ইউরো কাপের ফাইনালে স্পেন বনাম ইংল্যান্ড কাপযুদ্ধে জিতবে কে? ছবি: রয়টার্স।
এক দিকে স্পেন, যাদের অস্ত্র পাসের ফুলঝুরির সঙ্গে গতি মিশিয়ে জমাটি আক্রমণ। আর একটা দল কৌশলে একটু ধীরগতির, কিন্তু ৯০ মিনিটই অকুতোভয়। এক দলের কোচ নির্দিষ্ট কোনও নেতায় বিশ্বাস করেন না। আর এক দলের কোচ বড় নামকে বসিয়ে দিতে ভয় পান ঠিকই, কিন্তু দলের তরুণ ফুটবলারদের এগিয়ে দিতেও দ্বিধা করেন না। রবিবার ইউরো কাপের ফাইনালে স্পেন বনাম ইংল্যান্ড কাপযুদ্ধে এ রকম অনেক বিষয় রয়েছে, যা ম্যাচের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেবে। খাতায়-কলমে যে দলই এগিয়ে থাকুক, যুদ্ধের শেষে কোন দল শেষ হাসি হাসবে তা নিয়ে বাজি ধরা বেশ কঠিন।
২০০৮ থেকে ২০১২। চারটে স্বপ্নের মতো বছর। দুটো ইউরো কাপ। একটা বিশ্বকাপ। সোনালি প্রজন্ম। বিশ্বের সেরা দল। জাদুর মতো তিকিতাকা ফুটবল। আরও কত কী!
স্পেনের ফুটবলের পাশে বসানোর মতো বিশেষণের কোনও কমতি ছিল না সেই সময়ে। কত কী-ই না লেখা হয়েছে ‘লা রোজ়া’দের নিয়ে। সেই দুর্গে প্রথম ফাটল ধরল ২০১৩ সালে, ব্রাজিলের কাছে কনফেডারেশনস কাপ ফাইনালে হারের পর। দ্বিতীয় ধাক্কা ২০১৪ সালের বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের হাতে ১-৫ গোলে চূর্ণ হওয়ার পর। তৃতীয় ধাক্কা ২০১৬-র ইউরোয় ইটালির কাছে হেরে বিদায় নেওয়ার পর।
২০১২ সালের ইউরো জেতার পর থেকে কত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই না গিয়েছে স্পেন। ফুটবলের ইতিহাসে কোনও সাম্রাজ্য এ ভাবে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে কেউ কখনও দেখেনি। যারাই নতুন সাম্রাজ্য গড়েছে, অন্তত এক-দু’দশক থেকেছে। স্পেন ছিল ব্যতিক্রম। যত দ্রুত তারা ফুটবলবিশ্বের উপরে উঠে এসেছিল, তত দ্রুত তাদের পতন হয়। একটা গোটা প্রজন্ম দলকে সাফল্যের শিখরে তুলেও চূড়ান্ত ব্যর্থতার মধ্যে বিদায় নিতে বাধ্য হয়।
বার্সেলোনায় পেপ গুয়ার্দিওলা এবং জাতীয় দলে ভিসেন্তে দেল বস্কের হাত ধরে যে নবজাগরণ স্পেনের ফুটবলে শুরু হয়েছিল, তা শেষ হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ২০১৬-য় ইউরো থেকে বিদায় নেওয়ার পর স্পেনের বেশির ভাগ কাগজই ফলাও করে লিখেছিল, ‘সব শেষ’। ২০১৮ বিশ্বকাপে রাশিয়ার কাছে হার সেই ধারণা আরও পোক্ত করে। ২০২০ ইউরোয় কিছুটা ভাল খেললেও, ২০২২ বিশ্বকাপে মরক্কোর মতো দলের কাছে হার। ঘুরে দাঁড়ানোর রসদ আর কিছু ছিল না।
কিন্তু অন্য রকম ভেবেছিলেন এক জন। তিনি লুই দে লা ফুয়েন্তে। লুই এনরিকে-কে সরিয়ে তাঁকে কোচ করে আনার পর অনেকেই স্পেনের ফুটবল সংস্থার সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু সিদ্ধান্তটা যে ভুল ছিল না তার প্রমাণ স্পেনের এই ফল।
ফুয়েন্তের শুরুটা হয়েছিল খারাপ ভাবেই। শুরুতেই স্কটল্যান্ডের কাছে ০-২ হার। স্পেন সংস্থা আস্থা হারায়নি। ভরসা রেখেছিল ফুয়েন্তের উপরে। এখন তারই পুরস্কার পাওয়া যাচ্ছে। গত বছর নেশন্স লিগ জিতে ১১ বছরের ট্রফি খরা কাটিয়েছিল স্পেন। এ বার ইউরো জিতে তাদের সামনে বড় মঞ্চে আবারও দাপট প্রমাণ করার সুযোগ।
স্পেনের এই দলে বড় কোনও নাম নেই। এই দলে ৩৮ বছরের জেসুস নাভাসও খেলেন। এই দলে ১৬ বছরের লেমিনে ইয়ামালও খেলেন। এই দলে যেমন ক্লাব স্তরে সাফল্য পাওয়া রদ্রির মতো ফুটবলার রয়েছেন, তেমনই চেলসিতে ব্যর্থ মার্ক কুকুরেয়া বা আল নাসেরে নজর কাড়তে না পারা আয়মেরিক লাপোর্তেও রয়েছেন। কিন্তু তারকা না থাকাই বাড়তি সুবিধা স্পেনের। কোচ ফুয়েন্তে বলেছেন, “আমার হাতে ২৬ জন ফুটবলার রয়েছে এবং আমি ভাগ্যবান যে তারা সবাই স্পেনীয়।”
ইংল্যান্ডের কোচ সাউথগেট বড় নাম বসাতে ভয় পান। ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ের দেশঁ কিলিয়ান এমবাপে-নির্ভর দল থেকে বেরোতে পারছেন না। সেখানে ফুয়েন্তের দলে সবাই নেতা। সবার ভূমিকা, সবার নির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি কাজে লাগিয়ে দলটাকে সঠিক পথে এগিয়েও নিয়ে যাচ্ছেন। এই দল সোনালি প্রজন্মের মতো ‘তিকিতাকা’ খেলে পাসে পাসে ভরিয়ে দেয় না। আবার তুমুল আক্রমণ করে কাউন্টার অ্যাটাকে গোলও খায় না। তারা পাস খেলে। খেলতে খেলতেই চকিতে বিপক্ষের বক্সে ঢুকে পড়ে। গোটা ব্যাপারটাই মাখনের উপরে ছুরি চালানোর মতোই মসৃণ।
এই যদি স্পেনের বৃত্তান্ত হয়, তা হলে সাউথগেটের ইংল্যান্ডও পিছিয়ে থাকবে না। রবিবারের ফাইনালে নামার আগে ইংরেজ সমর্থকেরাও ট্রফি জয়ের আশায় বুক বাঁধছেন। কারণ শেষ কয়েক বছরে ইংল্যান্ড বদলে গিয়েছে। সাউথগেটের প্রশিক্ষণে ইংল্যান্ড এখন নকআউটে কেঁপে যায় না, টাইব্রেকারে জিততে জানে। রবিবার রাতে যে ইংরেজ দল খেলতে নামবে, তাদের সেই হার না মানা মনোভাব সত্যিই অপরিচিত।
এ বারের ইউরো কাপে ইংল্যান্ড কখনও ভাগ্যের সাহায্য পেয়েছে, কখনও পেনাল্টিতে গোল করে জিতেছে, কখনও শেষ মিনিটের গোলে জিতেছে। আগে সাধারণত এগুলি ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে হত। কিন্তু এ বারের ইউরো কাপে ইংল্যান্ডের জার্সিধারী ফুটবলারেরাই এই সব কাণ্ড ঘটিয়েছেন।
১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে ঘরের মাঠে পশ্চিম জার্মানিকে ৪-২ গোলে হারিয়ে জিতেছিল ইংল্যান্ড। সিনিয়র ফুটবলে সেটাই ইংল্যান্ডের একমাত্র ট্রফি। এ বারের ইউরো কাপে বদলে যাওয়া ইংরেজ দল সম্পর্কে কোচ সাউথগেট বলেন, “আমরা শুধু একটা প্রতিযোগিতা নিয়ে ভাবিনি। শুধু একমুখী পড়াশোনা করিনি। এই দলটা আলাদা।”
২০১৬ সালে দায়িত্ব দেওয়া হয় সাউথগেটকে। আইসল্যান্ডের কাছে হেরে ইউরো থেকে বিদায় নেওয়ার পর পরই কোচ করা হয়েছিল তাঁকে। সাউথগেটের প্রশিক্ষণে বদলাতে থাকে ইংল্যান্ড। ২০১৮ সালে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলে। ২০২১ সালে ইউরো কাপের ফাইনালে ওঠে। শেষ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছিল ইংল্যান্ড। এ বারের ইউরো কাপে আবার ফাইনালে হ্যারি কেনেরা। গত ৭০ বছরে এক বার কোনও প্রতিযোগিতার ফাইনাল খেলেছিল ইংল্যান্ড। গত আট বছরে সেখানে দ্বিতীয় ফাইনাল খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে সাউথগেটের ছেলেরা।
ইংল্যান্ড জিতলেও কেনদের খেলা মন জিততে ব্যর্থ। বার বার বড় প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া সমর্থকেরা বুঝতেই পারছেন না ফিল ফোডেন, জুড বেলিংহ্যামদের ‘কুৎসিত’ ফুটবল দেখে কী ভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা উচিত। তাঁরা অভ্যস্ত ছিলেন বীরের মতো খেলে হেরে যাওয়া দেখতে, কিন্তু এখন দেখছেন কোনও মতে জিতে যাওয়া। ইংরেজ দল এখন অনেক বেশি যান্ত্রিক। তারা যে কোনও ভাবে জিততে জানে।
ইংল্যান্ড ফুটবলের এই বদল এক দিনে হয়নি। পরিকল্পিত ভাবে তৈরি করা হয়েছে। গোটা বিশ্বের সেরা কোচদের নিয়ে আসা হয়েছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে। ম্যাঞ্চেস্টার সিটি, লিভারপুল, আর্সেনাল, চেলসি এবং ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে ইংরেজ ফুটবলারেরা তাঁদের হাতে তৈরি হচ্ছেন। ফুটবলের সেরা মস্তিষ্কের তীক্ষ্ণ নজর থাকছে ইংল্যান্ডের প্রতিভাবান ফুটবলারদের দিকে। স্পেনের পেপ গুয়ার্দিওয়ালা থেকে জার্মানির য়ুর্গেন ক্লপের মতো কোচেরা বেশ কয়েক বছর ধরেই ইংল্যান্ডের ক্লাব ফুটবলের অংশ। সেটার ফল পাচ্ছে ইংল্যান্ড।
ইউরোপের অন্য দেশগুলির সঙ্গে ইংল্যান্ডের ফুটবলের ফারাকটা ধীরে ধীরে মুছে গিয়েছে এই কারণে। গুয়ার্দিওলার প্রশিক্ষণে তৈরি হওয়া ফুটবলারের সংখ্যা এখন স্পেনের থেকে বেশি রয়েছে ইংল্যান্ড দলে। সেরা উদাহরণ অবশ্যই ফোডেন। ইংরেজ মিডফিল্ডারের তুলনা হতে পারে বার্সেলোনার অ্যাকাডেমি থেকে উঠে আসা ফুটবলারদের সঙ্গে। ম্যাঞ্চেস্টার সিটির কোচ গুয়ার্দিওলা। তাঁর প্রশিক্ষণেই তৈরি হয়েছেন ফোডেন।
সাউথগেট এটাই চেয়েছিলেন। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপের আগে তিনি বলেছিলেন, “আমরা ভাগ্যবান। আমাদের দেশের তরুণ প্রতিভারা গুয়ার্দিওয়ালা, ক্লপ, কন্তে, ওয়েঙ্গার, মোরিনহোর মতো কোচের প্রশিক্ষণে খেলার সুযোগ পাচ্ছে। ক্লাবে প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্তে এই কোচদের সামনে খেলছে তরুণ ফুটবলারেরা। সেই কারণেই এমন সব ফুটবলার তৈরি হচ্ছে দেশে।”
ইংল্যান্ড বুঝেছিল সিনিয়র ফুটবলে ট্রফি জিততে হলে, কাজটা শুরু করতে হবে জুনিয়র ফুটবল থেকেই। ১৯৬৬ সালের পর সিনিয়র দল কোনও ট্রফি জিততে না পারলেও ২০১৭ সালে অনূর্ধ্ব-২০ এবং অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ জিতেছিল ইংল্যান্ড। গত বছর অনূর্ধ্ব-২১ ইউরো কাপ জিতেছিল তারা। সেটাও আবার স্পেনকে হারিয়ে। রবিবার সেই দেশের বিরুদ্ধেই খেলবে ইংল্যান্ড। গত বছর অনূর্ধ্ব-২১ ইউরো কাপ জেতা ইংরেজ দলে ছিলেন অ্যান্থনি গর্ডন এবং কোল পামার। ২০১৭ সালে অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপজয়ী ইংল্যান্ড দলের সদস্য ছিলেন ফিল ফোডেন, মার্ক গেহি এবং কোনর গ্যালাঘার। ফোডেন সেই প্রতিযোগিতায় সোনার বল জিতেছিলেন। এজরি কোনসা ছিলেন অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপজয়ী দলে। এই ছ’জন ফুটবলারই রবিবারের সিনিয়র ইংল্যান্ড দলে রয়েছেন।
ইংল্যান্ডের ফুটবল নিয়ামক সংস্থার ডিরেক্টর ড্যান অ্যাশওয়ার্থ বলেন, “আমরা একটা মন্ত্রে বিশ্বাসী। ‘জার্সির মাপটা খালি বদলাবে।’ তাই অনূর্ধ্ব-১৫ থেকে সিনিয়র দলে উঠে আসছেন ফুটবলারেরা। ধারাবাহিক ভাবে ভাল খেলছে। সকলে এক লক্ষ্য নিয়ে খেলছে। এক রকম ভাবনায় খেলছে। সেটাই আমাদের সাফল্য এনে দিয়েছে।”
সাউথগেটের যে দল জার্মানিতে ইউরো কাপ খেলছে, তাদের ফুটবলে পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু দৃষ্টিসুখ নেই। গ্রুপ পর্বে দু’টি ম্যাচ ড্র করেছিল ইংল্যান্ড। মাত্র দু’টি গোল করেছিল। ইংল্যান্ডের সংবাদমাধ্যম সেই সময় ছিঁড়ে খাচ্ছিল সাউথগেটকে। তিনি বলেন, “আমরা সকলে ভালবাসা চাই। দেশের হয়ে কিছু করার সময় গর্ব বোধ হয়। কিন্তু সেটা ফেরত না পেলে খারাপ লাগে। সমালোচনা হজম করা বেশ কঠিন।”
ইংল্যান্ড সমালোচনা হজম করেনি। বরং ফিরে এসেছে। প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছে। নকআউট পর্বে জিতেছে। টাইব্রেকারে জিতেছে। কিছু ক্ষেত্রে যা প্রত্যাশিত ছিল। উদাহরণ, প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের জুড বেলিংহ্যামের ৯৫ মিনিটের গোল। কিছু ক্ষেত্রে ছিল চমক। উদাহরণ, লিভারপুলের ট্রেন্ট অ্যালেক্সান্ডার-আর্নল্ডকে শুধুমাত্র টাইব্রেকারের জন্য দলে আনা এবং তাঁর করা গোলে জিতে সেমিফাইনালে ওঠা। কিছু ছিল অপ্রত্যাশিত। উদাহরণ, অ্যাস্টন ভিলার অলি ওয়াটকিন্স গোটা ইউরো কাপে খেলেছেন ৩১ মিনিট এবং তাঁর করা গোলেই নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে জিতে ফাইনালে ওঠে ইংল্যান্ড।
কোচ সাউথগেটের মতে, এটাই নতুন ইংল্যান্ড। যে দল লড়তে জানে, যে দল নিজের জাত চেনাতে জানে।