ভারতের কোচ ইগর স্তিমাচ। — ফাইল চিত্র
ইগর স্তিমাচ কি লাল কার্ড ভালবাসেন? না কি তিনি অতিরিক্ত দলপ্রেমী?
টানা দু’টি ম্যাচে লাল কার্ড দেখার পর ভারতীয় ফুটবল দলের কোচকে নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। ফুটবলজীবনে স্তিমাচ যে রকম আগ্রাসী ছিলেন, কোচ হিসাবেও তাঁর আচরণে ফারাক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রোয়েশিয়াকে ১৯৯৮ বিশ্বকাপে তৃতীয় স্থানে শেষ করানোর পিছনে ছিল তাঁর আগ্রাসী ভঙ্গিই। কিন্তু ফুটবলার হিসাবে যা শোভনীয়, কোচ হিসাবে যে তা নয়, এটা কেউ ক্রোয়েশিয়ান স্তিমাচকে বোঝাতে পারছেন না। ফলে ভারতের কোচ হিসাবে স্তিমাচের অতিরিক্ত আগ্রাসন বা অতিরিক্ত দলপ্রেম ভারতকে বিপদের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। ভারতীয় ফুটবল সংস্থা (এআইএফএফ) তাই আর রাশ আলগা করতে চায় না। স্তিমাচকে কড়া বার্তা দিয়ে বলে দেওয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে এ ধরনের আচরণ মেনে নেওয়া হবে না।
সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে ভারত আগামী শনিবার খেলতে নামবে লেবাননের বিরুদ্ধে। কঠিন এই ম্যাচে তারা পাচ্ছে না স্তিমাচকে। কুয়েতের বিরুদ্ধে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে লাল কার্ড দেখেছেন তিনি। তার পরে কোচের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেছেন সংস্থার এক শীর্ষকর্তা। শোনা যাচ্ছে, আচরণের কারণে দু’টি ম্যাচে স্তিমাচকে নির্বাসিত করতে পারে সাফ কমিটি। সে ক্ষেত্রে ভারত ফাইনালে উঠলেও পাবে না কোচকে।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচে ভারত দাপট দেখানোর সময় সম্পূর্ণ অকারণে ঝামেলা করে লাল কার্ড দেখেন স্তিমাচ। কুয়েত ম্যাচে তিনি যখন লাল কার্ড দেখেন, তখন ভারত এগিয়ে ছিল। তার পরেই গোল খেয়ে যায়। দু’টি ক্ষেত্রেই তাঁর আচরণের কোনও দরকার ছিল না বলেই সংশ্লিষ্ট মহলের মত। এআইএফএফের এক সূত্র জানিয়েছেন, স্তিমাচের আচরণ সম্পর্কে একটি রিপোর্ট ‘সাফ’ তাদের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির কাছে পাঠিয়েছে। কারণ, স্তিমাচ রেফারিকে অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন, যা নিয়মবিরুদ্ধ। তাঁকে বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার মধ্যে লিখিত আকারে কারণ জানাতে বলা হয়েছে।
তবে যা-ই হোক না কেন, স্তিমাচ কোনও পক্ষেরই সমর্থন পাচ্ছেন না। এক জন কোচের মাঠে থাকার গুরুত্ব কতটা? ময়দানের একাধিক ক্লাবে কোচিং করানো কৃষেন্দু রায় আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছেন, “প্রথমেই বলব, কোন পরিস্থিতিতে লাল কার্ড দেখেছে সেটা দেখা উচিত। কিন্তু স্তিমাচ যে পরিস্থিতিতে লাল কার্ড দেখেছে সেটা একেবারেই উচিত হয়নি। আমরা সব সময়ে বিদেশি কোচেদের দিকে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু ওঁরাও ভুল করতে পারেন। ম্যাচের ফলাফলের উপর সেটা প্রভাব ফেলতে বাধ্য। কোচ তাঁর দলের ফুটবলারদের কাছে অভিভাবকের মতো। তিনি না থাকলে অনেক কিছু বদলে যায়।”
ভারতীয় ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত এক কর্তা বলেছেন, “কোচ কোনও ফর্মেশন বদলাতে পারেন, কোনও ফুটবলারকে আলাদা নির্দেশ দিতে পারেন, কখন আক্রমণ করতে হবে সেটা বলতে পারেন। কোচ থাকলে দলের খেলাই বদলে যায়। গ্যালারিতে বসে সেটা কখনওই সম্ভব নয়। সহকারী কোচকে আগে জানাতে হবে গোটা ব্যাপারটা। স্তিমাচ সাজঘরেও যেতে পারবেন না। কঠিন ম্যাচে সেটা ভারতের বিপক্ষে যেতে পারে।”
একাংশের মতে, রেফারির কোনও সিদ্ধান্ত ভুল হলে তা জানানোর প্রক্রিয়া রয়েছে। দলের অধিনায়ক রেফারির কাছে গিয়ে প্রতিবাদ করতে পারেন। ম্যাচের পর লিখিত আকারে প্রতিবাদ জানাতে পারেন। তাতে পয়েন্ট ফেরত বা ম্যাচের ফলে বদল না হলেও, সেই রেফারির মূল্যায়নে তার প্রভাব পড়বে এবং তিনি ভবিষ্যতে নির্বাসিতও হতে পারেন। কিন্তু এখানে কোচ নিজে খারাপ ব্যবহার করার কারণে তাঁকে শাস্তি পেতে হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে দলেও। তাঁদের মতে, একজন কোচের কাজ হল ফুটবলারদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। সেখানে তিনি নিজেই নিন্দনীয় আচরণ করলে কী শিখবেন ফুটবলাররা? তাঁরা তখন মনে করতে পারেন, মাথা গরম করার অধিকার তাঁদেরও রয়েছে!
একই কথা বললেন তিন প্রধানে খেলা ফুটবলার মেহতাব হোসেন। তাঁর কথায়, “ফুটবল দ্রুতগতির খেলা। এখানে মাঠে থাকা অধিনায়কের পক্ষে সব সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না। এখানেই দরকার এক জন কোচের। তিনি গোটা খেলার উপরে লক্ষ্য রাখতে পারেন। দরকারে কৌশল বদলে, খেলার গতি কমিয়ে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলতে পারেন। এই সিদ্ধান্ত এত দ্রুত নেওয়া তাঁর পক্ষেই সম্ভব। কোচও রেগে গেলে তাতে হিতে বিপরীত হবে। পাশাপাশি, এক জন কোচের কাজ ম্যান ম্যানেজমেন্ট। তিনি ফুটবলারদের সামলে রাখেন। সেই কোচই যদি মাথা গরম করেন তা হলে ফুটবলাররা কী শিখবে?”
এআইএফএফের সেক্রেটারি জেনারেল শাজি প্রভাকরণ বুধবার ১০ মিনিট কথা বলেছেন স্তিমাচের সঙ্গে। তিনি বলেছেন, “আমরা কোচকে বলেছি ম্যাচের উপর ফোকাস করতে। এত দিন ধরে দল যে ফুটবল খেলছে সেটাই ধরে রাখা উচিত। তার জন্যে কোচকে দরকার। তিনি নিজেই খারাপ আচরণ করলে দলে তাঁর প্রভাব পড়ে।” পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লাল কার্ডের পরেও স্তিমাচের সঙ্গে কথা বলেছিলেন শাজি। কিন্তু তাতে যে কোনও কাজ হয়নি সেটা বোঝাই যাচ্ছে।
স্তিমাচের আরও একটি আচরণে ক্ষুব্ধ এআইএফএফ। পাকিস্তান ম্যাচের পর তিনি কড়া ভাষায় টুইট করে জানিয়েছিলেন, ভবিষ্যতে দলের ছেলেদের ‘রক্ষা’ করার জন্যে আবার একই আচরণ করবেন। মাঠে ফিরে স্তিমাচের সেই ‘আচরণ’ই দেখা গিয়েছে। এআইএফএফের টেকনিক্যাল কমিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান শ্যাম থাপার মতে, স্তিমাচ দলের প্রতি অতিরিক্ত ভালবাসা দেখাতে তাদেরই খাটো করছেন। এই আচরণে বিরোধী তিনিও।
ছ’মাস পরেই এশিয়ান কাপ খেলতে নামবে ভারত। তার আগে কোচ যথেষ্ট চিন্তায় রেখেছে এআইএফএফকে। এক কর্তার ধারণা, এশিয়ান কাপের প্রতিপক্ষ দলগুলি স্তিমাচকে এখন থেকেই ‘টার্গেট’ করে রাখবে। তারা চাইবে কোচকে রাগিয়ে দিতে। তাঁর কথায়, “এমন নয় যে স্তিমাচ লাল কার্ড দেখার পর দল ০-৪ পিছিয়ে ছিল। তার উপর নিজের মাঠে খেলা। চেনা পরিবেশ। সেখানে এ ধরনের আচরণ একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না। শুধু অধিনায়ক নয়, দলের নেতা স্তিমাচও। এ ভাবে দল নেতাহীন থাকতে পারে না।”
স্তিমাচের আচরণকে ধামাচাপা দিতে বার বার আসরে নামতে হচ্ছে সহকারী কোচ মহেশ গাউলিকে। কিন্তু তিনিও পাকিস্তান ম্যাচে স্তিমাচের আচরণের বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁকে বার বার স্তিমাচের পাশে না দাঁড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এশিয়ান কাপের আগে আগামী দিনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ খেলতে চলেছে ভারত। তার আগে যাতে স্তিমাচ যাতে ‘ঠিক’ হয়ে যান, আপাতত সেই চেষ্টাতেই মগ্ন এআইএফএফ।