Elina Svitolina

যুদ্ধ সোয়াইতোলিনার মনের জোর বাড়িয়েছে, দেশের জন্যই র‌্যাকেট ধরেছেন ইউক্রেনের মেয়ে

উইম্বলডনের সেমিফাইনালে উঠেছেন ইউক্রেনের এলিনা সোয়াইতোলিনা। কিন্তু কোর্টের বাইরে আরও একটা লড়াই লড়তে হচ্ছে তাঁকে। দেশের লড়াই। সেখানে বন্দুকের বদলে র‌্যাকেট তাঁর অস্ত্র।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৩ ১৯:২৩
Share:

ইগা শিয়নটেককে (ছবিতে নেই) হারিয়ে এলিনা সোয়াইতোলিনার উল্লাস। ছবি: রয়টার্স

উইম্বলডন জিততে চান এলিনা সোয়াইতোলিনা। সে তো যাঁরা টেনিস র‌্যাকেট হাতে নেন, তাঁরা প্রত্যেকেই চান। তা হলে? বাকি সবার চাওয়া আর সোয়াইতোলিনার চাওয়ার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। বাকিরা যেখানে ব্যক্তিগত নজিরের কথা ভাবেন, সোয়াইতোলিনা সেখানে ভাবেন দেশের কথা। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের কথা। কোর্টের বাইরের এই লড়াইয়ে বন্দুকের বদলে তাঁর অস্ত্র র‌্যাকেট। সেই যুদ্ধই তাঁর মনের জোর বাড়িয়েছে। যে কারণে মেয়ে হওয়ার ছ’মাস পরেই কোর্টে ফিরে খেলছেন। আর শুধু খেলছেন না, বিশ্বের সেরাকে হারিয়েছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অন্যতম দাবিদার তিনি।

Advertisement

বিশ্বের এক নম্বর ইগা শিয়নটেককে হারিয়ে উইম্বলডনের সেমিফাইনালে উঠে সোয়াইতোলিনা বলেছেন, ‘‘যুদ্ধ আমাকে মানসিক ভাবে আরও শক্তিশালী করেছে। এখন কঠিন পরিস্থিতি আর আমাকে টলাতে পারে না। কারণ, আমি জানি এর থেকে কত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমার দেশবাসীকে যেতে হচ্ছে। প্রতি দিন সবাইকে শুধু বেঁচে থাকার জন্যই কঠিন লড়াই করতে হচ্ছে। সেখানে আমার লড়াই তো তুচ্ছ।’’

উইম্বলডনের শুরুতে সোয়াইতোলিনা নিজেও ভাবতে পারেননি এত দূর যাবেন। সেই কারণে গত সপ্তাহে পপ তারকা হ্যারি স্টাইলসের অনুষ্ঠানের টিকিটও কেটে রেখেছিলেন। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে আর যেতে পারেননি। কারণ, এই দু’সপ্তাহে একের পর এক কঠিন প্রতিপক্ষকে হারিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন তিনি। শুরুটা হয়েছিল পাঁচ বারের উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন ভিনাস উইলিয়ামসকে হারিয়ে। তার পরে প্রাক্তন এক নম্বর বেলারুশের ভিক্টোরিয়া আজ়ারেঙ্কাকে হারিয়েছেন। সব শেষে এখনকার এক নম্বর উড়ে গিয়েছেন তাঁর শক্তিশালী ব্যাকহ্যান্ডের সামনে। যে শিয়নটেক বিশ্বের এক নম্বর হওয়ার পরে গ্র্যান্ড স্ল্যামে ৩১টি ম্যাচের মধ্যে ২৯টি জিতেছেন, সেই পোল্যান্ডের তারকাকে ছুটিয়ে মেরেছেন সোয়াইতোলিনা। ম্যাচ শেষে শিয়নটেক স্বীকার করে নিয়েছেন, যোগ্য খেলোয়াড় হিসাবে তাঁকে হারিয়েছেন সোয়াইতোলিনা।

Advertisement

ম্যাচ জিতে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি এলিনা সোয়াইতোলিনা। ছবি: রয়টার্স

তবে শুরুটা মোটেই সহজ হয়নি। সোয়াইতোলিনা ও তাঁর টেনিস খেলোয়াড় স্বামী ফ্রান্সের গেল মঁফিস যখন ঘোষণা করেন যে তাঁদের প্রথম সন্তান আসতে চলেছে, তখন ইউক্রেন আক্রমণ করেছে রাশিয়া। দেশের কঠিন পরিস্থিতিতে ইউক্রেন ছেড়ে লন্ডনে চলে যান তাঁরা। সেখানেই ছ’মাস আগে মেয়ে স্কাইয়ের জন্ম হয়েছে।

অন্তঃসত্ত্বা অবস্থাতেও দেশকে ভোলেননি সোয়াইতোলিনা। একটি সংস্থা গড়ে তোলেন তিনি। সেই সংস্থা যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষদের ত্রাণ সরবরাহের কাজ করে। এখনও সেই কাজ চলছে। কিন্তু তার জন্য দরকার অনেক টাকা। সেই কারণেই সন্তানের জন্মের পরেই টেনিসে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন সোয়াইতোলিনা। চলতি বছর মার্চ মাসে ইন্ডিয়ান ওয়েলসে কোর্টে ফেরেন তিনি। প্রত্যাবর্তনের শুরুটা ভাল হয়নি। প্রথম সাত ম্যাচের মধ্যে ছ’টিতেই হারতে হয়েছিল। কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি। ২০১৯ সালে ক্রমতালিকায় তিন নম্বরে উঠেছিলেন সোয়াইতোলিনা। কিন্তু ফেরাটা সহজ ছিল না। কঠিন লড়াই করতে হয়েছে। সদ্যোজাত মেয়ের থেকে দূরে থেকেছেন। কিন্তু যাঁর লক্ষ্য ব্যক্তিগত নজিরের থেকে ঊর্ধ্বে তাঁর প্রত্যাবর্তন হয়তো এ ভাবেই হয়।

সোয়াইতোলিনা নিজেই ফরাসি ওপেন চলাকালীন জানিয়েছিলেন, টেনিস এখন তাঁর কাছে শুধু একটি পেশাদার খেলা নয়, ক্রমতালিকায় উন্নতি করা নয়। দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য র‌্যাকেট হাতে নিয়েছেন তিনি। আর সেই হাসি তিনি একমাত্র ম্যাচ জিতেই ফোটাতে পারবেন। সেই সঙ্গে যে টাকা রোজগার করবেন তা দেশের মানুষের কাজে লাগাতে পারবেন। সেই কাজটাই করে চলেছেন তিনি।

ম্যাচ জিতে দর্শকদের দিকে চুমু ছুড়ছেন এলিনা সোয়াইতোলিনা। ছবি: রয়টার্স

প্রতিটি ম্যাচের পরে ভিডিয়ো কলে মেয়েকে দেখেন সোয়াইতোলিনা। দূর থেকেই মেয়েকে আদর করেন। যেমনটা করেছেন শিয়নটেককে হারানোর পরে। কিন্তু মেয়ে তো এখন টেনিস বোঝে না। বরং আইসক্রিম তার কাছে অনেক প্রিয়। সোয়াইতোলিনা বলেন, ‘‘আমি জিতেছি না হেরেছি সেটা বোঝার ক্ষমতা ওর হয়নি। বদলে নিজের আইসক্রিম নিয়েই ও ব্যস্ত। যেটুকু সময় ওকে দেখতে পাই, সেটাই আমার কাছে আনন্দের।’’ ম্যাচের পরে যেমন মেয়ের খবর নেন, তেমনি প্রতি দিন সকালে উঠে প্রথম কাজ দেশে থাকা পরিবারের সকলের খবর নেওয়া। বাড়ির কথা না জানতে পারলে বাকি অনুশীলন বা ম্যাচে মন দিতে পারেন না।

তাতেও যে সব সময় খেলায় মন দিতে পারেন, তা নয়। যুদ্ধের ছবিটা যে সারাক্ষণ চোখের সামনে ভাসতে থাকে। ফরাসি ওপেনের কোয়ার্টার ফাইনালে বেলারুশের এরিনা সাবালেঙ্কার কাছে হারার পর তাঁর সঙ্গে হাত মেলাননি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মস্কোর সঙ্গে ছিল বেলারুশ। ম্যাচের পর নিজের দেশে সামরিক হানার নীরব প্রতিবাদ করেছিলেন ইউক্রেনের সোয়াইতোলিনা। সমালোচিত হয়েছিলেন। উইম্বলডন খেলতে এসে অবশ্য প্রথম থেকে সমর্থনই পেয়েছেন তিনি। ওয়াইল্ড কার্ড নিয়ে বছরের তৃতীয় গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেলছেন।

উইম্বলডনের শুরু থেকেই সোয়াইতোলিনা যে সমর্থন পেয়েছেন তার জন্য বার বার ধন্যবাদ দিয়েছেন দর্শকদের। যে শিয়নটেককে হারিয়ে তিনি সেমিফাইনালে উঠেছেন সেই শিয়নটেকও সোয়াইতোলিনার ভাল বন্ধু। রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই ইউক্রেনকে প্রকাশ্যে সমর্থন করছেন শিয়নটেক। ত্রাণে আর্থিক সাহায্য করেছেন। যখনই খেলতে নামেন তাঁর টুপিতে ইউক্রেনের হলুদ-নীল পতাকা দেখা যায়। সোয়াইতোলিনার কাছে হেরে গেলেও তাঁকে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছেন শিয়নটেক। পরে বলেছেন, ‘‘ওর জন্য আমি খুব খুশি। আশা করছি, সোয়াইতোলিনাই উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন হবে।’’ তাঁর উপর বিশ্বাস রাখার জন্য শিয়নটেককে ধন্যবাদ জানিয়েছেন সোয়াইতোলিনা।

প্রতিপক্ষ ইগা শিয়নটেককে (বাঁ দিকে) জড়িয়ে ধরেছেন এলিনা সোয়াইতোলিনা। ছবি: রয়টার্স

পোল্যান্ডের প্রতিপক্ষকে ধন্যবাদ জানালেও যখনই তিনি রাশিয়া বা বেলারুশের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে খেলতে নামেন, তখনই মানসিকতা বদলে যায় সোয়াইতোলিনার। তখন তাঁর কাঁধে গোটা ইউক্রেনের চাপ থাকে। সেই ম্যাচ তখন টেনিসকে ছাপিয়ে হয়ে যায় দেশের জন্য লড়াই। সোয়াইতোলিনা বলেন, ‘‘যখনই আমি রাশিয়া বা বেলারুশের খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে নামি তখন একটা বড় দায়িত্ব থাকে। তাই সেই ম্যাচে আমি আরও বেশি আক্রমণাত্মক। বাকি সব ম্যাচ হারতে পারি কিন্তু ওদের বিরুদ্ধে হারা চলবে না।’’ সেই কারণেই ফরাসি ওপেনে সাবালেঙ্কার কাছে হারার পরে এক সেকেন্ডও কোর্টে দাঁড়াননি তিনি। সোজা বেরিয়ে যান।

এ বারেও ফরাসি ওপেনের রিপ্লে দেখা যেতে পারে। কারণ ফাইনালে উঠলে সোয়াইতোলিনাকে খেলতে হতে পারে বেলারুশের সাবালেঙ্কা বা কাজাখস্তানের রিবাকিনার বিরুদ্ধে। কাজাখস্তানের হয়ে খেললেও রিবাকিনার জন্ম ও বেড়ে ওঠা রাশিয়ায়।

উইম্বলডনের লকার রুমেও রাশিয়া বা বেলারুশের খেলোয়াড়দের সঙ্গে দেখা হলে কথা বলছেন না সোয়াইতোলিনা। তাঁরা কুশল বিনিময় করতে চাইলেও না। চতুর্থ রাউন্ডে আজ়ারেঙ্কাকে হারানোর পরে বেলারুশের খেলোয়াড় নেটের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। হাত মেলাননি সোয়াইতোলিনা। তবে ফরাসি ওপেনের বিপরীত ছবি দেখা গিয়েছে উইম্বলডনে। বিদ্রুপ শুনতে হয়েছে আজ়ারেঙ্কাকেই। তিনি কিন্তু যুদ্ধের সময় আর্থিক সাহায্য করার জন্য একটি প্রদর্শনী ম্যাচে অংশ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সোয়াইতোলিনার আপত্তিতে সেটা হয়নি। দেশকে নিয়ে তিনি এতটাই দৃঢ়। সেখানে ‘শত্রুপক্ষ’ যতই ভাল হোক, তিনি নিজের অবস্থানে অটল।

সেই কারণেই হয়তো এ ভাবে একের পর এক বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন সোয়াইতোলিনা। কারণ, তাঁর সঙ্গে রয়েছেন উইক্রেনের প্রত্যেকটি মানুষ। তাঁদের প্রতিনিধি হয়ে লড়ছেন সোয়াইতোলিনা। বিশ্বের সামনে নিজেদের কথা তুলে ধরছেন। টেনিসকে প্রতিবাদের মঞ্চ করে তুলছেন। সেখানে ব্যক্তিগত সাফল্য, ব্যর্থতার ঊর্ধ্বে দেশ। সেই কারণেই কয়েক বছর আগে ইংল্যান্ডের নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করেছেন। দেশই তাঁর কাছে আগে। তাই সমালোচনাকে পাত্তা না দিয়ে শত্রু দেশের প্রতিপক্ষের সঙ্গে হাত না মেলানো নিয়ে কোনও আক্ষেপ নেই তাঁর। বরং প্রতিবাদ করতে পেরে তিনি খুশি।

জুনিয়র পর্যায়ে ফরাসি ওপেন জিতেছেন। উইম্বলডন ফাইনাল খেলেছেন। রিয়ো অলিম্পিক্সের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছেন। ২০১০ থেকে পেশাদার টেনিস খেললেও সোয়াইতোলিনার ১৩ বছরের টেনিসজীবন ততটা ঝকঝকে নয়। গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেতাব নেই সোয়াইতোলিনার ঝুলিতে। নেই গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতাও। সেরা ফল ২০১৯ সালে উইম্বলডন এবং ইউএস ওপেনের শেষ চারে পৌঁছানো। এ বার সুযোগ রয়েছে। যে ভাবে তিনি এগোচ্ছেন, তাতে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিততেও পারেন। কারণ, এ বার তো আর সোয়াইতোলিনা একা খেলছেন না। তাঁর সঙ্গে খেলছেন লক্ষ লক্ষ সোয়াইতোলিনা। তাঁর প্রতিটি পয়েন্টের পরে উল্লাস করছে সেন্টার কোর্ট। সেই শক্তিতে বলিয়ান হয়েই এগিয়ে যাচ্ছেন ছ’মাস আগে মা হওয়া সোয়াইতোলিনা। খেলা বদলের খেলায় মেতেছেন তিনি। নিজের লক্ষ্য থেকে আর মাত্র দু’কদম দূরে দাঁড়িয়ে তিনি। পারবেন কি? উত্তর দেবে সময়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement