উল্লাস: জার্মানিকে হারানোর পরে রাস্তায় উৎসব ভক্তদের। নিজস্ব চিত্র
দোহা শহরের মধ্যে শউক ওয়াকিফে সময় যেন থমকে রয়েছে। একশো বছরর ওয়াদি মুশেইরেব নদীতে যখন প্রাণ ছিল, এই অঞ্চল ছিল বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র। মশলা, পশু-পাখি, আতরের বিরাট বাজার ছিল। আর ছিল বেদুইনদের আড্ডা, শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র।
আরবিতে ওয়াদি শব্দের অর্থ খাল। বৃষ্টির সময় শহরের জমা জল সমুদ্রে ফেলার জন্য এই ধরনের একাধিক খাল কাটা হয়েছিল। তার মধ্যে অন্যতম মুশেইরেব। সমুদ্র কাছে হওয়ায় সেই সময় নৌকো করেই শউক ওয়াকিফে বাণিজ্যের পসরা সাজিয়ে হাজির হতেন বণিকরা। দিনের বেলা চলত বেচা-কেনা। তার পরে সারারাত ধরে আনন্দ করতেন কাতারের মানুষ। আধুনিকতার ছোঁয়ায় মরুদেশ সম্পূর্ণ বদলে গেলেও শউক ওয়াকিফ একই রকম রয়েছে। একশো বছর আগে তৈরি হওয়া বাড়ি, দোকান, পাথর বসানো রাস্তা ও গলি, বাজ পাখির বাজার— বদলায়নি কিছুই।
২০০৩ সালে বিধ্বংসী আগুনে শউক ওয়াকিফের অধিকাংশটাই পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল। কাতার সরকার নতুন করে আবার সব গড়ে তুলেছে। একশো বছর আগে ঠিক যে রকম ছিল শউক ওয়াকিফের বাড়ি, রাস্তা ও দোকান— এখনও ঠিক একই রকম রয়েছে। এখনও দিনের বেলা বাজার বসে। সারা রাত ধরে নাচ-গান হয়। কাবাব, আতরের গন্ধে চারপাশ ম-ম করে। বিশ্বকাপ উপলক্ষে এই শউক ওয়াকিফ আরও রঙিন হয়েছে।
বুধবার মাঝরাতে শউক ওয়াকিফের রাস্তায় বান্ধবী শাকুরার হাত ধরে আনন্দে চিৎকার করছিলেন ইয়াটো। জার্মানিকে হারিয়ে বিশ্বকাপে অঘটন ঘটানোর রাতে গ্যালারিতেই বান্ধবীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন বছর ছাব্বিশের ইয়াতো। শাকুরা কোনও উত্তর না দেওয়ায় মুষড়ে পড়েছিলেন রীতিমতো। শউক ওয়াকফেই পৌঁছেই সম্মতি দেন তিনি। জাপানের জাতীয় পতাকা গায়ে জড়িয়ে আনন্দে লাফাতে লাফাতে ইয়াতো বলছিলেন, ‘‘আমার জীবনের অন্যতম সেরা দিন। চার বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানির বিরুদ্ধে জাপানের দুর্দান্ত জয় দেখলাম। এত ক্ষণ পরে শাকুরাও আমার বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হল।’’
ইয়াতোর আরও একটা পরিচয় হল— জার্মানির বিরুদ্ধে ম্যাচের ৮৩ মিনিটে জয়সূচক গোল করা তাকুমা আসানো ও তাঁর জন্ম একই শহরে। জাপানের কোমোনোয়। তাকুমাকে চেনেন? ইয়াতো বললেন, ‘‘তাকুমার ভাই ইউয়া আমার বন্ধু। সেই সূত্রে কয়েকবার কথা হয়েছিল ওর সঙ্গে।’’ যোগ করলেন, ‘‘তাকুমা তো জাপানে খুব বেশি দিন থাকেননি। মাত্র আঠারো বছর বয়সেই আর্সেন ওয়েঙ্গার ওকে আর্সেনালে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ইংল্যান্ডে ওয়ার্ক পারমিট না পাওয়ায় সই করেন জার্মানির ক্লাব স্টুটগার্টে।’’
ইয়াতো যোগ করেন, ‘‘তাকুমা ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড লড়াকু। মানসিক ভাবেও দারুণ শক্তিশালী। ইংল্যান্ডে ওয়ার্ক পারমিট না পাওয়ার যন্ত্রণা ওর জেদ বাড়িয়ে দিয়েছিল। ‘জে’ লিগের অনেক ক্লাবের প্রস্তাব থাকলেও তাকুমা বেছে নিয়েছিলেন বুন্দেশলিগাকে।’’ যোগ করলেন, ‘‘বুন্দেশলিগায় খেলার অভিজ্ঞতা থেকেই কাজে লাগিয়েছে তাকুমা ও রিতসু দোয়ান অবশ্য এই জাপান দলের আট ফুটবলার খেলেন জার্মানির বিভিন্ন ক্লাবে। এই কারণেই আমাদের ওরা আজ আটকাতে পারেনি।’’
ইয়াতোর সঙ্গে একমত ভারতে খেলে যাওয়া রিউজ়ি সুয়েকাও। বুধবার খলিফা আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে জার্মানির বিরুদ্ধে যখন মাঠে নেমেছিলেন তাকুমারা, জাপানে তখন গভীর রাত। এ দিন ফোনে উচ্ছ্বসিত সুয়েকা বললেন, ‘‘আমি মনে করি, শুধুমাত্র বুন্দেশলিগায় আমাদের ফুটবলাররা খেলার জন্যই জার্মানিকে হারায়নি। জাপানের এই সাফল্যের ভিতটা গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন কিংবদন্তি জ়িকো। ‘জে’ লিগ আমাদের দেশের ফুটবলের ছবিটাই বদলে দিয়েছে। বিশ্বের সেরা ফুটবলারদের সঙ্গে খেলার সুযোগ পাচ্ছে আমাদের ছেলেরা। ফলে ধীরে ধীরে ইউরোপের সঙ্গে ব্যবধান কমছে।’’
জাপান দলের সঙ্গে সারা বিশ্ব ঘোরেন হিবিকি। বুধবার রাতে তিনি বলছিলেন, ‘‘জার্মানির বিরুদ্ধে আমাদের জয়কে অঘটন হিসেবে দেখা উচিত নয়। দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনার পুরস্কার আমরা পেয়েছি।’’