২৮শের দিকে তাকিয়ে ভারতীয় ফুটবল প্রতীকী ছবি
মহা সমস্যায় ভারতীয় ফুটবল। দীর্ঘ দিন ধরে নির্বাচন না করা, কর্তাদের চেয়ার আঁকড়ে বসে থাকার প্রবণতা, ভারতীয় ফুটবলের উন্নতি নিয়ে কিছু কর্তার উদাসীন থাকা আজ বিপদের মুখে এনে ফেলেছে ভারতীয় ফুটবলকে। অবস্থা এমনই যে শেষমেশ হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে সুপ্রিম কোর্টকে। আপাতত সব নজর ২৮ জুলাই। ওই দিনই বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ সর্বভারতীয় ফুটবল সংস্থার (এআইএফএফ) সংবিধান সংশোধন নিয়ে চূড়ান্ত রায় দেবে। তার পরে ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করতে পারলে তবেই ফিফার নির্বাসন এড়ানো যাবে।
ভারতীয় ফুটবলে নির্বাচন হওয়া নিয়ে বহু দিন ধরে টালমাটাল অবস্থা চলছিল। শেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৬ সালে ২১ ডিসেম্বর। এআইএফএফের সংবিধান ক্রীড়া বিধি মেনে তৈরি নয়, তা জানিয়ে আর্থিক সহায়তা বন্ধের হুমকি দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রক। পাল্টা এআইএফএফের তরফে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে জানানো হয়, তাদের সংবিধান ক্রীড়া বিধি মেনেই তৈরি। সুপ্রিম কোর্টেও সেই মামলার শুনানি নিয়ে ঢিলেমি চলতেই থাকে। শেষে কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রক কড়া মনোভাব নেওয়ায় নড়েচড়ে বসে সুপ্রিম কোর্টও। প্রফুল্ল পটেলের নেতৃত্বাধীন কমিটিকে সরিয়ে নতুন কমিটি তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়। নতুন নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় ফুটবলের দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রশাসকদের কমিটিকে (সিওএ)।
সিওএ দায়িত্ব নিতেই একের পর এক দুর্নীতি সামনে আসতে থাকে। কখনও দেখা যায় ভারতীয় ফুটবলের উন্নতির স্বার্থে জ্যোতিষী নিয়োগ করা হয়েছে, কখনও দেখা যায় আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ধরা পড়েছে ক্যাগের রিপোর্টে। চাপে পড়ে প্রফুল্ল পদত্যাগ করেন। সঠিক সময়ে নির্বাচন না করা হলে ভারতকে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে নির্বাসিত করা হবে, এমন হুমকিও দেয় ফিফা। সঙ্কট মেটাতে ফিফা এবং এএফসি-র এক প্রতিনিধিদলও আসেন ভারতে। সব খতিয়ে দেখে, বিস্তর বৈঠক করে কিছু দিকনির্দেশ দেন তারা। অতীতে বহু দেশকে নির্বাসিত করেছে ফিফা। সম্ভাবনা কম হলেও ভারতের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হতে পারে, এমন কোনও ব্যাপার নেই।
নজর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের দিকে
সম্প্রতি যে চূড়ান্ত খসড়া সংবিধান তৈরি করেছে সিওএ, তা নিয়েও বিস্তর আপত্তি রয়েছে রাজ্য সংস্থাগুলির। সেখানে আই লিগকে দেশের সর্বোচ্চ লিগ হিসাবে ধরা হয়েছে। আইএসএল নেমে এসেছে দ্বিতীয় সারিতে। অথচ বছর তিনেক আগে এএফসি-র সঙ্গে এক বৈঠকে আইএসএলকেই দেশের সর্বোচ্চ লিগ হিসাবে ঘোষণা করেছিল এআইএফএফ। কেউ তাতে বিশেষ আপত্তিও করেনি। এমনকী, চূড়ান্ত খসড়া সংবিধান হওয়ার পরেও এআইএফএফের সদস্য ৩৬টি রাজ্য সংস্থার মধ্যে ৩৫টিই জানিয়েছে, আইএসএলকে দেশের এক নম্বর লিগ করা হোক। ব্যতিক্রম গোয়া, যারা ভোট দিয়েছে আই লিগের পক্ষে।
আই লিগ দেশের এক নম্বর লিগ হলে অন্য সমস্যা। আইএসএলের আয়োজক এফএসডিএলের সঙ্গে ১৫ বছরের চুক্তি রয়েছে এআইএফএফের। ২০১০ সালে হওয়া মাস্টার্স রাইটস এগ্রিমেন্ট (এমআরএ) অনুযায়ী বছরে ৫০ কোটি টাকা পায় এআইএফএফ। সূত্রের খবর, আইএসএল দেশের এক নম্বর লিগ না থাকলে চুক্তিভঙ্গের দায়ে এআইএফএফের বিরুদ্ধে বিরাট অঙ্কের মামলা করতে পারে এফএসডিএল। তাদের দাবি, সংবিধান সংশোধন হোক। তবে এমন ভাবে না হয়, যাতে আগের কোনও দায়বদ্ধতা মানা হবে না। পাল্টা সিওএ-র দাবি, এই চুক্তি সাময়িক সময়ের, যা বাতিল করতে কোনও অসুবিধা নেই।
শুধু এটাই নয়, চূড়ান্ত খসড়া সংবিধানের আরও অনেক বিষয় নিয়ে আপত্তি রয়েছে রাজ্য সংস্থাগুলির। আপাতত ফিফার নির্বাসনের ভয়ে কেউই প্রকাশ্যে মুখ খুলছে না। সবাই চায়, সমস্যা তাড়াতাড়ি মিটে যাক। ভারতীয় ফুটবল যেন কোনও ভাবেই ফিফার নির্বাসনের সামনে না পড়ে। তা হলে অক্টোবরে হতে চলা অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব হারাতে হবে। যদিও ফিফার নির্বাসন প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টে সিওএ-র বিচারপতি গোপাল শঙ্করনারায়ণন বলেছেন, “ফিফা-এএফসি সব সময় যোগাযোগ রেখে চলেছে সিওএ-র সঙ্গে। কোথাও কোনও সমস্যা নেই। ওদের প্রতিনিধিরাও ভারতে ঘুরে গিয়েছে এবং আমাদের বলেছে সুপ্রিম কোর্টে সংবিধান সংশোধনের অনুমতি আদায় করতে।”
কী রয়েছে চূড়ান্ত খসড়া সংবিধানে? আইএসএল বনাম আই লিগ নিয়ে বিতর্ক তো রয়েছেই। এ ছাড়া বলা হয়েছে, টানা দু’বারের বেশি কেউ সভাপতি পদে থাকতে পারবেন না। কার্যকরী কমিটিতে কোনও সহ-সভাপতি রাখা হবে না। প্রতিযোগিতা পরিচালনার দায়িত্ব কোনও বাইরের সংস্থাকে দেওয়া যাবে না। যে কেউ এআইএফএফের নির্বাচনে লড়তে পারেন। এআইএফএফের কোনও পদে এলে তিনি রাজ্য সংস্থার পদে থাকতে পারবেন না।
ভারতের হয়ে খেলা দুই প্রাক্তন ফুটবলার রহিম নবি এবং কৃষ্ণেন্দু রায় আনন্দবাজার অনলাইনকে জানালেন, দুর্নীতি রুখতে প্রাক্তনদের কারওর দায়িত্বে আসা উচিত। নির্বাচনে লড়ে ভারতীয় ফুটবলের উন্নতির স্বার্থে নিজেদের নিয়োজিত করতে হবে। নবি বলেছেন, “যারা ফুটবল নিয়ে এত দিন রাজনীতি করেছে, তাদের উচিত সামনে এসে ক্ষমা চাওয়া। নোংরা খেলা চলছিল এত দিন। আমার মতে, প্রাক্তন ফুটবলারদের এগিয়ে এসে নির্বাচনে লড়ে ভারতীয় ফুটবলের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া উচিত। সম্প্রতি যারা ফুটবল থেকে অবসর নিয়েছে, তাদের এগিয়ে আসতে হবে। তাদের মধ্যে কাজ করার মানসিকতা থাকতে হবে। তবেই ভারতীয় ফুটবলের উন্নতি সম্ভব।”
কৃষ্ণেন্দু বলেছেন, “ভারতীয় ফুটবলের জন্য সুপ্রিম কোর্টে মামলা লড়ালড়ি চলছে, এটা মোটেই শোভনীয় নয়। আশা করি এই সময় কেটে যাবে এবং ভারতীয় ফুটবলের উন্নতির পক্ষেই সুপ্রিম কোর্ট কথা বলবে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তি যদি সফল ভাবে বিসিসিআই সামাল দিতে পারেন, তা হলে প্রাক্তন ফুটবলারদেরও ক্ষমতা রয়েছে এআইএফএফের দায়িত্ব নেওয়ার। ফুটবলের কোনও ব্যক্তিত্বকেই দায়িত্ব নিতে হবে।”
নবির সতীর্থ মেহতাব হোসেন আবার চান, পেশাদাররা আসুন দায়িত্বে। তাঁর কথায়, “গোটা সংগঠনকে ঢেলে সাজতে হবে। এক সময় জাপান, কোরিয়ার মতো দেশ অনেক পিছিয়েছিল। ওরা সঠিক পরিকল্পনা করে সাফল্য পেয়েছে। ভারতীয় ফুটবলকে যারা অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারবে, তাদেরই দায়িত্বে আনতে হবে। আমার মতে, রাজনীতির সঙ্গে জড়িত লোকদের সংগঠনে রাখাই উচিত নয়।”