প্রয়াত ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। ছবি: রয়টার্স।
ব্রাজিলের ছিল পেলে। আর্জেন্টিনার ছিল দিয়েগো মারাদোনা। নেদারল্যান্ডসের ছিল জোহান ক্রুয়েফ। কিন্তু গত কয়েক দশক আগে থেকে ইউরোপীয় ফুটবলে দাপট দেখিয়ে চলা জার্মানি তখনকার দিনে গর্ববোধ করার মতো কাউকে পেত না। বিশ্ব ফুটবলে একের পর এক চমক দেখালেও মুখের মতো জবাব দেওয়ার মতো ‘বিগ্রহ’ তাদের কাছে ছিল না।
ঠিক তখনই উদয় হয়েছিলেন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। লম্বা, ছিপছিপে, সুদর্শন এই ফুটবলারের খেলার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল গোটা বিশ্ব। তাঁর দৌড়, তাঁর ট্যাকল করার ক্ষমতা এবং মাঝমাঠে পায়ের শিল্প সেই সময়ের ইউরোপীয় ফুটবলারদের মধ্যে খুব কমই খুঁজে পাওয়া যেত।
জার্মানি খুব তাড়াতাড়ি আপন করে নিয়েছিল বেকেনবাওয়ারকে। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ডার কাইজ়ার’। অর্থাৎ রাজা। ফুটবল মাঠে তিনিই নেতা। জার্মানির এই ফুটবলারকে তর্কাতীত ভাবে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার বলা হত। জার্মানির মানুষ মনেই করেন, তাঁদের কাছে বেকেনবাওয়ার ছাড়া আর কোনও বড় ফুটবলার নেই। পেলে বা দিয়েগো মারাদোনাকে নিয়ে জার্মানির মানুষ কোনও দিনই মাথা ঘামাননি। তাঁদের কাছে বেকেনবাওয়ারই ছিল সব। কিছুটা জায়গা দখল করে থাকতেন গার্ড মুলারও। কিন্তু জনপ্রিয়তায় বেকেনবাওয়ার টেক্কা দিয়েছেন বরাবরই।
২০০৬ বিশ্বকাপের আগে পেলের সঙ্গে বেকেনবাওয়ার। ছবি: রয়টার্স।
১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ড প্রথম এবং এখনও পর্যন্ত একমাত্র ফুটবল বিশ্বকাপ জিতেছিল পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে। সেই দলে ছিলেন বেকেনবাওয়ার। ইংল্যান্ডের কাছে সেই হার তরুণ বেকেনবাওয়ারের জেদ আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। ১৯৭৪ সালে তাঁর নেতৃত্বেই বিশ্বকাপ জেতে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি।
শুধু ফুটবলার হিসেবে নয়, কোচ হিসেবেও বিশ্বকাপ জেতার নজির রয়েছে বেকেনবাওয়ারের। ১৯৯০ সালে মারাদোনার আর্জেন্টিনাকে হারানো পশ্চিম জার্মানি দলের কোচ ছিলেন বেকেনবাওয়ার। বস্তুত, তিনি বিশ্বের তৃতীয় ব্যক্তি যিনি ফুটবলার এবং কোচ, দুই ভূমিকাতেই বিশ্বকাপ জিতেছেন। সেই তিন জনের সবচেয়ে প্রথম জন, ব্রাজিলের মারিয়ো জাগালো দু’দিন আগেই মারা গিয়েছেন। তার পরেই এল বেকেনবাওয়ারের মৃত্যুর খবর। এই তালিকায় তৃতীয় জন হলেন ফ্রান্সের দিদিয়ের দেশঁ, যিনি ফুটবলার হিসেবে ১৯৯৮ এবং কোচ হিসেবে ২০১৮ সালে বিশ্বকাপ জিতেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে, ১৯৪৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জন্ম বেকেনবাওয়ারের। বাবা ছিলেন পিয়ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেই শহর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল। ছোটবেলা থেকেই দারিদ্রের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গিয়েছিল বেকেনবাওয়ারের। বাবা তাঁকে ফুটবল খেলতে বারণ করতেন। কিন্তু বেকেনবাওয়ারকে আটকানো যায়নি। ৯ বছর বয়সে তিনি এসসি মিউনিখ ০৬ ক্লাবের তরুণ দলে সুযোগ পান।
১৮৬০ মিউনিখ ক্লাবের সমর্থক ছিলেন বেকেনবাওয়ার। সেই ক্লাবের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু এসসি মিউনিখ ০৬ এবং ১৮৬০ মিউনিখ ক্লাবের যুব দলের একটি ম্যাচে বেকেনবাওয়ারের সঙ্গে বিপক্ষের এক ফুটবলারের ব্যাপক ঝামেলা হয়। তখন থেকেই প্রেম উধাও। যোগ দেন বায়ার্নে।
যুব দলে থাকাকালীনই বিতর্কে জড়িয়েছেন। এক বার দাবি করেন, তাঁর বান্ধবী অন্তঃসত্ত্বা এবং তিনি তাঁকে বিয়ে করতে চান না। ১৮ বছরের বেকেনবাওয়ারকে নির্বাসিত করে পশ্চিম জার্মানির যুব দল। তবে তৎকালীন কোচ ডেটমার ক্রেমার রুখে দাঁড়ান। আবার দলে নেওয়া হয়। ১৯৬৪ সালে বায়ার্ন মিউনিখে যোগ দেন বেকেনবাওয়ার। তখন তারা দ্বিতীয় ডিভিশনে খেলত। পরের বছর প্রথম ডিভিশনে ওঠে। সে বছরই জার্মানির হয়ে প্রথম খেলেন বেকেনবাওয়ার। পরবর্তী কালে বায়ার্নের হয়ে ৪০০-রও বেশি ম্যাচ থেলেছেন তিনি। ক্লাবের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ফুটবলার তিনিই। ছোটবেলায় ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলা শুরু করেছিলেন। পরে লেফ্ট পরে পজিশন বদলান। বায়ার্নের হয়ে চারটি লিগ খেতাব এবং তিন বার ইউরোপ সেরার খেতাব জিতেছেন তিনি। তার পরে বিশ্বকাপ জেতেন দেশের হয়ে।
‘জাবুলানি’ বল হাতে বেকেনবাওয়ার। ছবি: রয়টার্স।
মাঠে বেকেনবাওয়ারের ভূমিকা ছিল মূলত ‘সুইপার’-এর। অর্থাৎ রক্ষণ সামলানো, আবার প্রয়োজনে আক্রমণেও সাহায্য করা। আক্রমণ তৈরিই হত তাঁর পাস থেকে। যত দিন গিয়েছে তত এই পজিশন আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বিভিন্ন দলের কাছে। দু’বার বালঁ দ্যর ট্রফি জিতেছেন বেকেনবাওয়ার। বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ পুরস্কার বলে মনে করা হয় এটি।
১৯৭৭ সালে বেকেনবাওয়ার যোগ দেন আমেরিকার ফুটবলে। নিউ ইয়র্কে কসমসের হয়ে সই করেন। টানা তিন বছর কসমসের হয়ে খেলেছেন তিনি। সে সময় পেলেও তাঁর সতীর্থ ছিলেন। এর পর আবার দেশে ফিরে দু’বছর হামবুর্গের হয়ে খেলে অবসর নেন।
ভাল ফুটবলারদের মধ্যে খুব কম জনই ভাল কোচ হয়েছে। বেকেনবাওয়ার সে দিক থেকেও ছিলেন ব্যতিক্রম। ১৯৮৪ সালে পশ্চিম জার্মানির দায়িত্ব নেন। দু’বছর পরেই তাঁদের ফাইনালে তোলেন। সে বার মারাদোনার আর্জেন্টিনার কাছে হারে পশ্চিম জার্মানি। ১৯৮৮ সালে ইউরো কাপের ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের কাছেও হারে তারা। কোচ হিসেবে অবশ্য বেকেনবাওয়ারের উপর ভরসা রাখা হয়েছিল। সেই আস্থার দাম দেন ১৯৯০ সালে। আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জেতে পশ্চিম জার্মানি।
১৯৯৪ সালে বায়ার্নের প্রেসিডেন্ট হন। ক্লাবের খোলনলচে আমূল বদলে দেন। উত্তরোত্তর এগিয়ে যেতে থাকে ক্লাব। ২০০৯ সালে তিনি ইস্তফা দেন। ২০০৬ সালে জার্মানির বিশ্বকাপ আয়োজনের পিছনেও অন্যতম ভূমিকা ছিল তাঁর। তবে ২০১৪ সালে ফিফা তাঁকে ৯০ দিনের জন্য নির্বাসিত করে। দুর্নীতির তদন্তে সহযোগিতা করতে চাননি। ২০১৯ সালে এক সংবাদপত্র জানায়, বিশ্বকাপ আয়োজনে রাশিয়ার সপক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য এক ব্যবসায়ীর থেকে বিরাট অর্থ পেয়েছিলেন বেকেনবাওয়ার।
তবে শেষ দিকে বাড়ি থেকে বেরনো বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। কমে এসেছিল চেনাজানাদের খোঁজ নেওয়ার ঢল। তাঁর মৃত্যুতে আবার জার্মানদের মনে পড়ে গেল দেশের ফুটবল ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।