জাতীয় সঙ্গীত গাইছেন গ্যারেথ বেলরা। ছবি: রয়টার্স
পাশাপাশি দু’টি দেশ। অলিম্পিক্স এবং ক্রিকেটে একসঙ্গেই খেলে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস। আবার ফুটবলের মতো কয়েকটি খেলায় তারা প্রতিপক্ষ। তাই প্রতিদ্বন্দ্বিতাও বেশি। সেই ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস মঙ্গলবার নামছে ফুটবল বিশ্বকাপের মঞ্চে। তার আগে একটিতে জিতেই মাঠে নামতে চলেছে ওয়েলস।
মঙ্গলবার ভারতীয় সময় রাত ১২.৩০ মিনিটে খেলতে নামবে দুই দেশ। নিয়ম মতো মাঠে নেমে যে যার নিজের জাতীয় সঙ্গীত গাইবে। এই জাতীয় সঙ্গীতের লড়াইয়েই ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়েছে ওয়েলস। ইংল্যান্ড এবং জার্মানির কিছু সঙ্গীতজ্ঞ একটি গবেষণা করেন কয়েক বছর আগে। সেখানে সব জাতীয় সঙ্গীতের একটি তালিকা তৈরি করা হয়। দেখা হয় কোন গান গাইতে মানুষ সব চেয়ে স্বচ্ছন্দ। সেটাকে ‘সিঙ্গাবিলিটি লিস্ট’ বলা হচ্ছে। সেই তালিকায় সবার উপরে ফ্রান্স। তাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘লা মার্সেইলাইস’কেই সেরা মেনে নেওয়া হয়। গত বারের ফুটবল বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নদের গানের কথাগুলিকেও সেরা বলে মেনে নেওয়া হয়।
এই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ওয়েলসের জাতীয় সঙ্গীত ‘ল্যান্ড অফ মাই ফাদার্স’। ব্রিটিশ জাতীয় সঙ্গীত ‘গড সেভ দ্য কুইন’-কে তারা ১০ গোল দিয়েছে। কারণ, ‘গড সেভ দ্য কুইন’ এই তালিকায় নীচের দিক থেকে দু’নম্বরে। ওই সমীক্ষার সঙ্গে যুক্ত অ্যালিসান পলেই ব্রিটেনের জাতীয় সঙ্গীত সম্পর্কে বলেন, “গানের সুরটা এমন যে সব মানুষ গাইতে পারবেন না। বিশেষ করে যাঁদের গলা চড়ায় ওঠে না। আর গানটা এমন নয় যে, সকলে একেবারে একাত্ম হয়ে যেতে পারবে ওটার সঙ্গে।”
শুধু সুর নয়, ব্রিটিশ জাতীয় সঙ্গীতের কথাও মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারে না বলে ওই সমীক্ষার মত। ‘গড সেভ দ্য কুইন’ এমন একটি গান যা দেশের কথা বলে না। ওয়েলসের ‘ল্যান্ড অফ মাই ফাদার্স’-এ দেশের সংস্কৃতির কথা শোনা যায়। কিন্তু ‘গড সেভ দ্য কুইন’ গানে ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ যত দিন সিংহাসনে ছিলেন, তাঁর সুস্থতা এবং সিংহাসনে থাকার কথা বলা হয়েছে। ৭০ বছর পর যদিও সেই আবেগটা আর পাওয়া যাচ্ছে না বলেই মত ওই সমীক্ষায়।
রানির মৃত্যুর পর এখন ব্রিটিশদের জাতীয় সঙ্গীত ‘গড সেভ দ্য কিং’। রাজা চার্লসের মা বেঁচে থাকার সময় গাওয়া হত ‘গড সেভ দ্য কুইন’। যে গানটি খুব জনপ্রিয় ছিল না। ‘ইউগভ’ নামে একটি সংস্থা ২০১২ সালে এই বিষয়ে ভোট নেয়। সেই ভোটে অংশ নেওয়া ৭০ শতাংশ মানুষ রাজপরিবারের পক্ষে থাকলেও বিরাট শতাংশ মানুষ জাতীয় সঙ্গীত পছন্দ নয় বলে জানিয়েছিলেন।
‘গড সেভ দ্য কিং’কে জাতীয় সঙ্গীত বলা হলেও আইনে এটার কোনও উল্লেখ নেই, তাই ইংল্যান্ড যেখানে খেলতে নামছে, সেখানে অন্য কোনও গানও ব্যবহার করা যেতে পারে। ২০১০ সালে ‘কমনওয়েলথ গেমস কাউন্সিল ফর ইংল্যান্ড’ মানুষের কাছে জানতে চায় যে, ‘গড সেভ দ্য কুইন’, ‘জেরুজ়ালেম’ এবং ‘ল্যান্ড অফ হোপ অ্যান্ড গ্লোরি’ এই তিনটির মধ্যে কোন গানটিকে ইংল্যান্ড দলের প্রধান সঙ্গীত করা উচিত। ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রথম হয়েছিল ‘জেরুজ়ালেম’। সে দেশের খুবই জনপ্রিয় গান এটি। ইংল্যান্ডের বেশির ভাগ অনুষ্ঠানেই এই গান শোনা যায়। স্যর হুবার্ট পেরির সুর সকলকে অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু উইলিয়াম ব্লেকের লেখা এই গানের কথা ঠিক জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার উপযুক্ত নয়।
গানের কথা অনুযায়ী, যীশু খ্রিস্ট ইংল্যান্ডে পা রেখেছিলেন, দেশের পশ্চিম প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। কিন্তু এর কোনওটাই হয়নি। অনেকের মতে গানের কথায় ব্লেক যে ‘দ্য ডার্ক সাটানিক মিলস’এর কথা বলেছিলেন, তা ক্যাথিড্রাল চার্চ। যেটার ভক্ত ছিলেন না লেখক। এই গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত করতে আরও একটি বাধা রয়েছে। ইজ়রাইলের রাজধানীর নাম জেরুজ়ালেম। এই গানটির নামও তাই। অন্য একটি দেশের রাজধানীর নামে জাতীয় সঙ্গীতের নাম মেনে নেওয়া কঠিন।
জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে তাই বিকল্প হতে পারে ‘আই ভাও টু দি মাই কান্ট্রি’। যেটার সুর দিয়েছিলেন গুস্তব হোলস্ট। কিন্তু রাজার পক্ষে এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে মেনে নেওয়া একটু কঠিন। তাঁর প্রয়াত স্ত্রী ডায়ানা এই গানটি বেছে নিয়েছিলেন তাঁদের বিয়ের জন্য। ডায়ানার মৃত্যুর পর তাঁর শোকসভাতেও এই গান গাওয়া হয়েছিল। সেসিল স্প্রিং রাইসের এই কবিতার কথাগুলি ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার কথা বলে না। এই কবিতা দেশপ্রেমের আদর্শকে খ্রিস্টান আধ্যাত্মিক পরিত্রাণের ধারণার সঙ্গে যুক্ত করার কথা বলে। সেই সঙ্গে এই গান ‘রুল, ব্রিটানিয়া’ বা ‘ল্যান্ড অফ হোপ অ্যান্ড গ্লোরি’র মতো গাওয়া সহজ নয়। ‘আই ভাও টু দি মাই কান্ট্রি’ গানটি লেখা হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। জাতীয় সঙ্গীতের থেকে এই গানের গুরুত্ব অন্য জায়গায় অনেক বেশি। কমনওয়েলথ দিবসে যে পরিষেবাগুলি দেওয়া হয়, তার সঙ্গে এই গান অনেক বেশি সম্পৃক্ত।
জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে ওয়েলশ (ওয়েলসের অধিবাসী) এবং স্কটিশদের একটা লড়াই রয়েছে। সেই লড়াই নিয়ে বেশ কিছু ব্যঙ্গাত্মক গান লিখেছেন মাইকেল ফ্ল্যান্ডারস এবং ডোনাল্ড সোয়ান। ১৯৫০ সালের শেষ থেকে ১৯৬০ সালের শুরু পর্যন্ত একাধিক ব্যঙ্গাত্মক গান তৈরি করেছিলেন তাঁরা। এর মধ্যে ‘দ্য হিপোপটেমস সং’ বিখ্যাত হয়েছে। এই বিষয় নিয়ে ফ্ল্যান্ডারস বলেন, “কখনও এটা নিয়ে ভাবা হয়েছে কি না জানি না, ইংল্যান্ডের কিন্তু কোনও জাতীয় সঙ্গীত নেই। আমি শুধু ইংল্যান্ডের কথা বলছি। বাকি যে দেশগুলি রয়েছে তাদের নিজেদের জাতীয় সঙ্গীত রয়েছে। তাদের নিজেদের দেশের কথা রয়েছে সেই গানে। স্কটিশ, আইরিশ, ওয়েলশদের গান তাদের দেশ সম্পর্কে ভাল কথা বলে এবং ইংল্যান্ড সম্পর্কে তাদের নিজেদের ভাষায় খারাপ মন্তব্য করে।”
ফ্ল্যান্ডারস এবং সোয়ান ইংল্যান্ড নিয়ে একটি ব্যঙ্গাত্মক গান লেখেন। জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে তারা সেই গানটি ভাবার কথাও বলেছিলেন। তাঁরা লেখেন, “দ্য ইংলিশ, দ্য ইংলিশ, দ্য ইংলিশ আর বেস্ট।” সেই গানে তাঁরা ইংল্যান্ডের জয়গান গাওয়ার সঙ্গে আইরিশ, স্কটিশ, ওয়েলশদের নিন্দা করেন। সে সবই ছিল ব্যঙ্গাত্মক। তাঁদের গানে একটি লাইন ছিল, “দ্য ইংলিশ আর মরাল, দ্য ইংলিশ আর গুড, অ্যান্ড ক্লেভার অ্যান্ড মডেস্ট অ্যান্ড মিসআন্ডারস্টুড।” অর্থাৎ ইংরেজরা নৈতিক, ইংরেজরা ভাল এবং তারা বুদ্ধিমান, সৎ, ইংরেজদের শুধু ভুল বোঝা হয়। ব্যঙ্গাত্মক ভাবেই তাঁরা এই লাইন ব্যবহার করেছিলেন।
এর মাঝে একটি কথা কিন্তু সত্যি— ক্রীড়া বিশ্বে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় ইংরেজদের নিজেদের কোনও গান নেই। ‘গড সেভ দ্য কিং’ ব্রিটিশদের জাতীয় সঙ্গীত, ইংল্যান্ডের নয়। অন্য দেশগুলির মতো তাদেরও একটা নিজেদের গান থাকা উচিত বলে মনে করেন অনেকে। বেশ কিছু ইংরেজদের মতে তাদের জাতীয় সঙ্গীত কখনও শিরদাঁড়ায় স্রোত বইয়ে দেয় না। জাতীয়তা বোধ তৈরি করে না। ‘ইউগভ’ সংস্থার সমীক্ষায় অনেকে জানিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের জাতীয় সঙ্গীত নিস্তেজ, হতাশাজনক এবং নৈরাশ্যবাদী।
অর্থাৎ মঙ্গলবার ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের বিশ্বকাপ ম্যাচে খেলতে নামার আগে গ্যারেথ বেলরা এবং তাঁদের দেশবাসীরা যখন “গল্যাড, গল্যাড” (ওয়েলসের জাতীয় সঙ্গীত) গাইবেন, জানবেন যে গানের লড়াইয়ে হ্যারি কেনদের হারিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। ম্যাচের ফল যাই হোক না কেন।