উন্মাদনা: ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়ে আট বছর পরে ফের বিশ্বকাপের ফাইনালে মেসির আর্জেন্টিনা। বুয়েনোস আইরেসে এ ভাবেই জনতার ভিড় উপচে পড়ল উৎসব করতে। ফাইল চিত্র
দিয়েগো মারাদোনার নেতৃত্বে ১৯৮৬ সালে মেক্সিকোয় আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের সময় আমি খুব ছোট ছিলাম। তবুও এখনও মনে আছে বুয়েনোস আইরেসের সব রাস্তা সে দিন চলে গিয়েছিল মানুষের দখলে। বাবার কোলে চড়ে আমিও সামিল হয়েছিলাম বিশ্বজয়ের উৎসবে। ৩৬ বছর পরে মঙ্গলবার বিকেলে সেই দৃশ্য যেন ফিরে এল। যদিও আমরা এখনও বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হইনি। কিন্তু আর্জেন্টিনীয়দের উন্মাদনা দেখে তা বোঝার উপায় নেই।
আমার জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা মারাদোনার পাড়াতেই। সান মিগুয়েলে আমি যেখানে থাকি, সেখান থেকে হার্দিন বেসা ভিস্তার দূরত্ব খুব বেশি নয়। হেঁটেই যাওয়া যায়। বেসা ভিস্তাতেই মাটির নীচে চিরঘুমে রয়েছেন ফুটবল ঈশ্বর। মন খারাপ হলেই ওখানে চলে যাই আমি। গত ২৫ নভেম্বর মারাদোনার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর সকালেও গিয়েছিলাম ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে ও মেসিদের জন্য আশীর্বাদ চাইতে। ফুটবল ঈশ্বর নিশ্চয়ই আমাদের প্রার্থনা শুনেছেন। মঙ্গলবার কাতারে যখন ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে সেমিফাইনাল খেলতে আর্জেন্টিনা মাঠে নামল, বুয়েনোস আইরেসে তখন বিকেল চারটে। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, দুরুদুরু বুকেই খেলা দেখতে টেলিভিশনের সামনে বসেছিলাম। ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দেওয়া ক্রোয়েশিয়াকে নিয়ে চিন্তা ছিলই। ম্যাচের প্রথম মিনিট পঁচিশেক প্রচণ্ড উদ্বেগের মধ্যেই কাটিয়েছিলাম। ৩৪ মিনিটে পেনাল্টি থেকে লিয়ো ১-০ করার পরে স্বস্তি ফিরেছিল। ৩৯ মিনিটে ইউলিয়ান আলভারেস ২-০ করতেই আমার মতো আর্জেন্টিনার সকলেই নিশ্চিত হয়ে যান, ফাইনালে ওঠা কেউ আটকাতে পারবে না। প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বুয়েনোস আইরেসের রাস্তায় শুধু নীল-সাদা জার্সি, পতাকা নিয়ে মানুষের ঢল নামতে শুরু করে। আমিও আর বাড়িতে বসে থাকতে পারিনি। আমার বছর সাতেকের মেয়ে পাজ় (শান্তি)-র হাত ধরে বেরিয়ে পড়ি। আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে বিভিন্ন ভাবে যুক্ত থাকার সৌজন্যে মেসির একটি জার্সি উপহার হিসেবে আমাকে দিয়েছিলেন এক কর্তা। তার পর থেকে আর্জেন্টিনার ম্যাচ থাকলেই আমার মেয়ে সেই জার্সি পরে খেলা দেখে। মঙ্গলবার বিকেলেও মেসির জার্সি পরেই পাজ় আমার সঙ্গে নাচতে নাচতেই চলল।
আমাদের জীবন জুড়ে সব সময় থাকেন মারাদোনা। আমরা আর্জেন্টিনীয়রা বিশ্বাস করি, ফুটবল ঈশ্বরের আশীর্বাদেই বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছেন মেসিরা। সান মিগুয়েল থেকে কয়েক হাজার মানুষ মিছিল করে প্রথমেই গিয়েছিলেন বেসা ভিস্তায় মারাদোনাকে শ্রদ্ধা জানাতে। সেখান থেকে সিটি সেন্টারে। ২০১৪ বিশ্বকাপের সময় আমি ব্রাজিলে ছিলাম। স্ত্রীর কাছে শুনেছিলাম, তখনও নাকি আর্জেন্টিনা ফাইনালে ওঠার পরে রাস্তায় প্রচুর মানুষ উৎসব করেছিলেন। কিন্তু এ রকম উন্মাদনা দেখা যায়নি। এমনকি ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা আমেরিকায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে হওয়া উৎসবকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ আনন্দে পাগলের মতো চিৎকার করছেন, নাচছেন, জাতীয় পতাকা নিয়ে দৌড়চ্ছেন, মারাদোনা ও মেসির ছবি বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলিতে ক্রমাগত হর্ন বেজে চলেছে। কেউ কেউ গাড়ির ছাদে উঠেও নাচছিলেন। অসাধারণ দৃশ্য।
মেসিকে ভালবাসলেও বুয়েনোস আইরেসের মানুষের কাছে মারাদোনাই শেষ কথা। আর্জেন্টিনা শেষ পর্যন্ত কাতারে বিশ্বকাপ জিতলেও আমাদের মনোভাব বদলাবে বলে মনে হয় না। তবে খুব পিছিয়ে নেই মেসিও। আর্জেন্টিনার মানুষ বিশ্বাস করেন, লিয়োই পারবেন বিশ্বকাপ জিতে ৩৬ বছরের যন্ত্রণা ভোলাতে। আমার এক বন্ধু মিছিলে হাঁটতে হাঁটতেই জানাল, মারাদোনা ও মেসির ছবি দেওয়া নীল-সাদা পতাকা বানানোর অর্ডার ইতিমধ্যেই দিয়েছে। বিশ্বকাপ ফাইনালের দিন সকালে ওর অ্যাপার্টমেন্টের ছাদ থেকে ঝোলাবে। ট্রফি জিতে মেসিরা দেশে ফিরলে বিশাল সেই পতাকা নিয়ে বিমানবন্দরে যাবে। উৎসবের মধ্যেও শুরু হয়ে গিয়েছিল বিশ্বকাপ ফাইনালের টিকিটের খোঁজ। আমার সামনেই আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনের এক কর্তাকে ফোন করে একজনকে বলতে শুনলাম, ‘‘যে কোনও মূল্যে আমার একটা ফাইনালের টিকিট চাই। দরকার হলে বাড়ি, গাড়ি সব বিক্রি করে অর্থ জোগাড় করব।’’ টিকিটের চাহিদা হঠাৎ করে এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে, আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনের অধিকাংশ কর্তাই কারও ফোন ধরছেন না। আমাকে তো এক জন বলেই দিলেন, ‘‘বিশ্বকাপ ফাইনালের টিকিট বাদ দিয়ে অন্য কিছু চাইলে দিতে পারি। কোনও অবস্থাতেই টিকিট দিতে পারব না।’’ আমি অবশ্য টিকিট চাই-ও না। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে রিয়োর মারাকানা স্টেডিয়ামে আমিও ছিলাম। জার্মানির কাছে হারের পরে চোখের জলে মাঠ ছেড়েছিলাম। এ বার আর ঝুঁকি নেওয়ার সাহস নেই। টেলিভিশনেই ফাইনাল দেখব। আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হলে বুয়েনোস আইরেসের রাস্তায় এ ভাবেই উৎসব করব। আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হলে ফাইনাল না দেখার কোনও দুঃখ থাকবে না।