উন্মাদনা: চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিতার সেই লাল-হলুদ বনাম সবুজ-মেরুন। গোয়ায় ম্যাচ হলেও শনিবার শতবর্ষের ডার্বি উপলক্ষে এ ভাবেই প্রিয় ক্লাবের প্রতীক নিয়ে গলা ফাটাবেন সমর্থকেরা। ফাইল চিত্র।
ফুটবল মাঠে যাওয়া আমার দীর্ঘ দিনই বন্ধ হয়ে গিয়েছে প্রবল কাজের চাপে। কিন্তু ডার্বি আসছে শুনলেই সেই আগের মতো উত্তেজনা অনুভব করি। মোহনবাগান (এখন অবশ্য এটিকে-মোহনবাগান) জিতলে যেমন মন খুশিতে ভরে ওঠে, তেমন আগের মতোই কষ্ট পাই প্রিয় দল হেরে গেলে। আশা করছি, ২৭ নভেম্বর গোয়ায় ডার্বির শতবর্ষেও এসসি ইস্টবেঙ্গলকে হারাবে এটিকে-মোহনবাগান।
আমার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক। কলকাতায় আমার শৈশব যেখানে কেটেছে, সেই পণ্ডিতিয়া রোডও ছিল পুরোপুরি লাল-হলুদ ভক্তদের পাড়া। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আমি হয়ে গিয়েছিলাম সবুজ-মেরুন সমর্থক। অবশ্য আমার মোহনবাগানী হয়ে ওঠার কাহিনিটাও বেশ মজার। সেজ জেঠু দীপ্তীশ চক্রবর্তী ছিলেন মোহনবাগানের আজীবন সদস্য। তিনি থাকতেন শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের কাছে আলেকজ়ান্ডার কোর্টে। আমার বাবা অবশ্য কলকাতার দুই প্রধানের কারও সমর্থক ছিলেন না। যে দল ভাল খেলত, তাদেরই সমর্থন করতেন।
আমার বয়স তখন আট অথবা নয়। মাঝেমধ্যেই জেঠুর বাড়ি বেড়াতে যেতাম। সেখান থেকেই জেঠু ও দাদার সঙ্গে মোহনবাগান মাঠে খেলা দেখতে যেতাম। ওঁরা দেখতাম, সবুজ-মেরুন জার্সি পরা কেউ গোল করলেই আনন্দে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে উঠতেন। আমিও গলা মেলাতাম ওঁদের সঙ্গে। জেঠু ও দাদার সঙ্গে মাঠে যেতে যেতে কখন যে আমিও মোহনবাগানের সমর্থক হয়ে গিয়েছিলাম, বলতে পারব না। জীবনের প্রথম ডার্বিও দেখেছিলাম জেঠু ও দাদার সঙ্গে। তখন অবশ্য দুই প্রধানের রেষারেষির ব্যাপারটা এত বুঝতাম না। আমার দেখা প্রথম ডার্বিতে মোহনবাগান জিতেছিল না হেরে গিয়েছিল, তা অবশ্য অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারছি না। তবে মনে আছে, ডার্বির দিন সকালে মা আমাকে পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন জেঠুর বাড়িতে।
মোহনবাগানের প্রতি ভালবাসা যখন বাড়ছে, ঠিক তখনই হঠাৎ করে আমাদের দিল্লি চলে যেতে হল। প্রথমে খুব কষ্ট হয়েছিল মাঠে গিয়ে মোহনবাগানের খেলা আর দেখা হবে না এই দুঃখে। যদিও কয়েক দিনের মধ্যেই ছবিটা বদলে যায়। দিল্লির স্কুলে আমার বন্ধুরা সকলেই ছিল মোহনবাগানের সমর্থক। ডুরান্ড কাপ, ডিসিএমে প্রিয় দলের খেলা দেখতে যেতাম। মায়ের শাড়ি কেটে সবুজ-মেরুন পতাকাও বানিয়েছিলাম। আমার উৎসাহ দেখে মা-ই তাঁর শাড়ি দিয়েছিলেন। সেই সময় আমি কট্টর সমর্থক ছিলাম। দিল্লিতে থাকার সময় অম্বেডকর স্টেডিয়ামে বসে শুধু মোহনবাগানের খেলাই দেখতাম না, অনুশীলন দেখতেও চলে যেতাম ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে। শুধু তাই নয়, মোহনবাগানের ফুটবলাররা যখন অম্বেডকর স্টেডিয়ামের উদ্দেশে রওনা হতেন, গাড়ি নিয়ে আমরা থাকতাম টিম বাসের ঠিক সামনে। সঙ্গে থাকত সেই শাড়ি দিয়ে তৈরি সবুজ-মেরুন পতাকা। গাড়ির ক্যারিয়ারে বাঁশে বাঁধা থাকত। আমি ছিলাম সুব্রত ভট্টাচার্যের বিশাল ভক্ত। কারণ, রক্ষণে দাঁড়িয়ে বিপক্ষের আক্রমণ সামলাতেন উনি। আমিও সারাজীবন অন্যায়, ভয়, দুর্বলের প্রতি আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চেয়েছি। এই কারণেই সুব্রতদা আমার প্রিয় ফুটবলার।
এখনও ভুলিনি পঁচাত্তরের শিল্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের কাছে ০-৫ গোলে হারের যন্ত্রণা। দিল্লিতে থাকলেও কম বিদ্রুপ সহ্য করতে হয়নি আমাকে। যত ইস্টবেঙ্গল সমর্থক বন্ধু ছিল, আমাদের দেখলেই পাঁচ আঙুল তুলে কটাক্ষ করত। সেই সময় কলকাতায় থাকলে আরও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হত। দিল্লি ছেড়ে ১৯৮৪ সালে কলকাতায় ফিরে এলাম। বাবা চলে গেলেন। চলচ্চিত্র, নাটক ও অন্যান্য কাজে ভীষণ ভাবেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সব চেয়ে যন্ত্রণার হয়ে দাঁড়াল, মোহনবাগানের খেলা দেখতে মাঠে যাওয়ার সময় বার করতে পারছি না। তবে প্রিয় দলের খবর অবশ্যই রাখছিলাম। তার স্থান যে হৃদয়ে।
গত মরসুমে আইএসএল ফাইনালে এটিকে-মোহনবাগান বনাম মুম্বই সিটি এফসি ম্যাচও দেখা হয়নি এই ব্যস্ততার কারণে। আমার প্রিয় দল হেরে গিয়েছিল শোনার পরে মন খারাপ হয়ে যায়। তবে হ্যাঁ, টিভির সামনে বসে পড়ি আইএসএলে এটিকে-মোহনবাগানের ম্যাচ দেখতে। আগে সবুজ-মেরুন ফুটবলারদের যাবতীয় তথ্য আমার কাছে থাকত। রীতিমতো ওয়াকিবহাল ছিলাম প্রত্যেকের শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে। প্রতিপক্ষের কোন কোন ফুটবলারকে আটকাতে না পারলে আমাদের বিপদ, সব মুখস্থ ছিল। ফেলুদার সেই ফুটবল গোয়েন্দাগিরিতে কিছুটা ভাঁটা পড়েছে সময়ের অভাবে। কিন্তু প্রিয় ক্লাবকে নিয়ে উৎসাহ, উদ্দীপনা একই রকম আছে। আর এ বারে তো শতবর্ষের ডার্বি। তাই আরও বেশি করে তাকিয়ে আছি এই দ্বৈরথের দিকে। আমাদের এখনকার সেরা অস্ত্র রয় কৃষ্ণের বেশ কয়েকটা খেলা দেখেছি। আশা করব, কৃষ্ণরা শনিবার জাদু দেখাবে আর শতবর্ষের ডার্বিতে ইলিশের স্বাদ তেতো করে ছুটবে পালতোলা নৌকা।