ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারেরা। ছবি: এক্স।
মাস যায়। বছর যায়। মরসুম ঘুরে যায়। ইস্টবেঙ্গলের অবস্থার আর পরিবর্তন হয় না। এই নিয়ে চার বার আইএসএল খেলে ফেলল ইস্টবেঙ্গল। প্লে-অফের নিয়ম চালু হওয়ার পর এ বছর প্রথম ছয়ে শেষ করার সুযোগ এসেছিল ইস্টবেঙ্গলের কাছে। পঞ্জাবের কাছে চার গোল খেয়ে সেই সুযোগ শেষ হয়ে গিয়েছে। কোচ যতই বলুন, এটাই তাদের সফলতম মরসুম, সমর্থকেরা সেই দাবি মানতে রাজি নন। উল্টো দিকে থাকা মোহনবাগান যেখানে নিয়ম করে প্রতি বার কোনও না কোনও সাফল্য পাচ্ছে, সেখানে ইস্টবেঙ্গল কেন চার বছর ধরে সেই একই জায়গায় পড়ে রয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে অনেক।
আইএসএলে ইস্টবেঙ্গলকে খেলানোর জন্য এক সময় জোর দাবি উঠেছিল। বিনিয়োগকারী পাওয়া গেলেও তাদের সঙ্গে নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা ইস্টবেঙ্গলকে ভাল ফল করতে দেয়নি। গত দু’বছর ধরে বিনিয়োগকারী হিসাবে রয়েছে ইমামি। গত বছর কোনও মতে দল গঠন করা হলেও এ বছর ভাল কোচ, বেশ কিছু ভাল ফুটবলার এনেও সুপার কাপ ছাড়া সাফল্য পাওয়া যায়নি। ইস্টবেঙ্গল যতই সুপার কাপ জিতুক, ২০ দিনের একটা প্রতিযোগিতা এবং আট মাস ধরে চলা একটা লিগ জেতার মধ্যে তফাত যে বিরাট, সেটা কারও চোখ এড়াচ্ছে না। ইস্টবেঙ্গলের ব্যর্থতার পিছনে উঠে আসছে একের পর এক কারণ।
কোচের অতি আগ্রাসী ভূমিকা
আইএসএল জয়ী কোচকে আনার পরে অনেকেই ভেবেছিলেন, ইস্টবেঙ্গলের সুদিন ফিরছে। সমর্থকদের মন জয় করার চেষ্টা করেছিলেন কার্লেস কুয়াদ্রাত। দলকে একটা ছন্দের মধ্যে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডুরান্ড কাপের ফাইনালে ওঠা, সুপার কাপ জেতা বা কলকাতা ডার্বিতে একাধিক বার মোহনবাগানকে হারানো, এ সব তারই প্রমাণ। প্রথম থেকেই তিনি বলে এসেছিলেন, রাতারাতি কোনও দলকে বদলানো যায় না। এটা একটা ‘প্রসেস’। কিন্তু বড় ক্লাবে ‘প্রসেস’-এর পাশাপাশি ‘সাকসেস’ বা সাফল্যও গুরুত্বপূর্ণ। দলকে ১২ বছর পর ট্রফি জেতালেও লিগের পারফরম্যান্স গোটা বিশ্বেই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। সেখানে কুয়াদ্রাত ব্যর্থ। উল্টে লিগের মাঝে এবং শেষের দিকে তিনি যে ভাবে অতি আগ্রাসন দেখিয়েছেন, তা-ও অনেকের ভাল লাগেনি। একের পর এক ম্যাচে রেফারির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, লাল কার্ড হজম করে নির্বাসন, বিতর্কিত কথা। কোনও কিছুই বাদ রাখেননি। যখন কোচ অতি আগ্রাসী হয়ে যান তখন প্রভাব পড়ে দলের উপরেও। কোচকে দেখে খেলোয়াড়েরাও অকারণে মাথা গরম করেছেন। ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শেষমেশ খারাপ হয়েছে দলের পারফরম্যান্সই।
শুধু তাই নয়, ফুটবলারদের ঠিক মতো করে ব্যবহারও করতে পারেননি। লাল-হলুদের প্রাক্তন ফুটবলার অর্ণব মণ্ডল বললেন, “যদি তরুণদের খেলাতেই হয় তা হলে আরও আগে খেলানো হল না কেন? অন্তত পরের বছরের জন্য আরও ভাল ভাবে তৈরি করে রাখা যেত ওদের। তা ছাড়া, শেষ তিন ম্যাচে কেন উনি এত আক্রমণাত্মক খেলাতে গেলেন দলকে, যেখানে ওদের নিজেদের রক্ষণ অতটা শক্তিশালী নয়? এর দায় কে নেবে?”
সঠিক ফুটবলারের অভাব
ঠিক মতো ফুটবলার না-থাকার অভাব গোটা প্রতিযোগিতায় ভুগিয়েছে ইস্টবেঙ্গলকে। ট্রান্সফার ফি দিয়ে প্রভসুখন গিলকে নিয়ে আসা হলেও বা শৌভিক চক্রবর্তী, নন্দকুমার সেকার, মন্দার রাও দেসাইকে সই করানো হলেও ইস্টবেঙ্গলের রিজ়ার্ভ বেঞ্চ যে শক্তিশালী ছিল না, এ কথা যে কেউ এক বাক্যে স্বীকার করে নেবেন। অনেকে দাবি করতে পারেন, সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়, পি ভি বিষ্ণু বা আমন সিকে তো ছিলেন। কিন্তু তাঁরা তরুণ প্রতিভা। একটা ম্যাচে ভাল গোল করে চমকে দিতে পারেন। কিন্তু খেলা পরিচালনা করা থেকে অভিজ্ঞতা, এ সব ব্যাপারে তাঁরা পিছিয়ে। সময় দিলে প্রত্যেকেই নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেন। তবে কোনও ক্লাবের সাফল্যেই শুধুমাত্র তরুণদের অবদান থাকে না। তাঁরা একটি-দু’টি ম্যাচের রং বদলে দিতে পারেন। কিন্তু গোটা প্রতিযোগিতায় জেতাতে পারেন না।
বিদেশি ফুটবলারদের ব্যর্থতা
ক্লেটন সিলভা ছাড়া আর কোনও বিদেশি গোটা মরসুম একই রকম সাফল্য নিয়ে খেলে গিয়েছেন, এই দাবি কেউ করতে পারবেন না। সাউল ক্রেসপো ভাল, কিন্তু মরসুমের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে চোট-আঘাতে বাইরে ছিলেন তিনি। ওই সময়ে প্রচুর পয়েন্ট নষ্ট করেছে ইস্টবেঙ্গল, যা তাদের প্লে-অফে ওঠার রাস্তায় কাঁটা বিছিয়েছে। হিজাজি মাহের কয়েকটি ম্যাচে নজর কেড়েছেন। তবে বেশ কিছু গোল তাঁর ব্যর্থতায় হজম করেছে ইস্টবেঙ্গল। বোরহা হেরেরা এবং জেভিয়ার সিভেরিয়োকে কেন লোনে অন্য ক্লাবে পাঠানো হল, তা কুয়াদ্রাতই ভাল বলতে পারবেন। সুপার কাপে যে ফুটবলারের জন্য সাফল্য পেয়েছিল ইস্টবেঙ্গল, তাঁকেই ছেড়ে দেওয়া হল! কুয়াদ্রাত যুক্তি দিয়েছিলেন, বোরহা নাকি গোয়ার কোচের অধীনে খেলতে চেয়েছিলেন। তাই তাঁর দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। এখন লিয়োনেল মেসি যদি দাবি করেন তিনি পেপ গুয়ার্দিওলার অধীনে খেলতে চান, তা হলে কি ইন্টার মায়ামি তাঁকে ম্যাঞ্চেস্টার সিটিতে পাঠিয়ে দেবে? কারা এলেন সেই জায়গায়? ভিক্টর ভাজকুয়েজ় এবং ফেলিসিয়ো ব্রাউনের মতো নিম্নমানের বিদেশি। ভিক্টরকে যদিও বা একটু ধরা যায়, ফেলিসিয়োর খেলা চোখে দেখা যায় না। অর্ণবের কথায়, “যাঁদের কুয়াদ্রাত এনেছেন তাদের না বসিয়ে রাখা যাচ্ছে, না খেলানো যাচ্ছে। এ রকম বিদেশিদের তো কোচ নিজেই বেছে এনেছেন। এর দায় তো স্পনসর বা অন্য কেউ নিতে পারেন না। কেন বোরহা এবং সিভেরিয়োকে ছেড়ে দেওয়া হল? সুপার কাপের পর ওরা অন্য ক্লাবে যাওয়া থেকে ইস্টবেঙ্গলের পারফরম্যান্সের গ্রাফ পড়তে শুরু করেছে।”
বার বার ছন্দপতন
চলতি মরসুমে এগিয়ে থেকে বার বার মনঃসংযোগ নড়ে যাওয়ায় হেরে গিয়েছে ইস্টবেঙ্গল। এগিয়ে থেকেও অনেক ম্যাচে ড্র অথবা হারতে হয়েছে। এ ভাবে অন্তত ১২-১৫ পয়েন্ট নষ্ট করেছে তারা। পঞ্জাব এফসি-র বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচের পর কুয়াদ্রাত বলেছিলেন, দলের খেলোয়াড়েরা ৬০ মিনিট পরেই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তা হলে বাকি ম্যাচগুলিতে কী হল? সেখানেও কি খেলোয়াড়েরা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন? উত্তর পাওয়া যায়নি। কুয়াদ্রাত বার বার ঠাসা সূচির কথা উল্লেখ করেছেন। তবে প্রতিটি দলকেই ঠাসা সূচির মধ্যে খেলতে হয়েছে। দু’-একটি বাদে কোনও দল আপত্তি তোলেনি। নির্বিবাদে সূচি অনুযায়ী ম্যাচ খেলেছে। তাই কুয়াদ্রাতের এই যুক্তি যে খাটে না, একথা অনেকেই বলছেন।