সম্রাট: ব্রাজিলের জার্সিতে পেলে। ফাইল চিত্র
ফুটবল সম্রাট আর নেই খবরটা শোনার পর থেকেই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। মনে পড়ে যাচ্ছে ফুটবল সম্রাটের বিরুদ্ধে খেলার সুযোগ পাওয়ার সেই স্মরণীয় মুহূর্ত। আমার ফুটবলজীবনের সেরা প্রাপ্তি। মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলাম পায়ের জাদু।
১৯৭৭ সাল। মোহনবাগানের অধিনায়ক আমি। শ্যাম থাপা, সুধীর কর্মকার, মহম্মদ হাবিব, মহম্মদ আকবর, গৌতম সরকারের মতো নক্ষত্রদের নিয়ে দুর্দান্ত দল ছিল আমাদের। মাথার উপরে ছিলেন প্রদীপ কুমার (পিকে) বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কোচ। কিন্তু শুরুতেই বিপর্যয়। কোচিতে ফেডারেশন কাপে আইটিআই-এর কাছে হার। তার পরে কলকাতা লিগের ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গল হারিয়ে দেয় আমাদের। মানসিক ভাবে আমরা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিলাম।
সামনেই ডুরান্ড, রোভার্স-সহ একাধিক প্রতিযোগিতা। কিন্তু আমাদের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর সেই তাগিদটাই যেন হারিয়ে গিয়েছিল। ঠিক তখন নাটকীয় ভাবে বদলে গেল পরিস্থিতি। এক দিন অনুশীলনের পরে আমরা মাঠের মধ্যে গোল হয়ে বসে রয়েছি। মোহনবাগানের তৎকালীন সর্বময় কর্তা ধীরেন দে বললেন, ‘‘মোহনবাগানের বিরুদ্ধে খেলতে কলকাতায় আসছেন ফুটবল সম্রাট পেলে। ক্লাবের সম্মানরক্ষার দায়িত্ব তোমাদের।’’ পেলে তখন নিউ ইয়র্ক কসমসে খেলেন। তিনি কলকাতায় আসবেন, তা-ও আবার মোহনবাগানের বিরুদ্ধে খেলতে, বিশ্বাসই হচ্ছিল না প্রথমে। তার পরেই মনে হল, ধীরেনদার মতো মানুষ যখন বলছেন, নিশ্চয়ই ফুটবল সম্রাট আসবেন। মুহূর্তের মধ্যেই আমরা চনমনে হয়ে উঠলাম। প্রদীপদাও উত্তেজিত। সে দিন থেকেই তিনি শুরু করে দিলেন রণকৌশল তৈরি করতে।
রক্ষণ, মাঝমাঠ ও আক্রমণ— ফুটবলারদের প্রদীপদা তিনটি দলে ভাগ করে অনুশীলন শুরু করলেন। প্রথম দিন থেকেই তিনি জোর দিয়েছিলেন রক্ষণ ও মাঝমাঠের উপরে। এখনও মনে আছে আমাকে ও হাবিবদাকে মাঠের একধারে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘হাবিব তুমি পেলের সঙ্গে ছায়ার মতো ঘুরবে। ও যেখানে যাবে, তুমিও যাবে। এক মুহূর্তের জন্য পেলেকে ছাড়বে না।’’ এর পরেই আমাকে বললেন, ‘‘বাবলুবাবু মনে রাখবে মোহনবাগানের সম্মান তোমার উপরেই নির্ভর করছে। পেলেকে শেষ ট্যাকলটা তোমাকেই করতে হবে। ফুটবল সম্রাটকে বল নিয়ে ঘুরতে দেওয়া মানেই বিপর্যয় ডেকে আনা। গোল আটকানো অসম্ভব। তাই কোনও মতেই পেলেকে বল নিয়ে ঘুরতে দিয়ো না।’’ পেলে কী ভাবে বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের ধরাশায়ী করে বক্সে ঢুকে গোল করেন, সেই ভিডিয়ো ক্লিপিংস আমাদের সকলকে দেখিয়েও ছিলেন প্রদীপদা।
শুরু হল আমাদের পেলেকে আটকানোর বিশেষ প্রস্তুতি। অনুশীলন শেষ করে বাকি ফুটবলাররা ড্রেসিংরুমে ফিরে গেলেও আমি হাবিবদা ও আকবর পড়ে থাকতাম মাঠে। জল ঢেলে দিয়ে ওদের বলতাম বল নিয়ে বক্সে ঢোকার চেষ্টা করো, আমি আটকাব। দিনের পর দিন আমরা এই অনুশীলন করার উপকার পেয়েছিলাম ম্যাচের দিন। ইডেনে সে দিন পেলেকে বল নিয়ে একবারও ঘুরতে দিইনি আমি। অবিশ্বাস্য খেলেছিল হাবিবদাও। সারাক্ষণ পেলের সঙ্গে ছায়ার মতো ঘুরছিল। বল ধরলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছিল কেড়ে নেওয়ার জন্য। ২-২ গোলে ম্যাচ শেষ হওয়ার পরে অদ্ভুত তৃপ্তি হচ্ছিল। চিৎকার করে ধীরেনদাকে বলেছিলাম, ফুটবল সম্রাটের দলকে আমরা আটকাতে পেরেছি। মোহনবাগানের সম্মান নষ্ট হতে দিইনি।