নায়ক: ক্রোমাই এই মুহূর্তে লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতা। ফাইল চিত্র
মোহনবাগানের বিরুদ্ধে গোল করে কিবু ভিকুনার লিগ জয়ের স্বপ্নে জোরালো ধাক্কা দিয়েছিলেন এরিয়ানের যে-দুই ফুটবলার, সেই ডিওমান্ডে গ্যাচ ও সন্দীপ ওরাওঁ অক্টোবর থেকেই বেকার হয়ে যাবেন। কারণ কলকাতা লিগ শেষ হলেই ক্লাবের সঙ্গে তাঁদের চুক্তিও শেষ।
পিয়ারলেসের আনসুমানা ক্রোমা, লক্ষ্মী মান্ডিরা দুর্দান্ত খেলে দলকে খেতাবের লড়াইয়ে নিয়ে গিয়েছেন। ষাট বছর পরে তিন প্রধানের বাইরে ছোট ক্লাব হিসেবে লিগ জিতে চমকে দিলেও ওঁদের ভবিষ্যৎ কী, তা নিজেরাই জানেন না।
মহমেডান শেষ পর্বে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রয়েছে লিগ শীর্ষে। ইস্টবেঙ্গল এখনও রয়েছে খেতাবের দৌড়ে। কিন্তু পিয়ারলেস বাকি দু’টি ম্যাচ জিতে গেলেই শেষ হয়ে যাবে দুই বড় ক্লাবের সব আশা। আর মোহনবাগান শেষ তিনে থাকা নিয়েই তো চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা। কিন্তু চমকপ্রদ ব্যাপার হল, লিগে ছোট দলের যে-সব ফুটবলার অমিত-বিক্রম নিয়ে বড় দলকে নাস্তানাবুদ করছেন, তিন মাসের কলকাতা লিগ শেষ হওয়ার পরে তাঁরা ‘ঠিকানাহীন’। ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগানের ফুটবলারদের আই লিগ খেলার সুযোগ থাকলেও ময়দানের ছোট দলগুলির সেই সুযোগ নেই। পিয়ারলেস লিগ চ্যাম্পিয়ন হলেও আই লিগের দ্বিতীয় ডিভিশনে খেলবে না। তা হলে বাকি মরসুম ছোট ক্লাবের ফুটবলারেরা কী করবেন?
কল্যাণীতে দুর্দান্ত গোল করা গ্যাচের সঙ্গে এরিয়ানের চুক্তি ম্যাচ প্রতি কুড়ি হাজার টাকা। আইভরি কোস্টের ওই ফুটবলার বলছিলেন, ‘‘আই লিগের কোনও ক্লাবে ঢোকার চেষ্টা করব। তা না-হলে খেপ খেলব। ক্লাব থেকে আর কত পাই! ওখানেই তো টাকা।’’ আর তাঁর সতীর্থ সন্দীপ ওরাওঁয়ের মন্তব্য, ‘‘জানি না লিগ শেষ হলে কী করব। কোথায় খেলব। কোনও টুনার্মেন্ট তো সামনে নেই। পাড়ার টুর্নামেন্টে খেলব।’’ দুই প্রধানকে হারিয়ে এখনও লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা ক্রোমা। পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন টুনার্মেন্টে খেলে বেড়ানোয় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে গোল করে দলকে জেতানোর আগের রাতেই খড়গপুর থেকে ফিরেছিলেন খেপ খেলে। তাঁর কাছে এখনও কোনও ক্লাবে খেলার প্রস্তাব নেই। শিয়ালদহের কোলে মার্কেটের মেসে রাত কাটানো লক্ষ্মী মান্ডি কী করবেন? পুরুলিয়ার ছেলে পিয়ারলেসের নির্ভরযোগ্য মিডিয়ো বলছিলেন, ‘‘শুধু কলকাতা লিগের জন্য চুক্তি আছে পিয়ারলেসের সঙ্গে। তারপরে চেষ্টা করব আই লিগের কোনও দলে ঢোকার। না-পেলে পাড়ায় পাড়ায় ম্যাচ খেলতে হবে।’’ ক্রোমার মতো একই অবস্থা ভবানীপুরের বিদেশি স্ট্রাইকার বাই কামোর। লিগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতার ভবিষ্যৎও তো অনিশ্চিত।
আইএফএ-তে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গড়ে প্রিমিয়ার লিগের প্রতিটি ক্লাব ৪০-৪৫ জন করে ফুটবলার সই করায় প্রতি বছর। অর্থাৎ প্রায় পাঁচশো ফুটবলার খেলেন লিগে। একশোর মতো ফুটবলার কলকাতা লিগের পরে আই লিগের দু’টি ডিভিশনে খেলার সুযোগ পান। বাকিরা হয়ে যান বেকার। পাড়ায় পাড়ায় খেপ খেলেই কাটে বাকি ন’মাস। আশি শতাংশ ফুটবলার চাকরি করেন না। তাঁদের রুটি-রুজি ফুটবল। পিয়ারলেসের দলটি যাঁর হাতে গড়া, সেই সচিব অশোক দাশগুপ্ত বলছিলেন, ‘‘গত মরসুমে আমরা রানার্স হয়েছিলাম। কয়েক জন ফুটবলার আই লিগের ক্লাবে ডাক পেয়েছিল। বাকিরা খেপ খেলেছে। না-হলে ওদের চলবে কী করে?’’ আর ময়দানের ছোট দলের পোড় খাওয়া কোচ রঘু নন্দী বললেন, ‘‘আমি তো খেপের মাঠে ঘুরে ঘুরেই ফুটবলার খুঁজে আনি। ফিলিপ আজা, গ্যাচ, বাই কামোদের মতো বিদেশিদের তো ওখান থেকেই পেয়েছি।’’ ২৫ বছরেরও বেশি সময় কোচিং করাচ্ছেন বর্তমানে এরিয়ানের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর রঘু। বলছিলেন, ‘‘এরিয়ানের কেউ চাকরি করে না। মাসে মাইনে দশ-পনেরো হাজার। তিন মাসের চুক্তি। খেপ খেলেই তো ওদের সংসার চলে। লিগে ভাল খেললে প্রচারের আলোয় আসা যায়। দর বাড়ে খেপের মাঠে।’’ ভবানীপুরের এক কর্তা বলছিলেন, ‘‘ক্লাব আর কত টাকা দেয়? খেপ খেলেই তো টাকা। অন্তত ২৫ জন ফুটবলারের নাম বলতে পারি, যারা খেপ খেলে বাড়ি-গাড়ি করেছে।’’
খেপ মানে জেলায় জেলায় বিভিন্ন টুনার্মেন্টে বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে প্রতিযোগিতায় ভাড়াটে ফুটবলার হিসেবে খেলতে নামা। বাংলাতেই এক হাজারেরও বেশি টুনার্মেন্ট হয় প্রতি বছর। রাজারহাট থেকে হলদিয়া, মেদিনীপুর থেকে বসিরহাট— খেপ খেলতে যান ময়দানের ফুটবলাররা। তাঁদের নিয়ে যাওয়ার জন্য রয়েছেন ‘খেপ-ম্যানেজার’। ওঁদের কাজটা কী? কলকাতা লিগে ভাল খেলা বিদেশি এবং অন্য ফুটবলারদের সঙ্গে খেপ খেলার জন্য চুক্তি করেন ওঁরা। ক্লাবে খেলে মাসে যে-ফুটবলার পনেরো হাজার টাকা পান, খেপ খেললে তিনিই ম্যাচ প্রতি পান তার দ্বিগুণ। ক্রোমা-কামো-আজাদের মতো বিদেশিদের দর চল্লিশ থেকে ম্যাচ-প্রতি পঞ্চাশ হাজার টাকা। কী ভাবে সংগঠিত হয় খেপের দল? ধরা যাক হলদিয়ায় একটি টুনার্মেন্টে খেলবে সেখানকার কোনও ব্যবসায়ী সমিতি। চ্যাম্পিয়ন হলে তারা পাবে পাঁচ লক্ষ টাকা। ওই ব্যাবসায়ী কমিটি যোগাযোগ করে খেপ-ম্যানেজারদের সঙ্গে। তাঁরাই নিয়ে যান ক্রোমা, কামো, লক্ষ্মী, সন্দীপদের। এই খেপ খেলার দলগঠন অনেকেরই ব্যবসা এখন। আইএফএ-র নিয়মে তাদের নথিভুক্ত ফুটবলারেরা কোনও অননুমোদিত টুর্নামেন্টে খেলতে পারেন না। তাই অনেক সময়েই অন্য নাম নিয়ে খেলতে হয় ফুটবলারদের। লুকিয়ে-চুরিয়ে। রাজ্য সংস্থা অবশ্য এখন এ-সব নিয়ে মাথা ঘামায় না। সবাই জানে, খেপের টাকাই বাঁচিয়ে রেখেছে লিগের ফুটবলারদের।