ফাইল চিত্র।
সুনীল ছেত্রীকে যত দেখছি, তত মুগ্ধ হচ্ছি। শুক্রবার রাতে হায়দরাবাদ এফসি-র বিরুদ্ধে আইএসএলে ৫০তম গোল করে নতুন কীর্তি গড়ল। গর্ব হচ্ছে এই প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ গোলদাতা আমার প্রাক্তন সতীর্থ ও ছোট ভাই সুনীল।
আই এম বিজয়ন, ভাইচুং ভুটিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, সুনীলের কৃতিত্ব অনেক বেশি। আইএসএলের বিদেশি ডিফেন্ডারদের খেলার মান অনেক উপরে। আমরা যখন খেলতাম, তখন আইএসএল ছিল না। জাতীয় বা আই লিগে সব দলে তখনও বিদেশি ডিফেন্ডার ছিল। কিন্তু মানের দিক থেকে আইএসএলের বিদেশি ডিফেন্ডাররা অনেক এগিয়ে রয়েছে। সুনীলকে গোল করতে হচ্ছে ওদের হারিয়েই। শুধু তাই নয়, আইএসএলে খেলা বিদেশি স্ট্রাইকাররাও দুর্দান্ত। তাদের টপকেই ১১০টি ম্যাচে ৫০টা গোল ও করে ফেলল।
সুনীলের সঙ্গে আমার পরিচয় ২০০২ সালে মোহনবাগানে খেলার সময়। ওর বয়স তখন মাত্র ১৮। প্রথম দিন সুনীলকে অনুশীলনে দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম, ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। সেই সময় অনেকেই আমার মতামতকে গুরত্ব দেয়নি। ওদের যুক্তি ছিল, এত কম উচ্চতা নিয়ে স্ট্রাইকার হিসেবে সফল হওয়া অসম্ভব। কেউ কেউ তো মনে করত, সুনীলের উচিত মাঝমাঠে নেমে এসে খেলা। এক জন ভাল স্ট্রাইকারের সব চেয়ে বড় গুণ হল, বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সের মধ্যে ক্ষিপ্রতা ও অনুমান ক্ষমতা। সুনীলের মধ্যে এই দুটোই ছিল দুর্দান্ত। প্রথম দিন থেকেই দেখেছিলাম, পেনাল্টি বক্সের মধ্যে ও ভয়ঙ্কর। দশটার মধ্যে অন্তত আটটা শট তো গোলে রাখতই। ও যেন গোলের গন্ধ পায়। এই কারণেই সুনীলের উচ্চতা কম হওয়া নিয়ে আমি কখনও চিন্তিত হয়ে পড়িনি। জানতাম, এই খামতি পূরণ করার ক্ষমতা ওর আছে। সুনীল নিজের উচ্চতা বাড়াতে পারবে না ঠিকই। তবে স্পট জাম্পের মাধ্যমে এই দুর্বলতা অনেকটাই দূর করতে পারবে। কারণ লাফানোর জন্য প্রয়োজন ফিটনেস ও শারীরিক শক্তি। যা পরিকল্পনা অনুযায়ী বিশেষ অনুশীলনের মাধ্যমে বাড়িয়ে নেওয়া খুব একটা কঠিন নয়। তা ছাড়া সুনীলের শরীর এমনিতেই নমনীয়। তাই ওর খুব একটা সমস্যা হবে না।
মোহনবাগানে তখন আমাদের কোচ ছিলেন সুব্রত ভট্টাচার্য। শারীরিক শক্তি বাড়ানোর জন্য সুনীলকে নানা ধরনের অনুশীলন করাতেন। কোমরে মোটা টায়ার বেঁধে দৌড় করানো থেকে, আরও নানা ধরনের ট্রেনিং করাতেন। সুনীল নিজেও ওর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। তাই মন দিয়ে অনুশীলন করত। কখনও ফাঁকি দিতে দেখিনি। সুনীলের এই অধ্যবসায় দেখে আমরা অবাক হয়ে যেতাম। ধীরে ধীরে ও উচ্চতার খামতি পূরণ করতে সফল হয়। বিপক্ষের ছ’ফিট উচ্চতার ডিফেন্ডারদের মাথার উপর দিয়ে অসংখ্য গোল সুনীল করে চলেছে।
আমার মতে সুনীলের এই চমকপ্রদ উত্থানের অন্যতম কারণ এক বছরের মধ্যে মোহনবাগান ছেড়ে ওর জেসিটিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। সেখানে বিজয়নের মতো কিংবদন্তি স্ট্রাইকারকে পাশে পেয়েছিল ও। যা সুনীলের খেলা বদলে দিয়েছিল। তা ছাড়া কলকাতায় সব সময় চাপ অনেক বেশি থাকে। বহু প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলারকে দেখেছি এই চাপ সামলাতে না পেরে হারিয়ে যেতে। বাবলুদা (সুব্রত ভট্টাচার্য) যদিও সুনীলকে আগলে রাখতেন। ম্যাচে অল্প সময়ের জন্য মাঠে নামাতেন। যাতে ধীরে ধীরে কলকাতার চাপ সামলানোর জন্য তৈরি হতে পারে ও। কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না।
জেসিটিতে যাওয়ার পর থেকেই সুনীলের খেলা সম্পূর্ণ বদলে গেল। আরও বেশি ভয়ঙ্কর ও পরিণত হয়ে উঠল ও। আসলে বিজয়ন ভাইয়ের সঙ্গে খেলা মানেই নতুন নতুন অনেক কিছু জিনিস শেখার সুযোগ থাকে। সবচেয়ে বড় কথা, একেবারে চাপমুক্ত হয়ে খেলা যায়। বিজয়ন ভাই যে দলে থাকে, সেখানকার পরিবেশ সব সময়ই ফুরফুরে হয়। সুনীলের পক্ষে যা আশীর্বাদ ছিল। নিজে তো গোল করতই, সতীর্থদের গোল করানোর দায়িত্বও কাঁধে তুলে নিয়েছিল। ভাইচুংও ওকে নানা ভাবে সাহায্য করেছে।
সুনীলের আরও একটা বড় গুণ— শৃঙ্খলা। আমরা অনেক সময়ই নিয়ম ভাঙতাম। সুনীল ব্যতিক্রম। রাত ন’টার মধ্যে শুয়ে পড়ত। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারেও প্রচণ্ড কড়া। আসলে ওর বাবা সেনাবাহিনীতে ছিলেন। কড়া অনুশাসনে ছেলেকে বড় করেছেন। তাই ছোটবেলা থেকেই সুনীল শৃঙ্খলাপরায়ণ। এই কারণেই এই ৩৭ বছর বয়সেও শুধু বেঙ্গালুরু এফসি নয়, ভারতীয় দলেরও এক নম্বর স্ট্রাইকার ও। সুনীলের বিকল্প এখনও পাওয়া যায়নি। আমার মতে সুনীল ভারতের সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকার। কারণ, ওর লড়াই অনেক বেশি কঠিন।
এই মুহূর্তে দেশের জার্সিতে গোল করার নিরিখে লিয়োনেল মেসির পাশেই রয়েছে সুনীল। দু’জনেই ৮০টি করে গোল করেছে। আশা করব মার্চ মাসে দু’টি আন্তর্জাতিক ফ্রেন্ডলিতেই ও টপকে যাবে মেসিকে।