এত দিনে কি ‘রাজনীতিক’ দিন্দার জন্ম হল? —ফাইল চিত্র।
কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিয়াছিলেন তিনি মরেন নাই। ময়নায় বিজেপি নেতা বিজয়কৃষ্ণ ভুঁইয়া খুন হয়ে জন্ম দিলেন ‘নেতা’ অশোক দিন্দার।
বাংলার হয়ে ক্রিকেট মাঠে বোলিং আক্রমণকে দীর্ঘ দিন নেতৃত্ব দিয়েছেন দিন্দা। ২০২১ সালে বিজেপির হয়ে বিধানসভা ভোটে তাঁর আগমন রাজনীতির ময়দানে। তবে গত দু’বছরে তাঁকে বিধায়ক হিসাবে তত ‘সক্রিয়’ হতে দেখা যায়নি। কিন্তু তাঁর বিধানসভা কেন্দ্র ময়নায় দলীয় নেতা খুনের পর রাজ্য রাজনীতি অন্য অশোক দিন্দাকে দেখছে। যিনি বিরোধী দলের সদস্যের মতোই ‘সক্রিয়’। দলীয় সহকর্মীর মোটরসাইকেলের পিছনে ঝান্ডা হাতে উঠে পড়ছেন। থানায় ঢুকে পুলিশ অফিসারদের কাছে বিচার চাইছেন। বিক্ষোভে-অবরোধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
এত দিনে কি ‘রাজনীতিক’ দিন্দার জন্ম হল?
বুধবার আনন্দবাজার অনলাইনকে দিন্দা বলেছেন, ‘‘আমি ময়নার উন্নতির জন্য লড়াই করছি বিধানসভায়। এটা ঠিক, যে আমি খেলোয়াড় থেকে রাজনীতিক হয়েছি। কিন্তু আমার এক জন বুথ সভাপতিকে কেউ খুন করে দেবে আর আমি ড্রেসিংরুমে বসে থাকব, এটা তো হতে পারে না! আমি নেতা হওয়ার জন্য নয়, কর্তব্য পালন এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে দায়বদ্ধ। সেটাই করছি। নেতৃত্বের দেখানো পথে আমার লড়াই চলতে থাকবে।’’
আইপিএলে এক সময় কলকাতা নাইট রাইডার্স, রাইজিং পুণে সুপারজায়ান্টসের হয়ে খেলেছেন দিন্দা। ময়দানে তাঁর নাম ছিল ‘নৈছনপুর এক্সপ্রেস’। আর খানিক ‘মাথাগরম’ ক্রিকেটার বলেই পরিচয় ছিল তাঁর। যদিও তাঁর হিতৈষীরা বলেন, মাথা গরম নয়, দিন্দা ক্রিকেটটা খেলতেন ‘প্যাশন’ নিয়ে।
যে ‘প্যাশন’ নিয়ে তিনি প্রকাশ্যে জাতীয় সঙ্গীতের ‘অবমাননা’র প্রতিবাদ করেছিলেন। গত বছর কোলাঘাটে এক ফুটবল প্রতিযোগিতার ফাইনালে গিয়েছিলেন দিন্দা। সেখানে জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর সময় উঠে দাঁড়ান ময়নার বিধায়ক। কিন্তু লক্ষ করেন, দর্শকাসনে অধিকাংশ মানুষ বসে রয়েছেন। পরে বক্তৃতায় সটান বলে দেন, “যখন জাতীয় সঙ্গীত হচ্ছিল অধিকাংশ মানুষই বসেছিলেন। এটা দেখে খুব কষ্ট পেয়েছি। প্রথমে আমি ভারতবাসী। তার পর আমি বাঙালি। সবাইকে জাতীয় সঙ্গীতের সম্মান করতে হবে। সবাইকে জাতীয় সঙ্গীতের গুরুত্ব বুঝতে হবে।’’ বাস্তববাদী দিন্দা আরও বলেছিলেন, ‘‘অনেকেই হয়তো ভাবছিলেন দাঁড়ালে আমাদের জায়গা চলে যাবে। আগে ভারতীয় হয়ে জাতীয় সঙ্গীতকে সম্মান জানানো আমাদের সবার কর্তব্য। আমার অনুরোধ, পরবর্তী সময় যেখানে জাতীয় সঙ্গীত শুনবেন সেখানেই সম্মান জানাবেন।”
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে ময়নায় বিজেপি বিধায়ক অশোক দিন্দা। ফাইল চিত্র।
বাংলার হয়ে ১৪ বছর ক্রিকেট খেলেছেন দিন্দা। ভারতের হয়ে খেলেছেন ২২টি ম্যাচ। সচিন তেন্ডুলকরের শেষ ৫০ ওভারের ম্যাচেও দলে ছিলেন তিনি। ক্রিকেটজীবনের শেষবেলায় বাংলা ছেড়ে গোয়ায় চলে গিয়েছিলেন। গোয়ার হয়ে টি-টোয়েন্টি খেলেছিলেন ২০২১ সালে। ঘরোয়া ক্রিকেটে সেটাই তাঁর শেষ বার মাঠে নামা। দিন্দার সঙ্গে একই সময়ে রাজনীতিতে আসা মনোজ তিওয়ারি রাজ্যের ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েও রঞ্জি খেলে চলেছেন। দিন্দা এখন শুধু ‘লেজেন্ডস লিগ’-এর ক্রিকেটার। তবে প্রাক্তন ক্রিকেটারদের সেই প্রতিযোগিতায় খেলতে নেমেও তাঁর মুখে “জয় শ্রীরাম” স্লোগান থাকে।
ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পর ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিজেপিতে যোগ দেন দিন্দা। ঘটনাচক্রে, সেই দিন দুপুরে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন তাঁর এক সময়ের ক্রিকেট-সতীর্থ মনোজ। তার কয়েক ঘণ্টা পরেই পদ্মশিবিরে যোগ দেন বাংলার প্রাক্তন পেসার। শোনা যায়, বিধানসভা ভোটের কিছু দিন আগে দিন্দার বিজেপিতে যোগ দেওয়া এবং নির্বাচনের টিকিট পাওয়ার পিছনে বড় ভূমিকা ছিল শুভেন্দু অধিকারীর। যে মঞ্চে দিন্দা বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন, সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাবুল সুপ্রিয়, সব্যসাচী দত্তেরা। দিন্দাকে বিজেপিতে আনার পিছনে সেই সময় ভূমিকা ছিল মুকুল রায়, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এখন মুকুল ছাড়া বাকিরা সকলেই তৃণমূলে। কিন্তু দিন্দা এখনও বিজেপির পতাকা হাতেই খেলছেন। সেই ময়দানে তাঁর ‘কোচ’ শুভেন্দু।
শোনা যায়, বিধানসভা ভোটের কিছু দিন আগে দিন্দার বিজেপিতে যোগ দেওয়া এবং নির্বাচনের টিকিট পাওয়ার পিছনে বড় ভূমিকা ছিল শুভেন্দু অধিকারীর। ফাইল চিত্র।
দিন্দার সঙ্গে বরাবরই ভাল সম্পর্ক ছিল শুভেন্দুর। ময়না থেকে জিতে বিজেপির বিধায়ক হওয়ার পরেও শুভেন্দুর ছত্রছায়াতেই উদ্যমী হন দিন্দা। জন্মভূমি ময়নাই আপাতত তাঁর কর্মভূমি। সেখানে কোনও কাজ থাকলে কলকাতায় বিজেপির সভায় দেখা যায় না প্রাক্তন ক্রিকেটারকে। রাজনীতিক হিসেবে তিনি ডাকাবুকো। নিরাপত্তা ছাড়া নিজেই গাড়ি চালিয়ে বিধানসভায় আসেন। বিজেপির পরিষদীয় দলের কাজে নিয়মিত অংশ নেন। ময়নার হয়ে গলাও ফাটান। কিন্তু ময়নায় বিজেপির বুথ সভাপতি খুনের ঘটনার পর দিন্দা তাঁর মাঠে ‘এক্সপ্রেস ডেলিভারি’ শুরু করেছেন।
ময়নায় দলীয় নেতা খুনের প্রতিবাদে মঙ্গলবার রাজ্য সড়কে অবস্থান-বিক্ষোভ শুরু করেছিলেন স্থানীয় নেতারা। সকলের সামনে দিন্দা। পরে সেখানে যান শুভেন্দু। মানুষের অসুবিধার কথা ভেবে প্রথমে দুপুর ২টোর সময় অবরোধ তুলে নেওয়ার কথা বলেন বিরোধী দলনেতা। বিজেপি সূত্রের খবর, তার পরেই দিন্দা তাঁকে অনুরোধ করেন অবরোধ তোলার সময় এগিয়ে আনার। কারণ, জনতার দুর্ভোগ হচ্ছে। দেখা যায়, বেলা ১টায় অবরোধ তুলে নিয়েছে বিজেপি। এবং সেই সিদ্ধান্ত হয় আপৎকালীন ভিত্তিতে। রাজ্য নেতৃত্বকে জানানোর সময় তখন ছিল না।
বিধায়ক দিন্দা প্রথম আলোচনায় এসেছিলেন ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পর এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে। ২০২১ সালের মে মাসে তিনি তখন সদ্য বিধায়ক হয়েছেন। তার পর পরই ইয়াসের প্রভাবে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল ময়নার বিভিন্ন জায়গা। শহরে প্রভাব খুব বেশি না পড়লেও গ্রামে ক্ষতি হয়েছিল। ঝড়ের পর দিনই স্থানীয় কর্মীদের নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলি দেখতে বেরিয়ে পড়েন দিন্দা। কথা বলেন ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠে যাওয়া মানুষদের সঙ্গে। পরে টুইট করেন, “ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত ময়নার এলাকাগুলি দেখতে বেরিয়েছিলাম। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে যে সমস্ত পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং যাঁরা সব হারিয়েছেন, তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কোনও বাধাই ওঁদের সাহায্য করার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে না।”
ক্রিকেটজীবনে মাথায় ‘বান্দানা’ বেঁধে বোলিং রান-আপ শুরু করতেন দিন্দা।এখন তাঁর মাথায় বিজেপির টুপি। ফাইল চিত্র।
প্রাক্তন ক্রিকেটার দিন্দার টুইটার বায়োতে লেখা তিনি ভারত, বাংলা এবং রাইজিং পুণে সুপারজায়ান্টসের ক্রিকেটার। সেখানে তাঁর ‘রাজনৈতিক পরিচয়’ নেই। যদিও কভার এবং ডিসপ্লে ছবি ‘বিধায়ক’ দিন্দার।বস্তুত,তাঁর টুইটারে ক্রিকেটের পাল্লাই ভারী। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে তাঁর ছবি রয়েছে দিন্দার টুইটারে। তবে সবার উপরে বিধায়ক হওয়ার পর জয়ের পোস্টটি।
ক্রিকেটার দিন্দাকে ছাপিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে ‘রাজনীতিক’ দিন্দার দৌড়। আসন্ন পঞ্চায়েত ভোট এবং আগামী বছরের লোকসভা ভোটের আগে তৃণমূল-বিজেপির ‘আইপিএল’ শুরু হয়েছে রাজ্যে। সেই টুর্নামেন্টে দৌড় শুরু হয়েছে ‘নেতা’ দিন্দার।
বুধবার ময়নায় ১২ ঘন্টার বন্ধে বিভিন্ন বাজার, পঞ্চায়েত অফিসে গিয়ে কাজকর্ম বন্ধ রাখার ‘আবেদন’ করেছেন দিন্দা। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে গিয়ে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত দোকানপাট বন্ধ রাখতে বলেছেন। আবার রাস্তায় বসে পড়ে অবস্থান-বিক্ষোভও করেন। পুরোদস্তুর রাজনীতিকের মতো বলেন, “প্রয়োজনে আমাকে গ্রেফতার করা হোক! কিন্তু আমাদের দলের নেতাকে যে ভাবে দিনের আলোয় প্রকাশ্যে টেনে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিবাদ জানানো হবে। মুখ্যমন্ত্রীর পুলিশের উপর আমাদের কোনও ভরসা নেই। আমরা নিজেরাই এলাকা পাহারা দেব।’’ রাজনীতিকের ভাষায় তিনি বলেন, “ময়নার মানুষ আমার উপর ভরসা রেখেছেন। তাই আমি ময়নার পাশে থাকব, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দলে বুথকর্মীরাই সম্পদ। তাঁদের লড়াইতেই জয়-পরাজয়। বুথ সভাপতিরা হলেন আমাদের যে কোনও আন্দোলনের ভিত। বিজয়কৃষ্ণ ভুঁইয়ার মৃত্যু আমার কাছে আপনজন হারানোর যন্ত্রণা।’’
ক্রিকেটজীবনে মাথায় ‘বান্দানা’ বেঁধে বোলিং রান-আপ শুরু করতেন দিন্দা।এখন তাঁর মাথায় বিজেপির টুপি। কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিয়াছিলেন তিনি মরেন নাই। ময়নায় বিজয়কৃষ্ণ ভুঁইয়া খুন হয়ে জন্ম দিয়ে গিয়েছেন ‘নেতা’ অশোক দিন্দার।