শিল্ড নিয়ে লেভারকুসেনের উচ্ছ্বাস। মাঝে জ়াবি। ছবি: রয়টার্স।
একটা-দুটো নয়, ১২০ বছর!
প্রথম ঘরোয়া লিগ জিততে ঠিক এতটাই সময় লেগে গিয়েছে বেয়ার লেভারকুসেনের। ১৯০৪ সালে জার্মানির এই ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ২০২৪-এ এসে প্রথম বার বুন্দেশলিগা জিতেছে তারা। ‘নেভারকুসেন’ থেকে লেভারকুসেন হতে লেগে গিয়েছে ১২০ বছর!
আধুনিক ফুটবলে এ ধরনের কৃতিত্ব শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। শুধু কলকাতা বা ভারত কেন, বিদেশের ফুটবলেও প্রথম সারির ক্লাবেরা সাফল্যের জন্য দীর্ঘ দিন অপেক্ষা করতে রাজি হয় না। তাৎক্ষণিক সাফল্যেই বিশ্বাসী। না হলে কোচ বদল, খেলোয়াড় বদল, মালিকানা বদল, এ সব লেগেই থাকে। কিন্তু ১২০ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করার জন্য যেটা সবচেয়ে বেশি দরকার, তা হল সমর্থক এবং কর্তাদের ধৈর্য।
গত ১২০ বছরে এমন সময় কখনও যায়নি যে লেভারকুসেনের খেলা দেখতে সমর্থকেরা হাজির হননি। ক্লাবকে বয়কট করেছেন বা সমর্থন করেছেন অন্য কোনও দলকে, এমনও হয়নি। সাফল্য না পেলেও এত দিন ধরে নিজের প্রিয় ক্লাবকে সমর্থন করে যাওয়া অবিশ্বাস্য না হলে আর কী?
১২০ বছরের অপেক্ষা তা হলে কী ভাবে মিটল? উয়েফা সুপার কাপের ফাইনালে আটলান্টার কাছে হারলেও লেভারকুসেন গোটা মরসুম জুড়ে যা করে দেখিয়েছে, তা আদৌ আর হবে কি না, কেউ জানে না। ৫১ ম্যাচ অপরাজিত থাকার পর হেরেছে তারা। কোন জাদুমন্ত্রে বদলে গেল লেভারকুসেন? খুঁজতে চাইলে অনেক কারণ বেরোবে। প্রথম এবং প্রধান কারণ নিঃসন্দেহে কোচ জ়াবি আলোন্সো। এ ছাড়াও, সঠিক ফুটবলার আনা, ক্লাবের সঙ্কীর্ণ ভাবনা কাটিয়ে ওঠা, মানসিকতার বদলই এর নেপথ্যে রয়েছে।
জ়াবি-জাদুতে ভোলবদল
স্পেনের এই ফুটবলার যে কোচ হিসাবে এত বড় সাফল্য পাবেন এটা হয়তো স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। লিভারপুল, রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, স্পেনের হয়ে বিশ্বকাপ এবং ইউরো কাপ জয়ী ফুটবলার ঠান্ডা মাথার জন্য ফুটবলজীবনে বিখ্যাত ছিলেন। কিন্তু লেভারকুসেনে আসার আগে কোচ হয়ে এমন কোনও কাজ করেননি যার জন্য তাঁকে মনে রাখা যায়। তবে বছর শেষে সেই জ়াবি-জাদুতেই বদলে গেল লেভারকুসেন।
লেভারকুসেনের মরসুমটা শুরু হয়েছিল সালফেনডেনে। অস্ট্রিয়ান আল্পসের কোলে একটা ছোট্ট জনপদ। টেলিভিশন ক্যামেরায় রেকর্ড করা ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছিল এক অস্থিরচিত্ত মানুষকে। জ়াবি আলোন্সো। মাঠে দৌড়ে দৌড়ে একে ওকে নির্দেশ দিচ্ছেন। বলের পিছনে ছুটছেন। কোনও খেলোয়াড় ভুল করলে তাঁকে গিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। অক্লান্ত। পরিশ্রমী। অনুশীলন শেষ হলেও শান্তি নেই। ক্লান্ত পায়ে খাড়াই দিয়ে ফিরতে হবে হোটেলে। আশ্চর্যের ব্যাপার, দলের মধ্যেও কোনও ক্ষোভ নেই। বরং বন্ধুত্ব, সহযোগিতার পরিবেশ।
২০২২-এর অক্টোবরে লেভারকুসেনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন জ়াবি। এমন সময়ে, যখন দলটা ধুঁকছে লিগে সবার শেষে। রিয়াল সোসাইদাদ-এর ‘বি’ দলে কোচিং করানো জ়াবি যে দলের ভোল বদলে দেবেন, কেউ ভাবতে পারেননি। কিন্তু জ়াবির আস্থা ছিল নিজের উপর। সারা জীবন লং বলে খেলা জ়াবি লেভারকুসেনের কৌশলই বদলে দেন। তারা খেলা শুরু করে ছোট ছোট পাসে। দলের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, খেলোয়াড়দের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলা, দলমালিকদের বোঝানো— সব কিছুতেই তিনি হাজির। তবে আবেগ ছিল সীমাবদ্ধ। দল গোল করুক বা গোল হজম করুক, জ়াবির মধ্যে অতিরিক্ত আবেগ কখনওই দেখা যায়নি। তাঁকে দেখে আলাদা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়ে যেত খেলোয়াড়দের মধ্যেও।
কোচ জ়াবি আলোন্সো। ছবি: রয়টার্স
প্রাক্তন খেলোয়াড় তথা কোচ কৃষ্ণেন্দু রায় বললেন, “একটা ক্লাবের সাফল্য পেতে গেলে শুধু বড় নামের উপরেই দৌড়লে চলে না। সাধারণ কোনও কোচের উপরেও আস্থা রাখতে হয়। সাধারণ কোচেরাও যে অসাধারণ কাজ করতে পারেন, জ়াবি এবং লেভারকুসেনের সাফল্যই তার প্রমাণ। তবে আমি ধন্যবাদ দেব খেলোয়াড়দেরও। কোচ যতই পরিকল্পনা করুন, খেলোয়াড়েরা ঠিক মতো না খেলতে পারলে সেটা সম্ভব হয় না।”
কম অর্থেও সঠিক ফুটবলার আনা
যে দল সাধারণত লিগের নীচের দিকেই থাকে, তাদের জন্য কারাই বা অর্থ ঢালবে আর ভাল খেলোয়াড়েরা কেনই বা খেলতে আসবেন? জ়াবি জানতেন, তাঁর হাতে কোনও জাদুদণ্ড নেই যা মুহূর্তের মধ্যে সব বদলে দিতে পারে। তিনি ঠিক করেন, হাতে যাঁরা রয়েছেন, ভরসা রাখবেন তাঁদের উপরেই। এ ছাড়া, যতটুকু অর্থ পাওয়া যায়, সেটা দিয়েই কাজ চালাবেন।
প্রথমেই তিনি নিয়ে আসেন গ্রানিট জ়াকাকে। আর্সেনালে সাত বছর খেলা জ়াকা ইংল্যান্ডে খেলার আগ্রহ হারিয়েছিলেন। তা ছাড়া, অতীতে জার্মানির ক্লাবের হয়ে খেলার সুবাদে সেই দেশও তাঁর অচেনা নয়। জ়াবি পেলেন এক জন নেতাকে। তার থেকেও বড়, এক জন আদর্শ ‘হোল্ডিং মিডফিল্ডার’কে। সমস্যা হল অন্য জায়গায়। লেভারকুসেন ফুটবলার তুলে আনার জন্য বিখ্যাত ছিল। সেখানে ৩০ পেরোনো এক ফুটবলারকে কেন তাঁরা সই করাল তা নিয়ে ঝড় ওঠে। তাতেও পাত্তা দেননি জ়াবি।
সস্তায় পেয়ে যান ভিক্টর বোনিফেস এবং নাথান টেলার মতো স্ট্রাইকারকে। বায়ার্ন মিউনিখ থেকে লোনে নিয়ে আসেন জোসেপ স্টানিসিচকে। তবে লেভারকুসেনের অন্যতম সেরা দুই অস্ত্র হয়ে ওঠেন আলেক্স গ্রিমাল্ডো এবং জোনাস হফম্যান। মরসুম শেষে সবাই সফল।
অনুশীলনে লেভারকুসেনের ফুটবলারেরা। ছবি: রয়টার্স
সঙ্কীর্ণতা দূর করে ফুটবলারদের একতা
কম অর্থ থাকলেও ক্লাবের কর্তারা এমন একটা পেশাদার দল তৈরি করতে চাইছিলেন, যেখানে একে অপরের মধ্যে কোনও বিরোধ থাকবে না। হার বা জিত, সবেতেই ঐক্যবদ্ধ থাকবে দল। অনেক সময়েই সাফল্য পেতে থাকা দল এক জন বা দু’জন ফুটবলারের ‘ইগো’তে শেষ হয়ে গিয়েছে। লেভারকুসেনের কর্তারা নিশ্চিত করতে চাইছিলেন যাতে তাদের ক্লাবের সঙ্গে সে রকম কিছু না ঘটে।
লেভারকুসেনের ডিরেক্টর অফ স্পোর্ট সাইমন রোলফেস জানিয়েছেন, কী ভাবে জ়াকাকে কেন্দ্র করে গোটা দল গড়ে উঠেছে। জ়াকার ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা এবং মাঠে তাঁর উপস্থিতিই গোটা দলের জন্য যথেষ্ট। রোলফেস বলেছেন, “সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারেরা যে কোনও দলের হৃদয়। ওরাই ঠিক করে দল কেমন খেলবে। আমরা যখন দেখলাম জ়াকা অন্য ক্লাবে খেলার জন্য তৈরি, তখন আমি এবং জ়াবি গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলে আসি। ক্লাবে কোন ভূমিকায় ওকে দেখতে চাই সেটা নিয়ে কথা বলি। ও-ই যে ক্লাবের চালিকাশক্তি হতে চলেছে সেটা পরিষ্কার করে দিই।”
অনুশীলনে লেভারকুসেনের ফুটবলারেরা। ছবি: রয়টার্স
ব্যাকরুম স্টাফেদের ভূমিকা
যে কোনও ক্লাবের ক্ষেত্রেই শুধু কোচ নয়, তাঁর সঙ্গে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। রোলফেস তো ছিলেনই। তাঁর সঙ্গে ছিলেন টমাস এখিন। বরুসিয়া মুনশেনগ্লাডবাখের প্রাক্তন খেলোয়াড় এবং লেভারকুসেনের অ্যাকাডেমির প্রধান এখিন দলের নেপথ্যচালক। কার কোথায় সমস্যা, কার কী লাগবে, কোন ক্লাবের কোন ফুটবলার ফাঁকা— সব ছিল তাঁর নখদর্পণে। ক্লাবের ইতিহাসে প্রথম বার সব পজিশনে পছন্দের খেলোয়াড়দের সই করিয়েছে লেভারকুসেন।
মানসিকতায় বদল
জ়াবি আসার আগে লেভারকুসেনের একটা বড় সমস্যা ছিল, পেনাল্টি মিস্ করা। সেটা নির্ধারিত সময়ের খেলাই হোক বা শুটআউট, পেনাল্টিতে হার ছিল বাঁধা। জ়াবি এসে কোনও এক মন্ত্রে তা বদলে দেন। ইউরোপা লিগের প্লে-অফ ম্যাচে মোনাকোর বিরুদ্ধে শুটআউটে পাঁচটিতেই গোল করে লেভারকুসেন।
দলের হার-না-মানা মানসিকতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে সেটা বোঝা যায় গত মরসুমের বুন্দেশলিগায়। কতগুলি ম্যাচে লেভারকুসেন শেষ মুহূর্তে গোল করেছে তা এক ঝলকে গুনে হয়তো বলা সম্ভব নয়। শেষ মিনিট পর্যন্ত হাল না ছাড়ার জেদ দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে সফল ভাবে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন জ়াবি।
এবং ‘নেভারকুসেন’
লেভারকুসেনকে যে রকম অপমানের সম্মুখীন হতে হয়েছে অতীতে, তা সম্ভবত কোনও ক্লাবের সঙ্গেই হয়নি। ২০০০-২০০২ সময়কালের লেভারকুসেনের পারফরম্যান্স থেকেই ‘নেভারকুসেন’ নাম এসেছে। সেই সময় ক্লস টপমলারের দলের হাতে একাধিক ভাল মানের ফুটবলার ছিল। তা সত্ত্বেও তারা কিছু জিততে পারেনি। বুন্দেশলিগায় তৃতীয় স্থান এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রানার্স। জার্মানির অন্যান্য ক্লাবের সমর্থকেরা লেভারকুসেনের বিরুদ্ধে ম্যাচ থাকলেই ব্যঙ্গে ভরিয়ে দিতেন।
সমর্থকদের উল্লাস। ছবি: রয়টার্স
বছরের পর বছর অপমান, কটাক্ষ সহ্য করা লেভারকুসেন অবশেষে ঘুচিয়ে দিতে পেরেছে সেই বদনাম। মিটিয়ে দিতে পেরেছে সেই ক্ষত, যা বুকে নিয়ে বেড়িয়েছেন সমর্থকেরা। লেভারকুসেন এখন লেভারকুসেনই, ‘নেভারকুসেন’ নয়।