Indian Football

Commentary: বাংলা ধারাবিবরণীতে ইংরেজির আধিক্য, ‘আমরা-ওরা’র পক্ষপাত, উঠছে প্রশ্ন

অতীতে অজয় বসু, কমল ভট্টাচার্যরা রেডিয়োয় শ্রুতিমধুর ধারাভাষ্য দেওয়ার জন্য সুনাম অর্জন করেছিলেন। সেই ধারাভাষ্যই এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০২২ ১৭:০৭
Share:

বাংলা ধারাভাষ্যের অবস্থা খারাপ প্রতীকী ছবি

কোভিডের পর প্রথম বার ভারতের ফুটবল দল খেলতে এসেছিল কলকাতায়। ছিলেন সুনীল ছেত্রীও। স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের উন্মাদনা ছিল তুঙ্গে। প্রতিটি ম্যাচেই মাঠ ভরিয়েছেন দর্শকরা। মঙ্গলবার হংকং ম্যাচেই সবচেয়ে বেশি জনসমর্থন ছিল সুনীলদের পক্ষে। তবে এমন অনেকেই আছেন, যাঁদের টিভিতে খেলা দেখে মন ভরাতে হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়। মাঠে যেতে না পারার দুঃখ তো ছিলই। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে টিভিতে খেলা দেখার তিক্ত অভিজ্ঞতা। আরও ভাল করে বললে, খেলা ‘শোনার’।

Advertisement

বেশ কয়েক বছর ধরে ক্রিকেট এবং ফুটবলে স্থানীয় ভাষায় ধারাভাষ্য শুরু হয়েছে। বাংলার পাশাপাশি তামিল, কন্নড়, তেলুগুতেও ধারাভাষ্য হচ্ছে। কিন্তু এখনকার বাংলা ধারাভাষ্যকে নিম্নমানের বলেই দেগে দিচ্ছেন সাধারণ ফুটবল সমর্থক থেকে প্রাক্তনরা। এর একটা বড় কারণ, ধারাভাষ্যের সময় অহেতুক এবং ধারাবাহিক ভাবে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার। স্থানীয় মানুষ, বিশেষ করে গ্রামবাংলার যাঁরা সে ভাবে ইংরেজি বোঝেন না অথচ খেলা দেখতে ভালবাসেন, তাঁদের কাছে সেই ধারাভাষ্য ক্রমশ পীড়াদায়ক হয়ে উঠছে। দ্বিতীয়ত, খেলা চলাকলীন অহেতুক চেঁচিয়ে ওঠা এবং টেকনিক্যাল শব্দ না জানাও একটা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

অতীতে অজয় বসু, পুষ্পেন সরকার, কমল ভট্টাচার্যরা রেডিয়োয় শ্রুতিমধুর ধারাভাষ্য দেওয়ার জন্য সুনাম অর্জন করেছিলেন। ক্রিকেট হোক বা ফুটবল, মাঠে কী হচ্ছে তা শব্দের মাধ্যমে সুন্দর করে ফুটিয়ে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়াই ছিল তাঁদের কাজ। টিভি আসার পর রেডিয়োর ধারাভাষ্য কার্যত বন্ধ। টিভিতে মূলত ইংরেজিতে ধারাভাষ্য দেওয়া হত। সম্প্রতি আইপিএল, আইএসএলে স্থানীয় ভাষায় ধারাভাষ্য দেওয়ার চল হয়েছে। সেখানেও এমন মানের ধারাভাষ্যকারদের নিয়োগ করা হচ্ছে, যাঁরা খেলার বর্ণনা তো করতে পারছেনই না, উল্টে অবাঞ্ছিত, অপ্রয়োজনীয় শব্দ ব্যবহার করে শ্রোতাদের আরও বিভ্রান্ত করে দিচ্ছেন।

Advertisement

ভারতের ফুটবল ম্যাচগুলিতে তার নিদর্শন দেখা গিয়েছে। এক ধারাভাষ্যকার ক্রমাগত ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে গেলেন। এক-এক সময় গোটা একটি বাক্যই তিনি ইংরেজিতে বলছিলেন। ইংরেজি একটু কম জানেন, এমন মানুষের পক্ষে কার্যত সেটি বোঝা সম্ভব নয়।

আর এক জন ভারতীয় দলকে ক্রমাগত ‘আমরা’ বলে উল্লেখ করে গেলেন। সুনীল ছেত্রীরা বল পেলেই তিনি বলেছেন, ‘আমরা বল পেলাম’, ‘আমাদের ফ্রি-কিক দেওয়া হল’ ইত্যাদি। রাজনীতির মতো ধারাভাষ্যের বক্সেও ‘আমরা’, ‘ওরা’ শুনে অনেকেই অবাক হয়ে গিয়েছেন। ফুটবল যেখানে যাবতীয় বিভেদ দূর করার পাঠ শেখাচ্ছে, সেখানে এমন ধারাভাষ্য শুনে প্রশ্ন উঠছে, একজন ধারাভাষ্যকার কি সাধারণ সমর্থকদের মতো কথা বলতে পারেন? সম্প্রচারকারী চ্যানেলের তরফেই বা এগুলিকে আটকানো হচ্ছে না কেন?

সম্প্রচারকারী চ্যানেলের সঙ্গে যুক্ত কেউ এ প্রসঙ্গে মুখ খুলতে রাজি হননি। তবে আনন্দবাজার অনলাইনকে এক কর্তা জানালেন, চ্যানেলের তরফে এ ব্যাপারে কোনও নির্দেশ এখনও দেওয়া হয়নি। বস্তুত, ইংরেজি শব্দ কিছু ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত ভাবেই ব্যবহার করা হয়। মূলত দু’টি কারণ রয়েছে এর পিছনে। প্রথমত, আধুনিক প্রজন্মকে আরও বেশি করে আকৃষ্ট করা। কারণ এখনকার প্রজন্ম বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন খেলার সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু এমন শব্দ রয়েছে, যেগুলি বাংলায় ভেঙে বলা মুশকিল। যেমন, ‘ডাউন দ্য লাইন রান’, ‘অফ দ্য বল রান’। সে ক্ষেত্রে মূল ইংরেজি শব্দটিই রেখে দেওয়া হয় ধারাভাষ্যের সময়ে।

তা সত্ত্বেও বিতর্ক এড়ানো যাচ্ছে না। অনেকেই বলছেন, একটি-দু’টি শব্দ হলেও হত। তা বলে পুরো বাক্যই কি ইংরেজিতে বলতে হবে? যে ইংরেজি শব্দের খুব সহজবোধ্য বাংলা রয়েছে, সেটি কেন বাংলায় বলা যাবে না? অতীতে বহু ম্যাচে ধারাভাষ্য দেওয়া বাংলার এক প্রাক্তন ফুটবলার আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “সত্যি বলতে, এখন যে ধারাভাষ্য দেওয়া হয় সেটা শোনার যোগ্য নয়। নিম্নমানের ধারাভাষ্য, খারাপ বাংলা, অবাঞ্ছিত শব্দের বহুল ব্যবহার করা হচ্ছে। অবাক হচ্ছি ভেবে যে, চ্যানেলের তরফেও এ নিয়ে কিছু বলা হচ্ছে না। অতীতের যে দিক্‌পাল ধারাভাষ্যকারদের শুনে এসেছি। এখন সেই মান তলানিতে এসে ঠেকেছে।”

কলকাতা ডার্বি-সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ধারাভাষ্য দেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে, এমন এক ধারাভাষ্যকার বললেন, “ইংরেজি শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে আধুনিক প্রজন্মকে আকৃষ্ট করার একটা চেষ্টা থাকেই। তবে কোনও কিছুই বাড়াবাড়ি হওয়া ভাল না। আমার ব্যক্তিগত জীবনে খেলার সঙ্গে জড়িত কিছু শব্দ ছাড়া কোনও দিন ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করিনি। যদিও বা করে থাকি, তার কী অর্থ সেটাও শ্রোতাদের বলে দিয়েছি। শ্রোতাদের সামনে অস্পষ্ট কিছু তুলে ধরা আমাদের কাজ নয়। আমার ধারণা, মানুষ ঠিক কী চায় সে সম্পর্কে সম্প্রচারকারী চ্যানেলের যথেষ্ট ধারণা নেই। আগেও কোনও দিন ছিল কি না জানি না। এটা দরকার। তা হলে অনেক মানুষই হয়তো বলবেন যে তাঁরা ইংরেজি শব্দ শুনতে পছন্দ করছেন না।”

ধারাভাষ্যের বক্সে ‘আমরা’, ‘ওরা’ বিভাজন সম্পর্কে তিনি বললেন, “আমার ধারণা, ভারতের ম্যাচ হওয়ার সময় যে হেতু সব সমর্থক একটা দলের হয়েই গলা ফাটান, তাই ‘আমরা’ বলে সমর্থকদের সঙ্গে একাত্মবোধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। ডার্বি হলে কোনও দিন এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। তা হলে এক দলকে খোলাখুলি সমর্থন করা হয়ে যাবে। ডার্বিতে কোনও দলের গোলের সময়েও আমরা পরিমিত উচ্ছ্বাস দেখাই। খেয়াল রাখি যাতে বাড়াবাড়ি না হয়ে যায়। অন্য দলের সমর্থকদের ভাবাবেগে যেন আঘাত না লাগে। ব্যক্তিগত ভাবে বলব, ‘আমার’, ‘তোমার’ জাতীয় শব্দ বাদ দেওয়াই ভাল।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement