ছবি রয়টার্স।
ইউরো ২০২০ বনাম কোপা আমেরিকা। এক দিকে ইটালি, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, ইংল্যান্ড, পর্তুগাল-সহ ইউরোপের অন্যান্য দেশ। অন্য দিকে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, চিলি, কলম্বিয়ার সঙ্গে লাতিন আমেরিকার শক্তিরা। ক্রীড়াপ্রেমীদের চিরকালীন আবেগ বনাম আধুনিক ফুটবলের দ্বৈরথে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে থাকল ইউরোপই।
দুটো ফাইনাল দেখার পরে মার্কোস ফালোপা থেকে সুব্রত পাল, সকলে মেনে নিচ্ছেন, কোপার থেকে ইউরোর মহারণ অনেক আকর্ষণীয় হয়েছিল। কেন? তাঁদের মতে, ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা দ্বৈরথে লিয়োনেল মেসি-নেমার দা সিলভা স্যান্টোস জুনিয়র খেললেও ম্যাচ সেই উচ্চতায় পৌঁছয়নি। লাতিন শিল্পের চেয়ে সেখানে দেখা গিয়েছে শারীরিক ফুটবলের আধিপত্য। কিন্তু ইউরো ফাইনালে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টানটান উত্তেজনা ছিল। ফালোপা যেমন বলছেন, ‘‘দুই কোচের রণনীতি ও ফুটবলারদের হার-না-মানা মানসিকতা মুগ্ধ করেছে।’’
লাতিন আমেরিকার ফুটবল যখন ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে, নিখুঁত পরিকল্পনা ও উন্নত পরিকাঠামোয় এগিয়ে চলেছে ইউরোপ। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার ফুটবলের উত্থানের নেপথ্যে ছিল ঘরোয়া লিগ। ব্রাজিলের স্যান্টোস, সাও পাওলো, ফ্ল্যামেঙ্গো। আর্জেন্টিনার বোকা জুনিয়র্স, রিভারপ্লেটের মতো ক্লাবগুলির খবর এখন কত জন ফুটবলপ্রেমী রাখেন? অথচ ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, লা লিগা, সেরি আ থেকে জার্মান বুন্দেশলিগা— বিশ্বের সেরা লিগগুলোয় ইউরোপের পাশাপাশি লাতিন আমেরিকার ফুটবলারদের দাপটও দেখা যায়। রবিবার টাইব্রেকারে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দ্বিতীয় বার ইউরো চ্যাম্পিয়ন হওয়া ইটালির তিন ফুটবলার জর্জে লুইজ় (জর্জিনহো), এমার্সন স্যান্টোস ও রাফায়েল তোলুইয়ের জন্ম ব্রাজিলেই!
ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা, ফুটবলের দুই আতুড় ঘরেই এখন আঁধার। কেন আকর্ষণ হারাচ্ছে লাতিন আমেরিকার ফুটবল? ফিফার টেকনিক্যাল ইনস্ট্রাকটর ও ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন কোচ সাও পাওলো থেকে ফালোপা ফোনে আনন্দবাজারকে বললেন, “ব্রাজিলের ফুটবল পরিকাঠামোই ভেঙে পড়েছে। তা ছাড়া ইউরোপের ক্লাবগুলোর প্রচুর অর্থ। ওরা আমাদের দেশ থেকে প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলারদের খুব অল্প বয়সেই নিয়ে চলে যায়। সেরা উদাহরণ, ভিনিসিয়াস জুনিয়র। শুধু ব্রাজিল নয়, লাতিন আমেরিকার কোনও ক্লাবেরই প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলার ধরে রাখার সেই আর্থিক সামর্থ নেই।” যোগ করেন, “ভাল মানের ফুটবলার না খেললে লিগের আকর্ষণ কমবেই। লাতিন আমেরিকার ভাল ফুটবলারেরা সকলেই তো ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে খেলে। অনেকেই সেই দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে নিচ্ছে।”
ছবি রয়টার্স।
ফালোপাও স্বীকার করলেন, কোপার চেয়ে ইউরো ২০২০ অনেক এগিয়ে রয়েছে। কেন? তাঁর ব্যাখ্যা, “কোপায় লড়াইটা মূলত ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। ইউরোয় প্রচণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। আর তাই খেলার মানও অনেক উন্নত ছিল।”
ম্যাঞ্চেস্টার সিটি ও এভার্টনের মতো ক্লাবে খেলা গত মরসুমে এসসি ইস্টবেঙ্গলের সহকারী কোচ অ্যান্টনি জেমস গ্রান্ট সোমবার লিভারপুল থেকে বললেন, “মানুষ আকর্ষণীয় ফুটবল দেখতেই ভালবাসেন। যে প্রতিযোগিতায় ইংল্যান্ড, জার্মানি, স্পেন, ইটালি, পর্তুগাল, ফ্রান্সের মতো দেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, তাদের খেলাই তো সকলে দেখতে চাইবেন। কোপা নিয়ে ইংল্যান্ডের মানুষের ন্যূনতম আগ্রহ ছিল না।”
ভারতের অন্যতম সফল কোচ আর্মান্দো কোলাসো অভিভূত ইউরোর খেলা দেখে। তিনি বলছেন, “ইউরো দেখাল ফুটবল কী ভাবে বদলে যাচ্ছে। তিন ডিফেন্ডারে খেলার ঝুঁকি আমরা নিতেই পারতাম না। ইউরোয় অনেক বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে বলেই খেলার আকর্ষণ অনেক বেশি। গুণগত মানও অনেক ভাল।”
ভারতীয় ফুটবল তারকারাও মুগ্ধ ইউরো নিয়ে। গত মরসুমে লাল-হলুদের হয়ে খেলা স্ট্রাইকার জেজে লালপেখলুয়ার কথায়, “এ বারের মতো আকর্ষণীয় ইউরো কখনও হয়নি। আধুনিক ফুটবল কোন উচ্চতায় পৌঁছেছে, তা উপলব্ধি করলাম। পিছিয়ে পড়ার পরে কী ভাবে হাল না ছেড়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, ইউরো দেখে শেখার চেষ্টা করেছি।” গোলরক্ষক সুব্রত বলছিলেন, “ইউরোপীয় ফুটবল বরাবরই অনেক বেশি পরিকল্পিত ভাবে খেলা হয়। ইউরোপের কোচেরাও এই মুহূর্তে রণকৌশল তৈরিতে অনেক, অনেক এগিয়ে। লাতিন আমেরিকায় শরীরী ফুটবল হয়। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার খেলায় আগে শিল্পের ছোঁয়া থাকত। এখন এই দু’টি দেশও শারীরিক ফুটবল খেলছে।” যোগ করেন, “স্ট্রাইকারেরা ম্যাচ জেতায়। চ্যাম্পিয়ন করে ডিফেন্ডারেরা। রক্ষণ শক্তিশালী না হলে খেতাব জেতা যায় না, ইউরো শেখাল।”