বিশ্বসেরা হয়েছেন। দেশকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা থেকে এনে দিয়েছেন পদক। এ হেন হিনা সিন্ধু কিন্তু স্বপ্নেও ভাবেননি পেশাদার শ্যুটার হবেন। তবে ছোট থেকেই তাঁদের বাড়িতে সেই আবহ ছিল। ফলে শ্যুটিংকেই পেশা হিসেবে বেছে নেওয়াটা যেন ছিল সময়ের অপেক্ষা।
৩১ বছরের হিনার জন্ম ১৯৮৯-এ ২৯ অগস্ট পঞ্জাবের লুধিয়ানায়। ছোট থেকেই দেখেছেন, বাড়ির বড়রা পিস্তুল-রাইফেল নিয়ে শ্যুটিং প্র্যাকটিসে মেতে। বাবা জাতীয় স্তরের শ্যুটার। ভাইও ১০ মিটার এয়ার পিস্তল ইভেন্টে নেমেছেন। কাকা ছিলেন বন্দুক বিক্রেতা। এমনকি ক্রেতাদের মর্জিমতো তা তৈরিও করতেন তিনি। ফলে ওই বয়সেই পিস্তল-রাইফেলে চোখ রেখে নিশানায় তাক করাটা হিনার কাছে সহজাত ছিল।
একটি সাক্ষাৎকারে হিনা জানিয়েছিলেন, অলিম্পিকে অংশ নেওয়াটা লক্ষ্য কখনওই ছিল না। বরং শ্যুটিং ভাল লাগত বলেই তা নিয়ে মেতে থাকতেন। শ্যুটিংয়ের প্রতি এই টানই তাঁকে ভবিষ্যতে বহু দূর নিয়ে গিয়েছে বলেও মনে করেন অনেকে।
গোড়ার দিকে পিস্তল নিয়ে নয়, প্রথম ভারতীয় পিস্তল শ্যুটার হিসাবে বিশ্বসেরা হিনার শুরুটা হয়েছিল রাইফেল দিয়ে। তবে রাইফেলের সঙ্গে আনুসঙ্গিক আইপিস, গ্যাস সিলিন্ডার, হেভি জ্যাকেট, জুতো— এ সবই যথেষ্ট খরচসাপেক্ষ। ফলে পিস্তল শ্যুটিংয়ে ঝুঁকেছিলেন হিনা।
ছোটবেলা থেকেই পাটিয়ালা ক্লাবে গিয়ে দীর্ঘ ক্ষণ অনুশীলনে মেতে থাকতেন হিনা। পেশাদার হিসাবে তাঁর শুরুটা হয়েছিল ২০০৬ সালে। জাতীয় স্তরে জুনিয়র এবং সিনিয়র দু’দলেই অংশ নিয়েছেন।
পিস্তল নিয়ে অনুশীলনের ফাঁকে অবশ্য পড়াশোনায় অবহেলা করেননি হিনা। দন্ত চিকিৎসক হবেন বলে জ্ঞান সাগর ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে শেষমেশ সে পথ ছেড়ে পেশাদার শ্যুটার দিকেই ঝোঁকেন তিনি।
হিনার সে সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল, তা বোঝা গেল কেরিয়ারের শুরুতেই। বেজিংয়ে ইন্টারন্যাশনাল শ্যুটিং স্পোর্টস ফেডারেশন (আইএসএসএফ) আয়োজিত বিশ্বকাপে রুপো জিতে নেন হিনা। সালটা ২০০৯।
সে সময় জাতীয় স্তরেও সাফল্য এসেছে হিনার। কেরলে মহিলাদের ১০ মিটার এয়ার পিস্তল ইভেন্টে সোনা জিতে নেন তিনি।
এর পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি হিনাকে। ২০১০-এ দিল্লিতে কমনওয়েলথ গেমসে অনু রাজ সিংহকে সঙ্গে নিয়ে ১০ মিটার এয়ার পিস্তল ইভেন্টে সোনা পান তিনি। সে বার হিনা নিজে ৩৮৪ পয়েন্ট তুলেছিলেন। আর অনু করেছিলেন ৩৭৫। সিঙ্গলসে অবশ্য রুপো নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল তাঁকে।
হিনার মুকুটে আরও এক পালক বসেছিল ২০১০-এ। সে বছরের চিনের গুয়াংঝৌ এশিয়ান গেমসে অনু রাজ সিংহ এবং সোনু রাইকে সঙ্গে নিয়ে দলগত ইভেন্টে ভারতকে রুপো এনে দেন হিনা।
অলিম্পিকেও যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন হিনা। ২০১২-তে লন্ডন অলিম্পিকে কোয়ালিফাইং রাইন্ডে অবশ্য দ্বাদশ স্থান লাভ করেন। ইভেন্ট ছিল, মহিলাদের ১০ মিটার এয়ার পিস্তল। তবে ২৩ বছরের হিনার কাছে তা ছিল অমূল্য অভিজ্ঞতা।
অলিম্পিকের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পরের বছরগুলিতে জোরদার ভাবে ফিরে আসেন হিনা। ২০১৩-তে মিউনিখে বসেছিল আইএসএসএফ বিশ্বকাপের আসর। সে বার সার্বিয়ার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জোরানা আরুনোভিচকে হারিয়ে সাড়া ফেলে দেন হিনা। এর পর সেই ইভেন্টে তৎকালীন চ্যাম্পিয়ন ইউক্রেনের ওলেনা কস্তেভিচকেও পরাস্ত করেন।
২০১৪-তে ফের সাফল্যের কাহিনি। ন্যাশনাল শ্যুটিং ট্রায়ালে ০.১ পয়েন্টের ব্যবধানে হারিয়েছিলেন রাহি স্বর্ণবাটকে। মহিলাদের ১০ মিটার এয়ার পিস্তলে সে সময় কার্যত রাজত্ব করছেন হিনা।
সে বছরই ভারত সরকারের স্বীকৃতি জোটে হিনার। অগস্টে অর্জুন পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
এর পরের বছরগুলিতেও সাফল্যের কাহিনি। ২০১৭-তে ফের ব্রিসবেন কমনওয়েলথ গেমসে তাঁর ইভেন্ট ১০ মিটার এয়ার পিস্তলে সোনা ছিনিয়ে নেন। আগের বছরে রিও ডি জেনেইরো অলিম্পিকেও যোগত্যা অর্জন করেন। তবে সেখানে ১০ মিটার এয়ার পিস্তলে ১৪তম স্থানে শেষ করেন। এবং ২৫ মিটার পিস্তলের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে দ্বাদশ হয়েছিলেন। পরের বছর অস্ট্রেলিয়ার গোল্ড কোস্ট কমনওয়েলথ গেমসে ২৫ মিটার পিস্তলে সোনা পান তিনি। এর পর সে বছরই জাকার্তা এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ জেতেন।
দেশ-বিদেশে বিভিন্ন ইভেন্টের ফাঁকে ২০১৩-তে শ্যুটার রোনক পণ্ডিতকে বিয়ে করেন হিনা। তবে এই আপাতশান্ত জীবনে বেশ কয়েক বার বিতর্কের মুখে পড়েছেন। সম্প্রতি একটি বিজ্ঞাপনে পিস্তল থেকে গুলি ছোড়ার ভিডিয়ো ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করার পরই বিতর্কে জড়ান প্রাক্তন বিশ্বসেরা হিনা। এর আগেও ‘বটল ক্যাপ চ্যালেঞ্জ’-এ বিতর্কে জড়িয়ে প়ড়েছিলেন তিনি ওই শ্যুটার। সেই সময়েও গুলি করার ভিডিও পোস্ট করেছিলেন তিনি। তবে এ সব বিতর্ক বাদ দিলে সাফল্যের অংশটারই পাল্লা ভারী হিনা সিন্ধুর।
শুধুমাত্র পদকের ঝলকানিই নয়। হিনার ব্যক্তিগত জীবন কোনও চিত্রনাট্যের থেকে কম রোমাঞ্চকর নয়। আইএসএসএফ ম্যাগাজিনের কভারে প্রথম ভারতীয় ক্রীড়াবিদ হিসাবে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। শ্যুটিং, কড়া অনুশীলনের ফাঁকে তাঁর জীবনে এসেছে প্রেম। ২০১২-তে লন্ডন অলিম্পিক্স ইউক্রেনীয় কোচ আনাতোলি পুদুভনের সঙ্গে ট্রেনিং চলছিল ২১ বছরের হিনার। সে সময়ই হবু জীবনসঙ্গী রোনক পণ্ডিতের সঙ্গে প্রথম দেখা। তখন থেকেই মন দেওয়া-নেওয়ার শুরু। কড়া ট্রেনিংয়ের ফাঁকে রোনকের সাহায্য পেয়েছেন। অলিম্পিক্সে হিনার পাশে থাকলে লন্ডনেও উড়ে গিয়েছিলেন রোনক।
রোনকের সঙ্গে বছরখানেক প্রেম হিনার। লন্ডন অলিম্পিক্সের পরের বছরই বিয়ে করেন তাঁরা। একসঙ্গে ওঠাবসা, ট্রেনিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে গুছিয়ে সংসার করছেন দু’জনে। রোনক নিজেও ২০০৬ সালের কমনওয়েলথ গেমসের সোনাজয়ী। সে বছরের এশিয়ান গেমসে রুপোর পদকও রয়েছে তাঁর। তবে ১৩ বছরের পেশাদার জীবন শেষে এই মুহূর্তে হিনার কোচও হিসাবেই পরিচিতি পাচ্ছেন রোনক। স্বামীর কোচিংয়ে ফের বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছেন হিনা।