প্রতিদ্বন্দ্বী: ময়দানের লড়াইয়ের দুই মুখ অশোক মলহোত্র ও সম্বরণ। ফাইল চিত্র
সালটা ১৯৭৭। তখন আমি বাংলার প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটার। কালীঘাট ক্লাবে খেলি। ওই সময় আমি আর বরুণ বর্মণ কালীঘাট থেকে ইংল্যান্ডে ক্লাব ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিলাম।
তখন কলকাতা ময়দানে এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল যা স্থানীয় ক্রিকেটের ছবিটাই অনেকটা বদলে দেয়। ওই সময় ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সচিব ছিলেন ডা. নৃপেন দাস। আর সিএবি সচিব ছিলেন নরনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় (ঝন্টুদা)। হঠাৎ এক দিন দু’জনের মধ্যে ক্রিকেট নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। নৃপেনদাকে সে দিন ঝন্টুদা বলেছিলেন, ‘‘ইস্টবেঙ্গল ক্লাব আবার কবে ক্রিকেট খেলল?’’
ঝন্টুদার ওই কথাটা রীতিমতো গায়ে লেগেছিল ডা. দাসের। তিনি ক্লাবে ফিরেই ঘরে ডেকে নেন ‘জীপ’কে। ‘জীপ’ অর্থাৎ জীবন চক্রবর্তী এবং পল্টু দাস। ইস্টবেঙ্গলের দল গড়ার পিছনে এই দু’জন প্রায় কিংবদন্তি ছিলেন। তা, দু’জনকে ডেকে নৃপেন দাস বলেন, ‘‘ইস্টবেঙ্গল ক্লাব কি ক্রিকেট খেলতে পারে না? আজই দল গড়তে নেমে পড়ুন। আমাদের ক্রিকেটেও চ্যাম্পিয়ন হতে হবে।’’
তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিল না। পল্টুদারা আমাকে ট্রাঙ্ককলে ইংল্যান্ডে ধরেন। প্রস্তাব দেন ইস্টবেঙ্গলে খেলার। আমি তখন ভারতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখছি। ঠিক করে নিয়েছিলাম, ইস্টবেঙ্গলে খেলব না। কিন্তু সাত দিন বাদে বাদে পল্টুদার ফোন আসত। আর জীবনদা কোথা থেকে আমার ইংল্যান্ডের থাকার জায়গার ঠিকানাটা জোগাড় করেছিলেন। আমি তখন থাকতাম, নটিংহ্যামশায়ারের ১০ মর্লে স্ট্রিটে। সেই ঠিকানায় প্রায়ই চিঠি পাঠাতেন জীবনদা। মুক্তোর মতো হাতের লেখা ছিল। সব চিঠির বক্তব্য মোটামুটি এক। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলতে হবে। আমি এড়িয়ে যেতে লাগলাম। জীবনদা, পল্টুদা তখন বারবার একটা কথাই বলতেন— ‘তুই এলেই দল করব।’
কেন যে ‘জীপ’কে কিংবদন্তি বলা হত, তা বুঝতে পারলাম দেশে ফিরে। সে বছর পুজোর কিছু আগে কলকাতায় ফিরলাম। রাত দশটায় কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে দেখলাম, জীবনদা প্রায় দেড়শো ছেলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘‘কী রে কেমন আছিস। তোকে দেখতে এলাম। কাল তোর বাড়ি যাব।’’
আমি তো পরের দিন একটু বেলা করেই ঘুম থেকে উঠলাম। উঠে দেখি, জীবনদা আমার মায়ের সঙ্গে রান্নাঘরে বসে খোশগল্প জুড়ে দিয়েছেন। বুঝতে পারছিলাম, ঘটনা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে। এর পরে মা এসে আমাকে বললেন, ‘‘তুই ইস্টবেঙ্গলেই খেল।’’ মা সে ভাবে কোনও কালেই ক্রিকেটের ভক্ত ছিলেন না। কিন্তু ওই সময় আমাকে ক্লাব বদল করার কথা বলেছিলেন। আমি মায়ের কথা ফেলিনি। ইস্টবেঙ্গলেই চলে যাই। আমার সঙ্গে সে বার গিয়েছিল এক ঝাঁক বাংলার ক্রিকেটার। যেমন, বরুণ বর্মণ, প্রদীপ পাণ্ডে, ফারাসতুল্লা, অমিতাভ রায়, অলোক ভট্টাচার্য। ইস্টবেঙ্গলের ক্রিকেট-যাত্রাও শুরু ওই বছর থেকে।
আমি চোদ্দো বছর ইস্টবেঙ্গলে খেলেছি। বছর দশেক অধিনায়ক ছিলাম। প্রথম বছরেই (১৯৭৭) আমার নেতৃত্বে একটা ইতিহাস গড়েছিল ইস্টবেঙ্গল। সে বছর মোহনবাগান দলটা দারুণ ছিল। বাংলার সেরা সেরা ক্রিকেটার ওদের দলে ছিল। কিন্তু আমার নেতৃত্বে ইস্টবেঙ্গল চতুর্মুকুট জেতে। লিগ, নকআউট, জে সি মুখোপাধ্যায় এবং পি সেন ট্রফি। তখন নৃপেন দাস গিয়ে ঝন্টুদাকে বলেন, ‘‘কী, আমরা ক্রিকেট খেলতে জানি না?’’ ঝন্টুদা একটু ব্যাকফুটে চলে যান, ‘‘আরে, আমি তো মজা করে বলেছিলাম।’’
সেই শুরু। এর পরে ক্রিকেটেও ময়দান শাসন করতে শুরু করল ইস্টবেঙ্গল। ক্লাবে ভাল ক্রিকেট দল গড়া শুরু হয় এর পর থেকে। আমি টানা ওই ক্লাবে খেলেছি। এক বার শুধু মহমেডানে চলে যাই। তার পরে আবার ফিরে এসে ’৯০ সাল পর্যন্ত খেলি। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে প্রচুর ট্রফি জিতেছি আমরা।
চতুর্মুকুট জয়ের কথায় একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ডিসেম্বরে জেসি মুখোপাধ্যায় ট্রফি ফাইনাল। মোহনবাগানের তখন বোলিং আক্রমণ দারুণ। সমর চক্রবর্তী, সুব্রত গুহ, সুমিত সোমরা সব ছিল। স্যাঁতসেতে উইকেটে খেলা। টস হেরে ব্যাটিং পাই আমরা। দেড় ঘণ্টার মধ্যে আমাদের স্কোর হয়ে যায় ১৯ রানে সাত উইকেট। সেখান থেকে বরুণ আর ফারাসতুল্লা দু’জনেই হাফসেঞ্চুরি করেছিল। আমাদের রান দাঁড়াল ১৪৩। দিনের শেষে মোহনবাগান দু’উইকেটে ৭৮। সবাই ধরে নেয়, আমরা হারছি। গ্যালারিতে মোহনবাগান সমর্থকদের সে কী উল্লাস। পরের দিন মোহনবাগান শেষ ১০৩ রানে! আমরা চ্যাম্পিয়ন। ওই ম্যাচটার কথা বলার একটা কারণ আছে। ওই ম্যাচই ইস্টবেঙ্গলকে ক্রিকেটে অন্যতম শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
ইস্টবেঙ্গলের ক্রিকেট অধ্যায়ের কথা বলতে গিয়ে নানা স্মৃতি মনে ভিড় করে আসছে। যার মধ্যে নানা মজার ঘটনাও আছে। মনে আছে, আমি যখন মাঝে মাঝে পেমেন্ট চাইতে যেতাম নৃপেন দাসের কাছে, উনি আমাকে ‘হোমটাস্ক’ দিতেন। একটা পরিচ্ছেদ দিয়ে বলতেন, ‘‘বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করে আনো।’’ আমি করার পরে হাসতে হাসতে টাকা তুলে দিতেন হাতে। ক্লাবের খারাপ সময়ও দেখেছি আমরা। যখন ইস্টবেঙ্গল ক্লাব রিসিভারের অধীনে চলে গিয়েছিল। তখন টাকা-পয়সা ছিল না। আমাদের পেমেন্ট ঠিক মতো হত না। লাঞ্চও পেতাম না। তখন দেখতাম, পল্টুদা কী ভাবে নিজের চেষ্টায় ধার-দেনা করে টাকা জোগাড় করে আনছেন। ওই সময় আমাদের মধ্যে একটা আলাদা জেদ কাজ করত। প্রতিকূল অবস্থাতেও ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতি ভালবাসা আমাদের মধ্য থেকে সেরা খেলাটা বার করে আনত।
ইস্টবেঙ্গল আমাকে অধিনায়ক করেছে, প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে জীবনকৃতি পুরস্কার দিয়েছে। ইস্টবেঙ্গল আমার কাছে শুধু একটা ক্লাব ছিল না। ছিল একটা মঞ্চ। যে মঞ্চে আমরা বাইশ গজের পাশাপাশি জীবনযুদ্ধে জয়লাভের মন্ত্রও শিখেছি।