতিকূলতাকে পার করে উঠে আসেন, তেমনই কারওকে লড়তে হয় দুর্নীতির বিরুদ্ধেও। কিন্তু কোটি কোটি ডলারের মালিক এক বহুজাতিক সংস্থার বিরুদ্ধে অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াই? বেশিরভাগেরই সাহসে হয়তো কুলোবে না। এখানেই বাকিদের থেকে আলাদা আমেরিকার স্প্রিন্টার অ্যালিসন ফেলিক্স, যিনি শিরদাঁড়া সোজা রেখে সরাসরি আঙুল তুলেছেন বহুজাতিক ক্রীড়া সংস্থা নাইকি-র দিকে। বাধ্য করেছেন তাদের নীতিতে বদল আনতে। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে আগুন ঝরানোই নয়, ফেলিক্স হয়ে উঠেছেন স্পর্ধার আর এক নাম।
অ্যাথলিট জীবনের প্রায় শেষ পর্বে এসে ফেলিক্স সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মা হওয়ার। কিন্তু নিয়মের বেড়াজাল দেখিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল নাইকি। প্রথমে তাঁর বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ কমিয়ে নেওয়া হয়। তারপর বাতিল করা হয় চুক্তিই। অকুতোভয় ফেলিক্স পাল্টা রুখে দাঁড়িয়েছেন। কোটি কোটি ডলারের মালিক নাইকি-কে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে তৈরি করেছেন নিজের সংস্থা। সেই সংস্থারই বুট পরে অলিম্পিক্স থেকে জিতে এনেছেন সোনা। ফেলিক্সের সাহসকে কুর্নিশ করছে গোটা বিশ্ব।
টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ৪০০ মিটার দৌড়ে ব্রোঞ্জ জিতেছেন ফেলিক্স। তারপরেই আমেরিকার মহিলা দলের হয়ে ৪X৪০০ মিটার রিলে-তে জিতেছেন সোনা। সাতটি সোনা-সহ অলিম্পিক্সে ১১টি পদক নিয়ে তিনিই সর্বকালের সেরা ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড ক্রীড়াবিদ। খোদ উসেইন বোল্টেরও এই নজির নেই। ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিক্স থেকে তাঁর যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা শেষ হল ২০২১-এর টোকিয়ো অলিম্পিক্সে এসে। তবে বিদায় নেওয়ার আগে ফেলিক্স নিজেও মেনে নিয়েছেন, গত চার বছরে জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন সময় কাটিয়েছেন তিনি।
ফেলিক্সের সেই জুতো। ছবি রয়টার্স
টোকিয়ো অলিম্পিক্সে যে তিনি নামবেন এটা একসময় ভাবাই যায়নি। ২০১৬ অলিম্পিক্সে দুটি সোনা এবং একটি রুপো নিয়ে শেষ করার পর ফেলিক্স ঠিক করেছিলেন এ বার সংসার পাতার সময় হয়েছে। মাতৃত্বের স্বাদ নেওয়ার পর মহিলা ক্রীড়াবিদদের ফিরে আসার ঘটনা ভুরি ভুরি রয়েছে। কিন্তু ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের মতো ইভেন্টে তা তুলনামূলক কম। জীবনে বার বার সাফল্যের মুখ দেখা ফেলিক্স তা-ও ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন। ২০১৮-র শুরুর দিকে তিনি সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন। এরপরেই তাঁর জীবনের আসল লড়াই শুরু হয়।
প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ২ লক্ষ ২৩ হাজার কোটি টাকা) সম্পদের মালিক আমেরিকার নাইকি ছিল ফেলিক্সের স্পনসর। তাদের নিয়মকানুনও তেমনই কড়া। অবসর নেওয়ার আগে মহিলা ক্রীড়াবিদদের মা হওয়া যাবে না। হলেই কমিয়ে দেওয়া হবে স্পনসরশিপ বাবদ প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ। গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে ওই সংস্থাকে এ ব্যাপারে জানাননি ফেলিক্স। অনুশীলন করেছেন লুকিয়েই। কিন্তু সত্যিটা বেশিদিন চেপে রাখা গেল না। ফেলিক্সের আসন্ন মাতৃত্বের কথা জানতে পেরেই নাইকি এক ধাক্কায় বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ ৭০ শতাংশ কমিয়ে দিল।
শুধুমাত্র মাতৃত্বের জন্য এত বড় বঞ্চনা মেনে নিতে পারেননি ফেলিক্স। এই নিয়মকে অনৈতিক, সংকীর্ণ মানসিকতার মনে হয়েছিল তাঁর। কিছুদিন পরেই নিউ ইয়র্ক টাইমস সংবাদপত্রের উত্তর-সম্পাদকীয়তে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করলেন। টাকা নয়, তাঁর কাছে লড়াইটা ছিল সম্মানের। ফেলিক্সের দাবি ছিল, একজন মহিলা ক্রীড়াবিদকে মাতৃত্বের কষ্টও সহ্য করতে হবে, আবার মাতৃত্বের স্বাদ নেওয়ার জন্য তাঁর পিছু বরাদ্দের অর্থও কমানো হবে? এ কেমন বিচার! পাশে পেলেন অগণিত ভক্তকে। নিজের স্পনসরের বিরুদ্ধে এ ভাবে আঙুল উঁচিয়ে প্রতিবাদ করার সাহস ক’জন ক্রীড়াবিদ রাখেন? এখানেই ব্যতিক্রমী ফেলিক্স।
চুক্তির খুঁটিনাটি প্রকাশ করে দেওয়ার কারণে ফেলিক্সের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করল নাইকি। ফেলিক্স দমে যাননি। সরাসরি এই অমানবিক আচরণের প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এর মাঝেই শারীরিক সমস্যার কারণে সাত মাসের মাথাতেই সন্তানের জন্ম দিতে হল তাঁকে। একদিকে সন্তানের দেখাশোনা, আর একদিকে প্রতিবাদ। এর মাঝে রয়েছে অলিম্পিক্সের জন্য প্রস্তুতিও। তবে কোনওকিছুই দমাতে পারেনি ফেলিক্সকে। নিউ ইয়র্ক টাইমসে ওই উত্তর-সম্পাদকীয় প্রকাশের পর থেকেই নাইকি-র বিরুদ্ধে তীব্র হচ্ছিল প্রতিবাদ। কয়েক মাস যেতে না যেতেই নীতিতে বদল আনল তারা। কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে গিয়েছে। ফেলিক্স ঠিক করে ফেলেছেন, এর শেষ দেখে ছাড়বেন।
প্রথমে ফেলিক্স একটি অন্য সংস্থা অ্যাথলেটার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলেন। এরপর নিজেই তৈরি ফেললেন একটি সংস্থা। নাম দিলেন ‘সায়েশ’। কিন্তু জুতো তৈরি এবং ডিজাইনিং করতে গেলে বিশেষজ্ঞদের সাহায্য লাগে। ফেলিক্স রাজি ছিলেন না কোনও বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে। তিনি চেয়েছিলেন মহিলাদের। খেলাধুলোর সরঞ্জাম তৈরিতে সিদ্ধহস্ত টিফানি বিয়ার্স প্রথমে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন ফেলিক্সকে। আর এক অভিজ্ঞ নাতালি কানড্রিয়ানও এগিয়ে আসেন। এমন একটি জুতো তৈরি করলেন তাঁরা, যা সাধারণ সময়েও পরা যাবে, আবার দৌড়ের জন্যেও উপযোগী। নাম দেওয়া হল ‘সায়েশ ওয়ান’। জুন মাসে অলিম্পিক্সের ট্রায়ালে প্রথম এই জুতো পরে নামলেন ফেলিক্স। সফল হল পরীক্ষা। এরপর অলিম্পিক্সেও তাঁর পায়ে দেখা গেল একই জুতো।
টোকিয়ো অলিম্পিক্স থেকে দুটি পদক নিয়ে ফিরেছেন ফেলিক্স। প্রত্যেকটি দৌড়ের সময়েই তাঁর পায়ে ছিল নিজের সংস্থার তৈরি ধবধবে সাদা জুতো। শুধু জুতো নয়, তা প্রতিবাদের প্রতীক। যাঁর পায়ে সেটি ছিল তিনি স্পর্ধার আর এক নাম, অ্যালিসন ফেলিক্স।