উদয়: হ্যাটট্রিক করে উচ্ছ্বাস মোহনবাগানের নতুন তারা কিয়ান নাসিরির। শনিবার আইএসএলে। ছবি: টুইটার।
ঐতিহ্যের ডার্বিতে রূপকথার উত্থান ভারতীয় ফুটবলের নতুন নায়কের। আমার ছাত্র কিয়ান নাসিরি।
মোহনবাগান মাঠে সিএফসি-কেশোরাম অ্যাকাডেমির ডিরেক্টর তখন ছিলাম আমি। কোচ ছিল জামশিদ নাসিরি। বছর পাঁচেক আগে ও ছেলেকে নিয়ে এল মাঠে। কিয়ানের বয়স তখন মাত্র ১৪ বছর। প্রথম দিনের অনুশীলনেই দেখেছিলাম ছেলেটার বলের উপরে নিয়ন্ত্রণ অসাধারণ। জামশিদ জিজ্ঞাসা করল, ‘‘কিয়ান কি পারবে ফুটবলার হতে?’’ আমি জামশিদকে বলেছিলাম, তোমার ছেলের রক্তে ফুটবল। ওকে ঠিক মতো গড়ে তুলতে পারলে এক দিন তোমাকেও ছাপিয়ে যাবে। শনিবার আইএসএলের ডার্বিতে এসসি ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে কিয়ানকে দুর্ধর্ষ হ্যাটট্রিক করতে দেখে দারুণ আনন্দ হচ্ছিল। কুঁড়ি ফুল হয়ে ফুটলে যেমন গর্বে বুক ফুলে ওঠে মালির, আমারও একই রকম অনুভূতি হচ্ছে।
কিয়ানের বিশেষত্ব হল, গোলটা দারুণ চেনে। ঠান্ডা মাথায় খেলে। অনুশীলনে কখনও পরিশ্রম করতে আপত্তি করেনি। যা বলতাম, মন দিয়ে শুনত। এক দিন অনুশীলন শুরু হওয়ার বেশ কিছু ক্ষণ আগে মাঠে গিয়ে দেখি, কিয়ান একা একাই বিভিন্ন জায়গা থেকে গোলে বল মেরে যাচ্ছে। বাকি ফুটবলাররা কেউ তখনও ড্রেসিংরুম থেকেই বেরোয়নি। কিয়ানের এই অধ্যবসায় আমাকে মুগ্ধ
করেছিল। আমাদের অ্যাকাডেমির হয়ে অসংখ্য গোল করেছে ও। অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতীয় দলের ট্রায়ালেও পাঠিয়ে ছিলাম ওকে। এর পরেই কিয়ানকে যুব দলের খেলানোর জন্য নেয় মোহনবাগান।
শনিবার ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ৬১ মিনিটে দীপক টাংরির পরিবর্তে কিয়ানকে নামতে দেখে মনে হচ্ছিল, এত ক্ষণ পরে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোহনবাগানের কোচ জুয়ান ফেরান্দো। কারণ, প্রথমার্ধে সবুজ-মেরুনের খেলা দেখে সত্যিই খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম।
ইস্টবেঙ্গলের চেয়ে মোহনবাগান এই মরসুমে সব বিভাগেই এগিয়ে রয়েছে। ৪-৪-২ ছকে দল সাজালেও এই ধরনের ম্যাচে যে লাল-হলুদের কোচ মারিয়ো রিভেরা কোনও ঝুঁকিই নেবে না, তা নিয়ে কারও সন্দেহ ছিল না। রক্ষণ মজবুত করে প্রতিআক্রমণ নির্ভর ফুটবলই তো খেলার কথা ইস্টবেঙ্গলের।
আমাকে অবাক করল জুয়ানের পরিকল্পনা। একা ডেভিড উইলিয়ামসকে সামনে রেখে ৪-২-৩-১ ছকে দল সাজিয়েছিল। চোটের কারণে রয় কৃষ্ণের না থাকাটাই কি আত্মবিশ্বাস নাড়িয়ে দিয়েছিল মোহনবাগান কোচের? আইএসএল টেবলে সবার শেষ রয়েছে ইস্টবেঙ্গল। ১৩ ম্যাচে ২৫টি গোল খেয়ে খেলতে নামছে আন্তোনিয়ো পেরোসেভিচরা। আগের ম্যাচেই দেখা গিয়েছিল, একটু চাপ পড়লেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণ। ভেবেছিলাম, মোহনবাগান ম্যাচের শুরু থেকেই আক্রমণের ঝড় তুলবে। যে কোচের হাতে ডেভিড, হুগো বুমোস, লিস্টন কোলাসো, মনবীর সিংহের মতো ফুটবলার রয়েছে, তিনি কেন এক স্ট্রাইকারে খেলবেন? শুধু তাই নয়। আইএসএলের শেষ চারে মোহনবাগান এখনও নিশ্চিত নয়। ডার্বি জিতলে অনেকটাই সম্ভাবনা উজ্জ্বল হত। অথচ মোহনবাগানের খেলায় সেই ঝাঁজটাই চোখে পড়ল না। এর ফলে কাজ আরও সহজ হয়ে গিয়েছিল আদিল খান, হীরা মণ্ডলদের। ম্যাচের শুরু থেকেই বুমোসরা এত বেশি নিজেদের মধ্যে পাস খেলছিল এবং পায়ে বল রাখছিল, ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলাররা রক্ষণ গুছিয়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পেয়ে যাচ্ছিল। এমনকী, ১০ মিনিটে অঙ্কিত মুখোপাধ্যায় চোট পেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরে মিডফিল্ডার অমরজিৎ সিংহ কিয়ামকে বাধ্য হয়ে রাইটব্যাক পোজ়িশনে নামায় মারিয়ো। ইস্টবেঙ্গল রক্ষণের এই দুর্বলতার সুযোগও নিতে পারল না ডেভিড, লিস্টনরা। ওরা আদিল-হীরাদের চক্রব্যূহে আটকে ছটফট করছিল। এই সুযোগে বেশ কয়েকবার আক্রমণ উঠল ইস্টবেঙ্গল। প্রবল শক্তিশালী মোহনবাগানের বিরুদ্ধে যে ভাবে অঙ্ক করে লড়াই করছিল আন্তোনিয়ো পেরোসেভিচ, নওরেম মহেশ সিংহরা, তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। বারবার মনে হচ্ছিল মোহনবাগান যদি পরিকল্পনা না বদলায়, তা হলে ডার্বি জেতা কঠিন হয়ে পড়বে। ইস্টবেঙ্গল গোল করে এগিয়েও যেতে পারে। আমার আশঙ্কাই সত্যি হল। ম্যাচের ২৫ মিনিটে সবুজ-মেরুন রক্ষণের ভুলে পেনাল্টি বক্সের মধ্যে ফাঁকায় বলও পেয়ে গিয়েছিল মার্সেলো রিবেইরো। সামনে একা গোলরক্ষক অমরিন্দর সিংহকে পেয়েও অবিশ্বাস্য ভাবে বাইরে মারল ব্রাজিলীয় স্ট্রাইকার। দ্বিতীয়ার্ধেও শুরুটা একই ভাবে করেছিল। ৫৬ মিনিটে মোহনবাগানের পেনাল্টি বক্সের জটলার মধ্যে থেকে ড্যারেন সিডোয়েল গোল করে ইস্টবেঙ্গলকে এগিয়ে দেওয়ার পরে সম্বিত ফেরে জুয়ানের। মাঠে নামায় তরুণ কিয়ানকে। তিন মিনিটের মধ্যে ওর পায়ের প্রথম স্পর্শেই বল জড়িয়ে যায় জালে। ঠান্ডা মাথায় ডান পায়ের শটে বল গোলে রেখেছিল কিয়ান। দু’মিনিটের মধ্যেই পেনাল্টি পায় মোহনবাগান। কিন্তু অবিশ্বাস্য ভাবে ক্রসবারের উপর দিয়ে বল উড়িয়ে দেয় ডেভিড। ৯০ মিনিটে ফের গোল কিয়ানের। লিস্টনের শট পোস্ট লেগে ফিরতেই নিখুঁত শটে সুযোগসন্ধানী কিয়ান ২-১ করেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মনবীরের পাস থেকে ডার্বিতে হ্যাটট্রিক করে মোহনবাগানকে আইএসএল টেবলে চতুর্থ স্থানে পৌঁছে দিল কিয়ান।
ডার্বি উপহার দিল নতুন নায়ক!