লিয়োনেল মেসি। ছবি রয়টার্স
বিশ্ব ফুটবলে মেসি-যুগ কি তা হলে শেষ হতে চলল? আর কি দেখা যাবে না তাঁর ফুটবল জাদু?
হঠাৎ এই প্রশ্নটা উঠেছে কারণ, একটি বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কারের প্রাথমিক তালিকায় নাম নেই লিয়োনেল মেসির। সাত বার এই পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। বিশ্বের আর কোনও ফুটবলারের এই কৃতিত্ব নেই। অথচ সেই মেসিই এ বারের পুরস্কারের মনোনয়নের তালিকায় প্রথম ৩০ জনের মধ্যে নেই।
১৯৫৬ সাল থেকে এই পুরস্কার দিচ্ছে ফ্রান্সের একটি পত্রিকা। ২০০৫-এর পর এই প্রথম পুরস্কারের প্রাথমিক তালিকায় নেই লিয়োনেল মেসি। গত বারও তাঁর হাতেই উঠেছে বিজয়ীর ট্রফি। এক বছরের মধ্যে মেসির পারফরম্যান্স এমন কী খারাপ হল যে প্রথম তিরিশের মধ্যেই থাকতে পারলেন না?
প্রথমেই বলতে হবে এই পুরস্কারের বদলে যাওয়া ফরম্যাটের কথা। আগে এই পুরস্কার দেওয়া হত ক্যালেন্ডার বর্ষের বিচারে। এ বার থেকে এই পুরস্কার দেওয়া হবে গত মরসুমের বিচারে। তার পাশাপাশি ফুটবলারের ম্যাচে প্রভাব ফেলার ক্ষমতা এবং ব্যক্তিগত নৈপুণ্যও বিচার্য হবে। পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, দু’টি বিভাগেই পিছিয়ে রয়েছেন মেসি।
বার্সেলোনা থেকে প্যারিস সঁ জঁ-য় (পিএসজি) যোগ দেওয়ার পর প্রথম মরসুম একেবারেই ভাল কাটেনি মেসির। মাত্র ১১টি গোল করতে পেরেছেন। মরসুমের বিভিন্ন সময়ে চোট-আঘাতে ভুগেছেন। দল ঘরোয়া লিগ জিতলেও ইউরোপীয় মঞ্চে ব্যর্থ। অধরা থাকা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতানোর জন্যেই মেসিকে কিনেছিল পিএসজি। তবে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে হেরে শেষ ষোলোয় থেমে যায় তাদের অভিযান। মেসি চূড়ান্ত ব্যর্থ হন। দেশের হয়ে অবশ্য তাঁর পারফরম্যান্স কিছুটা ভাল। গত বছর জুলাইয়ে ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা আমেরিকা জেতে আর্জেন্টিনা। এ বছর জুনে ইটালিকে হারিয়ে ঘরে আসে ফাইনালিসিমা। তবে যে সময়কাল বিচার করে এই পুরস্কার দেওয়া হয়, এই দু’টি ট্রফি তার বাইরে। ফলে ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয়নি।
মেসির কি শেষের শুরু? ছবি রয়টার্স
গত বছর বার্সেলোনা ছাড়ার পর থেকেই মেসিকে পুরনো ছন্দে দেখা যাচ্ছে না। ২০২০-তেও বার্সেলোনার সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। ক্লাব যে সব ফুটবলারকে সই করাচ্ছিল এবং যে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তাদের ছিল, তা দেখে খুশি হতে পারেননি মেসি। আরও ক্ষুব্ধ হন লুই সুয়ারেসকে ক্লাব ছেড়ে দেওয়ায়। সুয়ারেসের সঙ্গে মেসির খুবই ভাল বন্ধুত্ব। প্রিয় বন্ধুর ক্লাব ত্যাগ মানতে পারেননি তিনি। বার্সার সঙ্গে চুক্তি থাকায় তা ভেঙে বেরোনো সহজ ছিল না মেসির পক্ষে। ক্লাবও হুমকি দিয়েছিল মামলা করার। বাধ্য হয়ে থেকে যেতে হয় মেসিকে। তবে পরের বছর চুক্তি শেষ হওয়ায় আটকানো যায়নি।
অনেক ঘটা করে তাঁকে প্যারিসে নিয়ে আসেন পিএসজি-র মালিক নাসের আল খেলাইফি। তবে গত এক বছরে কখনও প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি মেসি। বার্সেলোনায় থাকার সময় তাঁর পায়ের যে ঝলক বা শৈল্পিক ফুটবল দেখা যেত, তা কোথায় হারিয়ে গিয়েছে! অনেকেই মনে করেন, বার্সেলোনায় জাভি-আন্দ্রে ইনিয়েস্তা বা নেমার-সুয়ারেস থাকার সময়ে মেসি যতটা খোলা মনে খেলতে পারতেন, সেটা পরের দিকে পাননি মেসি।
পিএসজি-তে এসে পুরনো বন্ধু নেমারকে পেলেও সেই বোঝাপড়া আগের মতো নেই। বার্সেলোনায় দু’জনে যে সম্মান পেতেন, তা প্যারিসে পাচ্ছেন না। সেখানে বরং অনেক বেশি গুরুত্ব পান ফ্রান্সকে বিশ্বকাপ জেতানো কিলিয়ান এমবাপে। বিরাট অর্থ দিয়ে যাঁর রিয়াল মাদ্রিদে যাওয়া আটকে দিয়েছে পিএসজি।
অনেকেই মনে করছেন, মেসির এটাই শেষের শুরু। আসন্ন কাতার বিশ্বকাপই হয়তো তাঁর শেষ বড় প্রতিযোগিতা। ক্লাবস্তরেও আর কত দিন খেলবেন কেউ জানেন না। মেসি অবসর নিলে কি আগের মতো বিশ্ব ফুটবল অনুসরণ করবেন? আনন্দবাজার অনলাইন প্রশ্ন রেখেছিল দু’জনের কাছে। প্রাক্তন ফুটবলার মানস ভট্টাচার্য বললেন, “কেন দেখব না? বিশ্বকাপ থেকেই তো উঠে এসেছে কিলিয়ান এমবাপের মতো ফুটবলার। তরুণ প্রজন্মের অনেক ফুটবলার উঠে আসছে। কারওর পক্ষেই সারা জীবন খেলে যাওয়া সম্ভব নয়। মেসির ফুটবল জীবন শেষের দিকে। কখনওই আশা করতে পারি না ও এমবাপের মতো ফুটবলারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পুরস্কারের দৌড়ে থাকবে। কেউই কোনও পুরস্কার কুক্ষিগত করে রাখতে পারে না।”
একই কথা বললেন আর এক প্রাক্তনী গৌতম সরকারও। বলেছেন, “যে প্রকৃত ফুটবলপ্রেমী, সে শুধুমাত্র মেসি-রোনাল্ডোর জন্য আন্তর্জাতিক ফুটবল দেখবে না। রোজই নতুন নতুন কত ফুটবলার উঠে আসছে। বিশ্বকাপ থেকে কত ফুটবলার উঠে আসে। তাদের দেখব। মেসি কেন, সবাইকেই এক দিন অবসর নিতে হয়। জায়গা পূরণ করার জন্য কেউ না কেউ ঠিক চলে আসে।”
মেসি মনোনয়নের তালিকায় সুযোগ না পেলেও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো রয়েছেন। জুভেন্টাস থেকে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দিলেও রোনাল্ডোর পারফরম্যান্সে প্রভাব পড়েনি। ক্লাবের হাল যতই খারাপ হোক, রোনাল্ডো ২৪টি গোল করেছেন। দলকে একার হাতে বেশ কিছু ম্যাচে জিতিয়েছেন। স্বাভাবিক ভাবেই পারফরম্যান্স বা ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে মেসিকে টেক্কা দিয়েছেন রোনাল্ডো। একটা সময় এই পুরস্কার পাওয়া নিয়ে মেসি-রোনাল্ডোর লড়াই হত। সেই ঘটনাও এ বার দেখা যাবে না।