স্বপ্ন ছুঁয়ে চুমু: ফিরল ’৮৬-তে মারাদোনার বিশ্বকাপ জয়ের স্মৃতি। কাতারের লুসেল স্টেডিয়ামে লিয়োনেল মেসি। রবিবার।
বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিচ্ছে এই শতাব্দীর সেরা ফুটবল জাদুকর। কাতার বিশ্বকাপ বোধনের দিন থেকে এই কথাটা বারবার আমাকে যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত করেছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো লিয়োনেল মেসির ফুটবল দেখেছি আর নীরবে চোখের জল মুছেছি। এই ছেলেটাকে আর আর্জেন্টিনার জার্সিতে বিশ্বকাপে কখনও দেখব না!
রবিবার লুসেল স্টেডিয়ামে স্বপ্নের বিশ্বকাপ হাতে নিয়ে হাসছে সাড়ে পাঁচ ফুটের ছোটখাটো চেহারার ছেলেটা। মন্তিয়েল বল জালে জড়িয়ে দিয়ে জার্সি খুলে ছুটে চলেছে গ্যালারির দিকে। সতীর্থদের আলিঙ্গনে ঢেকে গিয়েছে মেসি। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। এই আনন্দাশ্রু তো স্বপ্নপূরণের। সেই ২০০৬-তে যে স্বপ্নের জন্ম হয়েছিল, আজ তা পরিপূর্ণতা পেল। চোখ আমারও ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। ওর মতো আমরাও যেন শাপমুক্ত হলাম। নিঃসন্দেহে ফুটবলের সর্বকালের সেরা জাদুকরের বিদায় তো এমনই হওয়া উচিত। না হলে যে ফুটবল ইতিহাসই অসম্পূর্ণ থেকে যেত!
চার বছর আগে রাশিয়ার মঞ্চ থেকে বিদায় ফ্রান্সের কাছে হেরে। নতুন তারা কিলিয়ান এমবাপে নিয়ে ফুটবলবিশ্বের উল্লাস। আজ সকালে বেশ কিছু বন্ধু এমনও বলছিল যে, শেষ যুদ্ধে আর্জেন্টিনীয় তারকাকে কিন্তু পিছনেই ফেলে দেবে প্যারিস সঁ জরমঁ-এর সতীর্থ! সেটা প্রায় হয়েই গিয়েছিল। কিন্তু রবিবার লুসেলের রাত যে ছিল লিয়োনেল মেসির-ই।
সত্যিটা মেনে নিতে লজ্জা নেই, লিয়োকে নিয়ে আমার কিন্তু খুবই দুর্বলতা রয়েছে। ওর কথা প্রথম বলেছিল আমার দেশ ইরানের কিংবদন্তি ফুটবলার আলি দায়ি। এক অনুষ্ঠানে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ফুটবল নিয়ে কথা হচ্ছিল। সেই সময় আলি বলে ওঠে, ‘‘মেসি ছেলেটার দিকে নজর রাখো।
ও কিন্তু বিশ্বফুটবলকে জাদু দেখাতে এসেছে।’’ সেই আমার লিয়ো ভক্ত হয়ে ওঠা। ফুটবল মাঠে ওর উত্থান-পতনের সঙ্গে কখন যেন আমিও নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি।
সেই কারণেই বন্ধুদের মন্তব্য চুপ করে হজমই করেছিলাম এবং প্রার্থনা করেছি, বিদায়ী মঞ্চে নিজেকে একবার মেলে ধরো লিয়ো। তোমার হার শুধু আর্জেন্টিনা বা বিশ্বব্যাপী সমর্থকদেরই নয়, হারবে ফুটবলও। মেসি হারতে দেয়নি নিজের দেশকে। চোখের জল ফেলতে দেয়নি সমর্থকদের। মাথা নত হতে দেয়নি আমার মতো এই গ্রহের অগুন্তি মেসিপ্রেমীদের। অনেক আনন্দ দিলে জাদুকর, তোমাকে কুর্নিশ।
সত্যি বলতে, এ দিন যে ভাবে আর্জেন্টিনা ম্যাচ শুরু করেছিল, তার পরে কে-ই বা ভাবতে পেরেছিলেন, ম্যাচের সমাপ্তি এমনটা হবে! নির্ধারিত সময়ে ফল ২-২। অতিরিক্ত সময়ে ফল ৩-৩! তার পরে টাইব্রেকার। এমিলিয়ানো মার্তিনেসের দুটো হাতই তুলে দিল কাঙ্ক্ষিত বিশ্বকাপ।
প্রথম ৪৫ মিনিটে ফ্রান্সকে তো খুঁজেই পাওয়া গেল না! স্কালোনি সেরা চালটা দিয়েছিল অ্যাঙ্খেল দি মারিয়াকে নামিয়ে। আর গোটা বিশ্বকাপে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা আঁতোয়া গ্রিজ়ম্যানকে নিষ্ক্রিয় করে দিল রদ্রিগো দে পল আর ফার্নান্দেসকে দিয়ে। ওরাই জিহু, এমবাপের বল পাওয়ার পথটা কেটে দিল। ফ্রান্স ওখানেই থমকে গেল।
২০১৪ সালের ফাইনালটা দি মারিয়া খেলেনি চোটের জন্য। এ বারও ও নিয়মিত ছিল না সেই চোটের করণে। কিন্তু জীবনের শেষ বিশ্বকাপ তো ওর কাছেও জবাব দেওয়ার ছিল। বাঁ দিক দিয়ে ক্রমাগত আক্রমণে উঠে দি মারিয়া ফরাসি রক্ষণের দুর্গে ফাটল ধরিয়ে দেয়। যদিও আমার কাছে দুর্বোধ্য রয়ে গেল, স্কালোনি কেন ওকে নিল! ফ্রান্স ম্যাচে ফিরল সেখানেই।
৩৫ মিনিটে গোলটাও এল সেই মেসির হাত ধরেই। একটা বাঁ পা কতটা ধারালো হতে পারে, ১৯৮৬ বিশ্বকাপে তা দেখিয়েছিলেন দিয়েগো মারাদোনা। আমি নিশ্চিত, এই রাত তিনিও উপভোগ করছেন। দুই ডিফেন্ডারের মাঝখান থেকে মেসির বাঁ পা ঝলসে উঠল। বল গেল দে পলের কাছে। সেখান থেকে দি মারিয়াকে লক্ষ্য করে থ্রু আলভারেসের। বাকিটা তো সকলেই দেখেছেন।
তার আগে ২৩ মিনিটে পেনাল্টি থেকে মেসির গোল। দেম্বেলে পেনাল্টি বক্সের মধ্যে ফাউল করে দি মারিয়াকে। রেফারির সিদ্ধান্তে কোনও ভুল ছিল না। তার চেয়েও বড় ব্যাপার ছিল, শট নিতে যাওয়ার আগে মেসির এক মুহূর্তের জন্য চোখটা বন্ধ করা। নিজে ফুটবল খেলেছি বলেই জানি, ওই সময় জীবনের সমস্ত নেতিবাচক ঘটনাগুলো মাথায় এসে ভিড় করে। কিন্তু লিয়ো যে অন্য ধাতুতে গড়া!। লরিসকে বিভ্রান্ত করে বল জালে জড়িয়ে দিল। অতিরিক্ত সময়ের ১০৮ মিনিটে ঠান্ডা মাথায় ফের গোল।
তবে মেসির স্বপ্নপূরণের রাতে অবশ্যই বলব কিলিয়ান এমবাপের কথা। বিশ্বকাপের ফাইনালে হ্যাটট্রিক করে ম্যাচ থেকে হারিয়ে যাওয়া ফ্রান্সকে ও-ই তো ফিরিয়ে আনল।
কিন্তু ফুটবলের ঈশ্বর যে আজ লিখেছিলেন অন্য কাহিনি। জাদুকরকে যে এ ভাবেই বিজয়ীর মুকুট পরিয়ে বিদায় জানাতে হয়!