আত্মপ্রকাশ: পরাধীন ভারতে দু’বার আইএফএ শিল্ড জিতে লড়াইয়ের নতুন বার্তা দিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। ফাইল চিত্র
শতবর্ষ উদযাপনের মধ্যে দাঁড়িয়ে কে বিশ্বাস করবে, শুরুর সেই দিনের সব কাহিনি! কে ভাবতে পারবে, কত বিতর্ক আর লড়াইয়ের পরে তৎকালীন আইএফএ কার্যত বাধ্য হয়েছিল, লাল-হলুদ দলকে কলকাতা ফুটবলের দ্বিতীয় থেকে প্রথম ডিভিশনে তুলতে।
১৯২৫ সালে দ্বিতীয় থেকে প্রথম ডিভিশনে উন্নীত হয় ইস্টবেঙ্গল। মনে করা হয়, কলকাতা ফুটবলের রংই পাল্টে দিয়েছিল এই উত্তরণ। কিন্তু এই পরিবর্তন মোটেই সহজে আসেনি। প্রবল লড়াই করেই প্রথম ডিভিশনে খেলার ছাড়পত্র পেতে হয়েছিল লাল-হলুদকে এবং একটা সময়ে এমনও আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল যে, তাদের হয়তো দ্বিতীয় ডিভিশনেই থেকে যেতে হবে। নেপথ্যে এমনই রাজনীতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মোহনবাগান যেমন ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে মাঠে লড়াই করেছিল, তেমনই মাঠের বাইরের নোংরা রাজনীতির সামনে মাথা নত করেনি।
কলকাতা ফুটবলে বর্ণবিদ্বেষী নীতি থামাতে মোহনবাগানের যোদ্ধাদের মতো ইস্টবেঙ্গলের এই লড়াইও বড় ভূমিকা নিয়েছিল। ১৯১১ সালে মোহনবাগানের সেই ঐতিহাসিক শিল্ড বিজয়ের পরেও কলকাতা ফুটবলের প্রথম ডিভিশনের দরজা সকলের জন্য খোলা ছিল না। কিছুটা উদারনীতি প্রথম দেখা দিল ১৯১৫ সালে। কিন্তু পরবর্তী দশ বছরে শুধু মোহনবাগান এবং এরিয়ান প্রথম ডিভিশন ক্লাবের মর্যাদা উপভোগ করতে থাকল। বাকি সব দলই ছিল ইউরোপীয় বা মিলিটারি দল। ১৯২৪ সালে কলকাতা ফুটবল লিগের দ্বিতীয় ডিভিশনে ইস্টবেঙ্গল এবং ক্যামেরন ‘বি’ দু’দলই প্রথম স্থানে শেষ করল ৩৭ পয়েন্ট নিয়ে। ক্যামেরন ‘বি’ ছিল ব্রিটিশ রেজিমেন্টাল দল। তাদের অন্য একটি দল ইতিমধ্যেই প্রথম ডিভিশনে খেলছিল। তাই নতুন করে আর তাদের প্রথম ডিভিশনে উন্নীত হওয়ার ব্যাপার ছিল না। তারা নিজেদের অংশগ্রহণ প্রত্যাহারও করে নিল। সুযোগ বুঝে ইস্টবেঙ্গল জোরালো ভাবে তাদের দাবি জানাতে থাকে।
কে জানত, ইস্টবেঙ্গল যোগ্য হলেও স্বীকৃতি পেতে অনেক ঘাম ঝরাতে হবে। অনেক বিতর্কের ঝড়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। ইস্টবেঙ্গলের প্রেসিডেন্ট তখন মন্মথনাথ রায়চৌধুরি। সন্তোষের মহারাজা। তখনকার দিনে খুবই প্রভাবশালী ছিলেন উচ্চতর সমাজের ‘ভদ্রলোক’। তাঁর নেতৃত্বেই ইস্টবেঙ্গল দু’টি দাবি জানিয়ে চিঠি দেয়। যা যুগান্তকারী চিঠি হিসেবেই থেকে গিয়েছে ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে। তাঁরা লেখেন, এক) কলকাতা ফুটবল থেকে বর্ণবৈষম্যকে দূর করতে হবে। শ্বেতাঙ্গ বলে তাদের টিমই শুধু খেলার সুযোগ পাবে, এমন নিয়ম রাখা চলবে না। দুই) দ্বিতীয় ডিভিশনে এক নম্বর স্থানে শেষ করা ইস্টবেঙ্গলকেই যোগ্য দল মেনে নিয়ে প্রথম ডিভিশনে খেলতে দিতে হবে।
তীব্র লবিং এবং পাল্টা লবিং শুরু হয়ে যায় ইস্টবেঙ্গলের এই জোড়া চিঠি নিয়ে। আইএফএ বৈঠকে তখন প্রত্যেক দিন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কমিটিতে থাকা অনেক ভারতীয় ক্লাবই বিরোধিতা করতে শুরু করেছিল। কয়েকটি ইউরোপীয় ক্লাব বরং ইস্টবেঙ্গলের পাশে দাঁড়িয়েছিল। এমনকি, এত দূর জল গড়ায় যে, ইউরোপের অনেক ক্লাব হুমকি দেয়, প্রথম ডিভিশন থেকে তারা নাম প্রত্যাহার করে নেবে। কেউ খেলবে না। শেষ পর্যন্ত গরিষ্ঠ সংখ্যক দলের চাপে পড়ে আইএফএ ইস্টবেঙ্গলকে নিয়ে দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। তদানীন্তন পদাধিকারীদের কাউকে কাউকে ইস্তফাও দিতে হয়। বর্ণবৈষম্যমূলক আইনের অবলুপ্তি ঘটে এবং ইস্টবেঙ্গলও প্রথম ডিভিশনে খেলার ছাড়পত্র জিতে নেয়।
শোনা যায়, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্মও হয় মনোমালিন্যের সূত্র ধরে। ২৮ জুলাই, ১৯২০ কোচবিহার কাপে মোহনবাগানের খেলা ছিল জোড়াবাগানের সঙ্গে। তখনকার দিনের তারকা হাফ ব্যাক শৈলেশ বসুকে বাদ দিয়ে দিল জোড়াবাগান। ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং চেয়ারম্যান সুরেশ চন্দ্র চৌধুরী অনুরোধ করলেন তাঁকে খেলানোর জন্য। কিন্তু তাঁর অনুরোধে কেউ কর্ণপাত করল না। রাগে, দুঃখে জোড়াবাগানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন তিনি। এর পরেই রাজা মন্মথনাথ চৌধুরী, রমেশ চন্দ্র সেন, অরবিন্দ ঘোষ, শৈলেশ বসু এবং সুরেশ চন্দ্র চৌধুরী মিলে তৈরি করলেন এক নতুন ক্লাব। ১ অগস্ট, ১৯২০ প্রতিষ্ঠিত এই নতুন ক্লাবের নামকরণ হল ইস্টবেঙ্গল। যে-হেতু প্রতিষ্ঠাতারা পূর্ব বঙ্গের বাসিন্দা ছিলেন। ক্লাব তৈরি হওয়ার পরে অল্প দিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে গেল জার্সিংর রং হবে লাল-হলুদ। জন্মের পরেই প্রথম টুর্নামেন্ট হারকিউলিস কাপে খেলতে নেমে চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। এর পরের নাটকীয় পর্ব মোহনবাগানের সঙ্গে একই মাঠের অংশীদার হওয়া। প্রথম লিগ খেতাব জিততে অবশ্য ১৯৪২ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় ইস্টবেঙ্গলকে। এর পর তারা আইএফএ শিল্ডও জিতল। ইংল্যান্ডের এফএ-র স্বীকৃতিও পেয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। ১৯৫১-৫২ মরসুমে ইস্টবেঙ্গলকে ভারতের সেরা ক্লাব হিসেবে বর্ণনা করেছিল এফএ-র বার্ষিক পত্রিকা। ভারতের রাষ্ট্রপতি ডক্টর রাজেন্দ্র প্রসাদের সুপারিশে রোমানিয়া একটি ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলার জন্য আমন্ত্রণ পাঠায় লাল-হলুদ দলকে। তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নেও খেলতে গিয়েছিল তারা।