সাউথ ক্লাব।
ভারতীয় টেনিসের ঘাসের কোর্টের ‘আতুঁড়ঘর’ বিপন্ন।
১৯৪৬-এ দেশের প্রথম ঘাসের কোর্টের চ্যাম্পিয়নশিপ হয়েছিল যেখানে, ১৯৪৯-এ এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের আসর বসেছিল যেখানে, সেই সাউথ ক্লাবের ঐতিহ্যময় ঘাসের কোর্ট চরম দুর্দশায় পড়ে আছে।
এক সময় বারোটা ঘাসের কোর্ট ছিল সাউথ ক্লাবে। এখন সাকুল্যে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ছয়। তার মধ্যেই দুটো কোর্ট নষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। মঙ্গলবার সাউথ ক্লাবে গিয়ে দেখা গেল, চারটে কোর্টের ঘাস সবুজ থাকলেও একেবারে প্রান্তে থাকা দুটো কোর্টের সব ঘাস পুরো ধূসর হয়ে গিয়েছে।
কেন হল এমন?
অভিযোগ, আগে কোর্টের পরিচর্যা করতে যে রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হতো এ বার সেই সংস্থা দায়িত্বে নেই। নতুন এক সংস্থা রাসায়নিক সরবরাহ করেছে। তার পরেই এই অবস্থা বলে অভিযোগ। সেপ্টেম্বরে দায়িত্বে আসা ক্লাবের সচিব বিশ্বজিৎ নাগচৌধুরী অবশ্য অভিযোগ মানতে নারাজ। তিনি ফোনে বললেন, ‘‘না না কোর্ট নষ্ট হয়নি। আমরা নতুন একটা পদ্ধতি পরীক্ষা করছি। গত বছরের কমিটিই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নতুন সার ব্যবহার করা হবে। আমরা দুটো কোর্টে সেই সার ব্যবহার করেছি। তাই ঘাসগুলো এ রকম লাগছে। নতুন করে ঘাস গজাতে মাসখানেক লাগবে। এতে কোর্টের ভালই হবে।’’
কিন্তু এর আগের কমিটির প্রেসিডেন্ট এনরিকো পিপার্নো পুরোপুরি অস্বীকার করলেন সচিবের কথা। পিপার্নো ফোনে বললেন, ‘‘গত বছর আমরা ক্ষমতায় থাকার সময় এ রকম কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।’’
ক্লাবের আভ্যন্তরীন কয়েকটি সূত্র থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে, কুড়ি-তিরিশ বছর ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত যাঁরা, তাঁদেরও এ রকম অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। কোর্টের হাল ফেরাতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মালিরা। জল দিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোর্টদুটিতে। তাতে অবশ্য কতটা লাভ হবে
অনেকেই সন্দিহান।
৯৭ বছরের সাউথ ক্লাবের গৌরবময় ইতিহাসে বিল টিলডেন, রয় এমার্সন, জন আলেকজান্ডার, বিজয় অমৃতরাজের মতো তারকাদের খেলতে দেখা গিয়েছে এই ঘাসের কোর্টে। এই কোর্ট থেকেই উঠে এসেছেন দিলীপ বসু, নরেশ কুমার, জয়দীপ মুখোপাধ্যায়, আখতার আলি, প্রেমজিৎ লাল, লিয়েন্ডার পেজ, জিশান আলির মতো দেশের সেরা টেনিস তারকারা। সেই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের পরিচালন ব্যবস্থা এখন প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছে।
জয়দীপ মুখোপাধ্যায় সব শুনে বললেন, ‘‘ভাবতেই পারছি না। সাউথ ক্লাবকে বলা হয় উইম্বলডন অব দ্য ইস্ট। সেখানকার ঘাসের কোর্টের এই অবস্থা শুনে চোখে জল চলে আসে। আমি খেলেছি, কত বিখ্যাত খেলোয়াড় খেলে গিয়েছে এই কোর্টে। খুব কষ্ট হচ্ছে শুনে।’’
নরেশ কুমার বললেন, ‘‘আমি কলকাতায় ছিলাম না। চিকিৎসার জন্য নিউ ইয়র্ক গিয়েছিলাম। সদ্য ফিরেছি। আমিও শুনেছি কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। কিন্তু এ রকম অবস্থা জানতাম না। এক সময় দেশের সেরা টেনিস ক্লাব ছিল সাউথ ক্লাব। কত বড় বড় খেলোয়াড় খেলেছে এখানে। যে-ই খেলেছে, বলেছে ঠিক যেন উইম্বলডনের ঘাসে খেলছে। কী আর বলব। খুব খারাপ লাগছে।’’ পাশাপাশি প্রাক্তন ডেভিস কাপার প্রশ্ন তুলে দিলেন কেন ক্লাব থেকে নতুন প্রতিভা উঠে আসছে না সেই নিয়েও। ‘‘এই ক্লাব থেকে প্রচুর ডেভিস কাপার উঠে এসেছে এক সময়। কিন্তু এখন আর সেটা দেখা যাচ্ছে না। আমি গত বছর বৈঠকে বলেছিলাম ফ্রি-তে কোচিংয়ের ব্যবস্থা করো। অনেকে তো এখানে আসে শুধু ব্যায়াম করতে। এ ভাবে নতুন প্রতিভা উঠে আসবে কী ভাবে,’’ বললেন নরেশ।
শুধু কোর্ট নিয়েই নয়, সমস্যা রয়েছে ক্লাবের ওয়েবসাইটেও। মঙ্গলবার পর্যন্ত সাউথ ক্লাবের সরকারি ওয়েবসাইটে ক্লাব কী কী সুবিধা দেয় তা জানাতে গিয়ে তিন ধরনের কোর্ট মানে ঘাস, ক্লে এবং সিন্থেটিক কোর্টের ছবি দেওয়া রয়েছে বটে। কিন্ত তার পাশে যা লেখা রয়েছে তা দুর্বোধ্য। কী ভাষায় লেখা, কী বোঝাতে চাওয়া হচ্ছে জানার কোও উপায় নেই। অথচ আগাগোড়া ওয়েবসাইটটি তৈরি ইংরেজিতে। সচিবকে এ নিয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি কার্যত মেনেই নিলেন ক্লাবের ওয়েবসাইটের দুরবস্থার কথা। তিনি বললেন, ‘‘ওয়েবসাইটটা ঠিকমতো আপডেট করা হয় না এটা ঠিক। আমাদের ব্যাপারটা নজরে রয়েছে। একটা নতুন সাব কমিটিও করা হয়েছে। তারা এ বার থেকে ওয়েবসাইটের দেখভালের দায়িত্বে থাকবে।’’ জানা গেল, প্রায় মাস খানেক এই কমিটি গড়া হয়েছে। কিন্তু তারা যে কাজ শুরু করতে পারেনি এখনও, সেটা স্পষ্ট।
সাউথ ক্লাবের ঘাসের কোর্টে খেলেছেন প্রাক্তন ফুটবলার চুনী গোস্বামীও। দীর্ঘদিন তিনি ক্লাবের সদস্য। চুনী বললেন, ‘‘কর্তৃপক্ষ একটা পরীক্ষা করতে গিয়েছিল। কিন্তু সেটা কাজে আসেনি। তাই দুটো কোর্টের ঘাস এ রকম লাগছে। আমি বলব নতুন পদ্ধতি ছেড়ে পুরনো পদ্ধতিতে যে ভাবে মালিদের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে কোর্ট তৈরি করা হতো, সেটাই করা হোক।’’
ভারতীয় টেনিসের সবুজ কি তাতে ফিরবে? সময়ই তা বলবে।