উত্তাল মার্সেই। কুৎসিত ফুটবল-উন্মাদনা।
গ্যালারিতে ইংরেজ সমর্থকের মুখে আছড়ে পড়ল বিরাশি সিক্কার ঘুসি। তিনি পাল্টা দিতে যাচ্ছিলেন, এ বার ব্রুস লি স্টাইলে তাঁর বুকে পড়তে লাগল একের পর এক লাথি।
মাথা ফেটে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে ইংল্যান্ড পতাকা জড়ানো সমর্থকের। এক কালো জামা তখনও লোহার রড দিয়ে পেটাচ্ছেন তাঁকে।
ম্যাচ শেষে ইংল্যান্ড গোলের পিছন থেকে হঠাৎই ডান দিকের গ্যালারিতে আছড়ে পড়ল জ্বলন্ত হাউই। দেখে দু’হাত গালে ভয়ার্ত মুখে সটান দাঁড়িয়ে পড়লেন ইংরেজ গোলকিপার জো হার্টের স্ত্রী কিম্বার্লি। টিভিতে দেখা যাচ্ছিল আতঙ্কিত মুখে ছুটে গিয়ে জো হার্ট স্ত্রীকে বলছেন, ‘‘এক্ষুনি নিরাপদ কোনও জায়গায় গিয়ে দাঁড়াও। বাইরে যাওয়ার কোনও চেষ্টা কোরো না এখন।’’
মারদাঙ্গার হলিউড ছবি নয়। ইউরোতে শনিবার রাশিয়া-ইংল্যান্ড ম্যাচ শেষে দু’দেশের যুযুধান সমর্থকদের নানা খণ্ডযুদ্ধের কোলাজ। যার ধাক্কায় উয়েফার তদন্ত কমিটির সামনে রাশিয়া। মঙ্গলবার বেরোবে রায়।
বছরের শুরুতে ক্রেমলিনের মুখ পুড়েছিল একঝাঁক রুশ অ্যাথলিটের ডোপিং কেলেঙ্কারিতে। তার পর রুশ টেনিস সুন্দরী শারাপোভার ডোপিংয়ে ধরা পড়া এবং নির্বাসন। এ বার ইউরোর গ্রুপ লিগে রাশিয়া-ইংল্যান্ড ১-১ ম্যাচের পর ‘পরিকল্পিত’ দাঙ্গা বাঁধানোর অভিযোগে উয়েফার রক্তচক্ষুর সামনে ভ্লাদিমির পুতিনের দেশ। আগের দিনটা যদি কলঙ্কিত হয়ে থাকে ইংরেজ ‘হুলিগান’দের গুন্ডামিতে, তা হলে পরের দিনটাই আরও কলঙ্কিত করল ‘দাঙ্গাবাজ’ রুশ ফুটবল জনতা।
রবিবারই গোটা ঘটনার নিন্দা করে উয়েফা শুধুমাত্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিশন গড়েই ক্ষান্ত হয়নি, কড়া ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, টুর্নামেন্টে ফের এ রকম পরিস্থিতি যদি তৈরি হয় রুশ বা ইংরেজ সমর্থকদের জন্য, তা হলে দু’দেশকেই ইউরো থেকে বহিষ্কার করা হবে।
স্তাঁদ ভেলোড্রামের ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখার আতঙ্ক হোটেলে ফিরেও কাটেনি ইংলিশ ফুটবলের নয়া সুপারস্টার জেমি ভার্দির স্ত্রী রেবেকার। টুইটারে তাঁর বিষোদ্গার, ‘‘স্বচক্ষে যা দেখলাম তা ভয়াবহ। অকারণে গেট আটকে আমাদের দিকেই কাঁদানে গ্যাস চালানো হল। খাঁচার পশু-পাখিদের মতো আটকে রেখেছিল পুলিশ!’’
ফরাসি পুলিশের তথ্য অনুয়ায়ী রুশ সমর্থকদের হাতে বেধড়ক মার খেয়ে আহত হয়েছেন শতাধিক ইংরেজ সমর্থক। এঁদের মধ্যে এক জন আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি হাসপাতালে। মার খেয়ে মাঠেই নাকি ওই ইংরেজ সমর্থকের হৃদস্পন্দন সাময়িক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পুলিশের প্রচেষ্টায় ফের হৃদস্পন্দন ফেরে ওই ব্যক্তির। গোটা ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছে দু’পক্ষের অন্তত পঁচিশ জন সমর্থককে। স্তম্ভিত গ্যারি লিনেকারের প্রতিক্রিয়া, ‘‘এ কোথায় যাচ্ছি আমরা!’’
রুশ সমর্থকদের বিরুদ্ধে মিসাইল, স্মোক বোমা নিয়ে হামলা ছাড়াও বর্ণবিদ্বেষের অভিযোগও উঠে আসছে। উঠে আসছে নয়া নাৎসিবাদে দীক্ষিত রুশ সমর্থকদের ফুটবল মাঠে হাজির হওয়ার অভিযোগও। দু’বছর পর রাশিয়াতেই বিশ্বকাপ। কিন্তু ইংল্যান্ড ম্যাচের পর যে ভয়ঙ্কর অভিযোগ উঠে আসছে রুশদের বিরুদ্ধে, তাতে বিশ্বকাপের আগে আরও এক বার পুড়তে পারে রাশিয়ার মুখ।
যদিও রুশ ক্রীড়ামন্ত্রী ভিতালি মুতকো দাবি করেছেন, ‘‘মার্সেইয়ের মাঠে দাঙ্গার ঘটনা ঘটেনি।’’ উল্টে তিনিই অভিযোগ করেছেন, ‘‘যখন সন্ত্রাসবাদীদের হুমকির মুখে চলছে ইউরো তখন কেন আয়োজকরা দু’দেশের সমর্থকদের গ্যালারিতে এক সঙ্গে বসালো? স্টেডিয়ামে যাতে মিসাইল হানা না হয় তার জন্য কেনই বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখে মাঠ-গ্যালারির মাঝে জাল দিয়ে ঘেরা হয়নি?’’ ইংরেজ মিডিয়া আবার ভিতালিকেই রুশ সমর্থকদের প্ররোচিত করার জন্য কাঠগড়ায় তুলছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে জানা গিয়েছে, মাঠে ঢোকার আগে মার্সেইয়ের পাব-এ একপ্রস্ত হাতাহাতি-বোতল ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটেছিল দু’দেশের সমর্থকের মধ্যে। যাঁদের বেশির ভাগের গায়ে ছিল কালো টি-শার্ট। জলকামান এবং কাঁদানে গ্যাস চালিয়ে সেই দাঙ্গাবাজদের তখন ছত্রভঙ্গ করে দেয় ফরাসি পুলিশ। কিন্তু মাঠে রুশদের তাণ্ডব ফের শুরু হয় দ্বিতীয়ার্ধে ডায়ারের গোলে ইংল্যান্ড এগিয়ে যাওয়ার পরেই। ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজা মাত্র দু’দেশের সমর্থকরা জড়িয়ে পড়েন মারামারিতে। দলে কম হলেও কালো জামা পরা রুশ সমর্থকদের দাপটে এক সময় পালাতে দেখা যায় ইংরেজ সমর্থকদের। পুলিশ গ্যালারির তাণ্ডব থামালেও সেটা ততক্ষণে ছড়িয়ে পডে়ছে মার্সেইয়ের মেট্রো স্টেশন, রাস্তাঘাটে।
রাশিয়ান ‘আল্ট্রা’দের এই বাড়বাড়ন্ত কয়েক বছর ধরে ছড়িয়েছে সে দেশের ফুটবলে। কালো জামা পরে ফুটবল মাঠে হাজির থেকে বাদামি বা কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার, দর্শকদের বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য করা, উত্যক্ত করতে এদের জুড়ি মেলা ভার। মাঠে, মাঠের বাইরে মারামারিতে এরা সিদ্ধহস্ত। এদের বিরুদ্ধে কয়েক মাস আগেই সরব হয়েছিলেন রাশিয়ার ক্লাবে খেলা ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার হাল্ক। শনিবারের দাঙ্গার পিছনে এই ‘আল্ট্রা’দের হাত আছে বলে অনুমান ফরাসি পুলিশের।
ইউরো শুরুর আগে ফ্রান্সকে রক্তচক্ষু দেখাচ্ছিল সন্ত্রাসবাদীরা। কিন্তু মাঠে বল গড়াতেই তাকে পিছনে ঠেলে উঠে এসেছে ইংরেজ ও রুশ সমর্থকদের গুন্ডামি। এখন সেটা থামানোই ফরাসি পুলিশের যেন প্রধান চ্যালেঞ্জ।