শেষ বার বিশ্বকাপের মঞ্চে নামবেন মেসি। অন্য দিকে পর পর দু’বার বিশ্বকাপ জয়ের লক্ষ্যে এমবাপে। —ফাইল চিত্র
লিয়োনেল মেসি। ফুটবল কেরিয়ারের শেষ বেলায় জ্বলে উঠেছেন। গোল করছেন। গোল করাচ্ছেন। ৩৬ বছরের খরা কাটিয়ে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতাতে মরিয়া তিনি। কিন্তু যে দলের বিরুদ্ধে তিনি ফাইনাল খেলবেন সেই দলে রয়েছেন কিলিয়ান এমবাপে। নিজের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ খেলছেন। তাতেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, আগামী দিনে বিশ্ব কাঁপাবেন। মেসি, রোনাল্ডো উত্তর যুগে বিশ্ব ফুটবলের পোস্টার বয় তিনিই। এ বারের বিশ্বকাপের ফাইনালেই কি ব্যাটনের হাতবদল হয়ে যাবে? মেসির ছেড়ে যাওয়া মঞ্চে কি নায়ক হয়ে উঠবেন এমবাপে?
সালটা ২০০৬। জার্মানি বিশ্বকাপ। শেষ বারের মতো ফুটবল বিশ্বকাপে খেলছেন রোনাল্ডো নাজারিয়ো। বিশ্ব ফুটবলের সেই মুহূর্তের সেরা তারকা। চার বছর আগেই ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। কিন্তু সে বার তিনি পারেননি। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন হলুদ জার্সিধারীরা। অন্য দিকে সে বারই প্রথম বার বিশ্বকাপের মঞ্চে আবির্ভাব হয়েছিল লিয়োনেল মেসির। ১৯ বছরের তরুণ। প্রথম বার খেলতে নেমে একটি গোল করেছিলেন। কিন্তু তখনই বোঝা গিয়েছিল, আগামী দিনে কী করতে চলেছেন তিনি। ঠিক যেমনটা বোঝা যাচ্ছে এমবাপের ক্ষেত্রে।
দু’জনের বয়সের তফাত ১২ বছর। মেসির রয়েছে অভিজ্ঞতা, যার বলে বলীয়ান হয়ে একের পর এক বাধা অতিক্রম করছেন তিনি। সেই সঙ্গে রয়েছে ঈশ্বরপ্রদত্ত পায়ের কাজ। ফলে একের পর এক প্রতিপক্ষ তাঁকে জোনাল মার্কিং করে রেখেও আটকাতে পারেনি। ঠিক ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছেন লিয়ো। ৩৫ বছরের মেসিকে অবশ্য গতিতে টেক্কা দিচ্ছেন ২৩ বছরের এমবাপে। ফরাসি ফুটবলার বল ধরলেই প্রতিপক্ষের রক্ষণ কেঁপে যাচ্ছে। মাঠের মধ্যে বল নিয়ে তাঁর দৌড় মনে করিয়ে দিচ্ছে উসেইন বোল্টকে। কী ভয়ঙ্কর! এই গতিতে বার বার প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে গোল করেছেন তিনি। এমবাপেকে আটকায়, সাধ্য কার।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৬, ২০১০, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২২, পাঁচটি বিশ্বকাপ মিলিয়ে মেসি এখনও পর্যন্ত ২৫টি ম্যাচ খেলেছেন। গোল করেছেন ১১টি। প্রতি ১৯৯ মিনিটে একটি করে গোল রয়েছে তাঁর। অন্য দিকে ২০১৮ ও ২০২২, মাত্র দু’টি বিশ্বকাপে ১৩টি ম্যাচে ৯টি গোল করে ফেলেছেন এমবাপে। প্রতি ১১২ মিনিটে গোল করেছেন তিনি। যে গতিতে এমবাপে এগোচ্ছেন, তাতে বিশ্বকাপের মঞ্চে সর্বোচ্চ গোলদাতা জার্মানির মিরোস্লাভ ক্লোজ়েকে (১৬টি গোল) টপকাতে তাঁর হয়তো আর একটি বিশ্বকাপ লাগবে। সেখানে এখনও অন্তত তিনটি বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পাবেন এমবাপে।
তবে ক্লাবের হয়ে মেসি যতটা সফল, তার ধারেকাছেও তিনি পৌঁছাতে পারেননি দেশের হয়ে। বার্সেলোনার হয়ে লা লিগা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, কোপা দেল রে থেকে শুরু করে প্যারিস সঁ জরমঁ-এর হয়ে লিগ ওয়ান, সব জিতেছেন। সাত বার বালঁ দ্যর জিতেছেন। কিন্তু দেশের হয়ে একটি অলিম্পিক্স সোনা ও একটি কোপা আমেরিকা ছাড়া কিছু নেই। কোপার ফাইনালে দু’বার ও বিশ্বকাপের ফাইনালে এক বার হেরেছেন। অন্য দিকে ক্লাবের পাশাপাশি দেশের হয়েও সফল এমবাপে। এখানেই মেসিকে টেক্কা দিচ্ছেন এমবাপে।
একটি ক্ষেত্রে অবশ্য মেসির থেকে পিছিয়ে এমবাপে। মেসি বিশ্বকাপে ৮টি গোল করিয়েছেন। সেখানে এমবাপে করিয়েছেন মাত্র ২টি গোল। দু’জনের খেলার ধরন অবশ্য আলাদা। মেসি অনেক বেশি প্লে-মেকারের ভূমিকায় থাকেন। খেলা তৈরি করেন তিনি। তাই তাঁর অ্যাসিস্ট বেশি। কিন্তু এমবাপে উইঙ্গারের ভূমিকায় খেলেন। সে ক্ষেত্রে তিনি গোল করানোর থেকে গোল করার দিকেই মন দেন বেশি।
বিশ্বকাপ নতুন নতুন প্রতিভার জন্ম দেয়। ২০০৬ সালে যেমন জন্ম দিয়েছিল মেসির। ব্রাজিলের রোনাল্ডোর ছেড়ে যাওয়া আসনে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে একটু একটু করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মেসি। সেই প্রতিষ্ঠা এমনই, যে এ বার গোটা বিশ্বের ফুটবল সমর্থকদের একটা বড় অংশ চাইছে মেসির জন্যই বিশ্বকাপ জিতুক আর্জেন্টিনা। তিনি বিশ্বকাপের সমার্থক হয়ে উঠেছেন।
ঠিক তেমনই গত বারের বিশ্বকাপে জন্ম হয়েছিল এমবাপের। এ বারের বিশ্বকাপে তিনি তারকা। মেসি, রোনাল্ডোদের পরে তাঁকে নিয়েই সব থেকে বেশি আলোচনা হচ্ছে। তবে কি ফাইনালের মঞ্চেই মেসির হাত থেকে ব্যাটন নিয়ে নেবেন তিনি! অভিজ্ঞতা কি হেরে যাবে তারুণ্যের কাছে? নাকি মেসি আরও এক বার জ্বলে উঠবেন? নিভে যাওয়ার আগে যে ভাবে শেষ বারের মতো জ্বলে ওঠে প্রদীপের শিখা। বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেই কি এমবাপেকে গোপনে নিজের ব্যাটন তুলে দেবেন লিয়ো? যে ফলই হোক না কেন, এক তারকার বিদায় মঞ্চ বরণ করে নেবে আর এক তারকাকে। মেসির বিদায় মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত হবেন এমবাপে।