ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়। ফাইল ছবি।
ভারতীয় ফুটবলের মান পড়ে যাওয়া এবং ক্লাবগুলির স্পনসর বা বিনিয়োগকারী পাওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে যাওয়া— এই দু’টির জন্য সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনকে দায়ী করলেন ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়।
ভারতের এই প্রাক্তন গোলরক্ষকের বক্তব্য, ‘‘সারা পৃথিবী জুড়ে ফুটবল খেলিয়ে দেশগুলো সাফল্য পাচ্ছে। এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষেত্রেও সেই একই ছবি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই তাদের ইনভেস্টার কিংবা স্পনসর পেতে কোনও অসুবিধা হয় না। কিন্তু ভারতের জাতীয় দল সেই জায়গায় পৌঁছয়নি, যাতে এক কথায় তাকে দেখে স্পনসর আসবে। সবার আগে দরকার ভারতের জাতীয় দলকে এশিয়ার বাকি দেশগুলোর মতো সেই উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া।’’
কী ভাবে সেটা সম্ভব, তার উপায় বাতলেছেন ভাস্কর। বললেন, ‘‘ক্লাব স্তরের ফুটবল সমৃদ্ধ হলে তবেই সেটা সম্ভব হবে। তার জন্য প্রথমেই দরকার প্রতিযোগিতার সংখ্যা বাড়ানো। আগে সারা দেশে ১০ থেকে ১১টা প্রথম সারির ফুটবল প্রতিযোগিতা হত। সারা বছরে একজন ফুটবলার ৯০টার উপর ম্যাচ খেলত। এ ছাড়াও বিভিন্ন রাজ্যে লিগ হত। সেখান থেকেও বহু প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলার উঠে আসত। এখন সব বন্ধ হয়ে গিয়ে শুধু সবেধন নীলমনি একটাই প্রতিযোগিতা।’’
ভাস্করের প্রশ্ন, ‘‘সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন কি পারে না বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রতিযোগিতাগুলো শুরু করতে? তারা কি পারে না রাজ্য সংস্থাগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে সেখানে ফুটবল লিগ চালু করতে? বছরের পর বছর ধরে সেই হাতে গোনা খেলোয়াড়দের নিয়েই জাতীয় ফুটবল দল চলছে।’’
আইএসএল যে ভাবে শুরু হয়েছে এবং চলছে, তার সমালোচনা করে ভাস্কর বললেন, ‘‘আমাদের দেশের ফুটবলপ্রেমী মানুষের মধ্যে আশি থেকে পঁচাশি শতাংশ ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহমেডানের সমর্থক। আশ্চর্যের বিষয়, এই তিন ক্লাবকে বাদ দিয়েই ফুটবলের একটা নতুন পরিকাঠামো তৈরি হয়েছিল। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান যুক্ত হওয়ার আইএসএলের পারফরম্যান্স কী ছিল? আইএসএল থেকে ক’জন ফুটবলার ভারতের জার্সি গায়ে খেলেছে? সেই তো আই লিগ থেকেই ফুটবলাররা ভারতীয় দলে খেলেছে। তা হলে আইএসএলের ফলে দেশের ফুটবল পরিকাঠামোর পরিবর্তন কোথায় হল?’’
আইএসএল কি আর্থিক দিক থেকেও লাভবান হচ্ছে, প্রশ্ন তুলছেন ভাস্কর। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সব সময়ই চাই, ফুটবলাররা আরও বেশি পরিশ্রম করে বেশি টাকা উপার্জন করুক। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠান ফুটবলারদের দেখছে তারই যদি সঠিক মূল্যায়ন না করা যায়, তা হলে ফুটবলারকা বাঁচবে কী করে? এখন আইএসএলের প্রতিটি দল আর্থিক ভাবে ধুঁকছে। বছরে পঁচিশ থেকে তিরিশ কোটি টাকা করে তারা লোকসান করছে। অনেকেই বলেন, ফুটবলারদের পিছনেই অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। এখানেই আমার প্রশ্ন, যে ফুটবলার আই লিগে খেলে মাসে ৬০ হাজার টাকা পায়, তাকে আইএসএলে খেলার জন্য বছরে পঞ্চাশ লাখ টাকা দিতে হবে?’’
আইপিএলের উদাহরণ টেনে ভাস্কর বললেন, ‘‘আইপিএলের দলগুলো তো আর্থিক লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে না। আইপিএলের ঘরনায় আইএসএল কেন হচ্ছে না? যাঁরা আইএসএল পরিচালনা করছেন, তাঁদের এবং ফেডারেশনের মাথায় রাখা উচিত যে, ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহমেডানকে আইএসএলে যুক্ত করলে তবেই সামগ্রিক পরিকাঠামোর উন্নতি হবে। দেশ জুড়ে ফুটবলের সেই উন্মাদনা ফিরে আসবে।’’
ক্লাব ও ইনভেস্টারের মধ্যে যে সঙ্ঘাত, তা নিয়ে ভাস্করের সাফ কথা, ‘‘ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে শেয়ার হোল্ডার পাঁচ বার বদলেছে। কিন্তু তার জন্য ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের যে কর্তারা আছেন, যাঁরা ফুটবল পরিচালনা করেন, তাঁদের তো বদল করতে হয়নি। একটা বাণিজ্যিক সংস্থা এসে আর্থিক দিকটা ভাল ভাবে দেখতে পারেন এবং অবশ্যই সেটা দেখবেন। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ফুটবল পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের জ্ঞান কোথায়? যাঁরা ফুটবল খেলেছেন, যাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে প্রতিষ্ঠান চালিয়েছেন, যাঁরা খেলাধুলোর সঙ্গে যুক্ত, ফুটবল পরিচালনায় তাঁদের থেকে উপযুক্ত আর কেউ হতে পারে বলে মনে হয় না। আমাকে তো ক্লাব কর্তারাই নিয়ে এসেছিলেন। তা হলে কর্তারা ফুটবলার চেনেন না, এটা বলা ভুল।’’
স্পনসর বা বিনিয়োগকারী এলে কি ক্লাবের নিজস্ব সত্তা নষ্ট হবে? ভাস্করের বক্তব্য, ‘‘মোহনবাগানের নাম বদলে এটিকে মোহনবাগান হয়ে গিয়েছে। এতে অনেকের আপত্তি। সত্যিই তো শতাব্দী প্রাচীন ক্লাবের নামের আগে আরেকটা ক্লাবের নাম বসবে কেন? কিন্তু আমরা নিরুপায়। আবারও বলছি, আইপিএল-কে দেখে আইএসএল শিখুক যে প্রতিযোগিতা এবং ফ্র্যাঞ্চাইজি, দু’দিকেই ভারসাম্য রেখে কী করে চলতে হয়।’’