জামাল ভুঁইয়া। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক।
মাত্র চার দিন আগেই সিংহের গুহায় গিয়ে সিংহশিকার করে এসেছে ইগর স্তিমাচের দল। বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জনকারী পর্বে কাতারের মাঠে গিয়ে এশিয়া সেরাদের রুখে দেওয়া তো সিংহশিকার করার মতোই ব্যাপার। তার পর থেকে যেন মেঘের উপর দিয়ে হাঁটছে ভারতীয় ফুটবল। আগামী মাসের ১৫ তারিখ বাঙালির বড় আপন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ভারতের সামনে বাংলাদেশ।
দুই দেশের ফুটবলে কী অদ্ভুত মিল! ঠিক এক বছর আগে এশিয়ান গেমসে কাতারকে হারিয়ে প্রথম বার বাংলাদেশ পৌঁছেছিল নক আউট পর্বে। সে দেশের ফুটবলে স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন জামাল ভুঁইয়া। দুই প্রতিবেশী দেশের ফুটবল লড়াইয়ে পদ্মাপারের দেশের অধিনায়কও যে তিনিই। আসন্ন লড়াইয়ের আগে কোপেনহেগেন থেকে আনন্দবাজারকে জামাল বললেন, ‘‘কাতারের বিরুদ্ধে ভারতের খেলা দেখেছি। খুবই ভাল খেলেছে।আমাদের সঙ্গে ভারতের লড়াইটা গ্রুপের সব চেয়ে উত্তেজক ম্যাচ হবে বলেই আমার মনে হচ্ছে।’’ তার পরেই চোয়াল শক্ত করে জামাল বলছেন, ‘‘গত বছর আমার গোলেই বাংলাদেশ হারিয়েছিল কাতারকে।’’
সিনেমার চিত্রনাট্যকেও যেন হার মানায় জামালের জীবন! তাঁর জীবনের প্রতিটি মোড়ে রয়েছে ‘পাহাড়’ ডিঙনোর এক অসম্ভব গল্প। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই থেমে যেতে পারত তাঁর জীবন। দুষ্কৃতীদের চার-চারটি গুলিতে জীবন সংশয় হয়েছিল তাঁর। কিন্তু ঈশ্বর জামালের জন্য ভেবে রেখেছিলেন অন্য কিছু। বাংলাদেশ জাতীয় দলের ছ’নম্বর জার্সিধারী ফুটবলার বলেন, ‘‘আমার মা-বাবা থাকতেন কিশোরগঞ্জে। পরে তাঁরা চলে যান ডেনমার্কে। আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠাও সেখানেই। ১৫ বছর বয়সে ডেনমার্কে থাকার সময়েই আমি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলাম। তখন ফুটবলে ধীরে ধীরে উন্নতি করছিলাম। সেই সব দিনের অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছি, কঠিন পরিশ্রম করলে অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে আলোর দেখা অবশ্যই মিলবে।’’
আরও পড়ুন: মোহনবাগানের বিরুদ্ধেই নতুন ইনিংস শুরু করছেন ইস্টবেঙ্গলের ঘরের ছেলে
আরও পড়ুন: টক্করে বিরাট-রোহিত, ধর্মশালায় একাধিক রেকর্ডের সামনে ভারতের সেরা দুই
বাংলাদেশের ফুটবলে এখন জামালের দীর্ঘ ছায়া। অথচ সেই পথটাও পাপড়ি বিছানো ছিল না। ডেনমার্ক থেকে বাংলাদেশে এসে গরমের সঙ্গে মানিয়ে নিতে প্রবল সমস্যায় পড়তে হয়েছিল জামালকে। অনেক কষ্টে মানিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। জীবন তাঁকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। তাই জামাল বলতে পারেন, ‘‘জীবনের ওঠাপড়া থেকে আমি শিক্ষা নিয়েছি। পরিস্থিতির মোকাবিলা এখন আমি খুব সহজেই করতে পারি।’’
জিমে জামাল।
তাঁর ফুটবলেও জীবনেরই ছাপ। মাঠের ভিতরেও অক্লান্ত পরিশ্রম করেন জামাল। প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে সতীর্থ স্ট্রাইকারদের জন্য ঠিকানা লেখা পাস বাড়ান তিনি। বাংলাদেশের মাঝমাঠের ‘জেনারেল’ তিনি। ভারতের বিরুদ্ধে আসন্ন লড়াই প্রসঙ্গে জামাল বলছেন, ‘‘ভারত খুবই শক্তিশালী দল। গত চার-পাঁচ বছরে এশিয়ার অন্যান্য দলগুলোর থেকে ভারতই সব চেয়ে বেশি উন্নতি করেছে বলেই আমি মনে করি।’’
ভারতের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত দুটো ম্যাচে খেলেছেন জামাল। দুটো ম্যাচই ড্র হয়েছিল। সেই দুটো ম্যাচে ভারতের হয়ে গোল করেছিলেন সুনীল ছেত্রী। কাতারের বিরুদ্ধে অসুস্থতার জন্য মাঠে নামতে পারেননি ভারত অধিনায়ক। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মাঠে ফিরতে মরিয়া সুনীল। যুবভারতী ভরানোর ডাক দিয়ে রেখেছেন ভারত অধিনায়ক। সুনীলকে সমীহ করে জামাল বলছেন, ‘‘ভারতের হাতে যে অস্ত্র রয়েছে, বাংলাদেশের কাছে তা নেই। ধারাবাহিক ভাবে ভারতের হয়ে গোল করে চলেছে সুনীল। বাংলাদেশ ঠিক এই জায়গাতেই পিছিয়ে।’’ অকপটে বলে দেন জামাল।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় ফুটবলার জামাল।
বাংলাদেশের ফুটবল মরসুম শেষ হয়ে গিয়েছে। ভারতে কিন্তু এখন ভরা ফুটবল মরসুম। সুনীলরা ফিরে গিয়েছেন নিজের নিজের আইএসএল ক্লাবে। স্তিমাচের কড়া নজর রয়েছে সুনীল-সন্দেশদের দিকে। অন্য দিকে, ছুটি কাটাতে এখন ডেনমার্কে বাংলাদেশ অধিনায়ক। ভারত-ম্যাচের জন্য ২৫ তারিখ থেকে শুরু হবে বাংলাদেশের ক্যাম্প। জামালদের লড়াই খুব কঠিন। বিশ্বকাপের যোগ্যতা পর্বে শুরুটা ভাল হয়নি বাংলাদেশের। আফগানিস্তানের কাছে প্রথম ম্যাচেই হার মানতে হয়েছে জামালদের। বাংলাদেশের ‘মাসচেরানো’ বলছেন, ‘‘আমাদের গ্রুপটা খুবই কঠিন। প্রতিটি ম্যাচেই আমরা আন্ডারডগ হিসেবে শুরু করছি। কিন্তু, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কঠিন পরিশ্রম এবং দায়বদ্ধতা দেখাতে পারলে আমরা বেশ কিছু পয়েন্ট আদায় করে নিতে পারব।’’
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সব চেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলার তিনিই। লা লিগার ম্যাচে ধারাভাষ্য করেছেন। স্থানীয় ফুটবলারদের মধ্যে তাঁর পারিশ্রমিকই সবচেয়ে বেশি! বিদেশি কোচরা দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে বাংলাদেশের সইফ স্পোর্টিং ক্লাবের জামালকেই চিহ্নিত করেছেন। নিজের ক্লাব প্রসঙ্গে হোল্ডিং মিডফিল্ডার বলেছেন, ‘‘সইফের হয়ে খেলতে আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি। অত্যন্ত পেশাদার ক্লাব। ৯৫ শতাংশ ফুটবলারই তরুণ। আমাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর নাসিরউদ্দিন খুবই কর্মঠ। কী ভাবে উন্নতি করা সম্ভব, তার জন্য প্রচণ্ড পরিশ্রম করেন। ক্লাবের উচ্চাকাঙ্খা আমাকে টানে।’’ ডেনমার্কের নামী ক্লাবে খেলে বাংলাদেশের ফুটবলে এখন ফুল ফোটাচ্ছেন জামাল। তাঁর আবির্ভাবের অপেক্ষাতেই বোধহয় এতদিন ছিল পদ্মাপাড়ের ফুটবল।